Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রফতানিতে আশার আলো

নাইক্ষ্যংছড়ির কুমির চাষে সাফল্য

কামাল আতাতুর্ক মিসেল : | প্রকাশের সময় : ২৮ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০১ এএম

পার্বত্য বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের তুমব্রেু কুমির চাষে বিস্ময়কর সাফল্য এসেছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে চার শতাধিক কুমির বিদেশে রফতানি করার পরিকল্পনা নিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা কুমির চাষ প্রকল্পটি সঠিকভাবে পরিচর্যা করা হলে আরও বেশি কুমির বিদেশের মাটিতে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা যায়, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম মৌজার তুমব্রু গ্রামের প্রায় ২৫ একর পাহাড়ি জমিতে আকিজ ওয়াইল্ড লাইফ ফার্ম লিমিটেড নামের কুমিরের খামারটি গড়ে তোলা হয় ২০০৮ সালে। বাণিজ্যিকভাবে সেখানে কুমিরের চাষ শুরু হয় ২০১০ সালে। প্রথম দফায় অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে ৫০টি অস্ট্রেলীয় প্রজাতির কুমির আমদানি করে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম খামারের উন্মুক্ত জলাশয়ে ছাড়া হয়। প্রতিটি কুমির কিনে আনা হয়েছিল তিন লাখ ৫০ হাজার টাকায়। এর মধ্যে ৪টি কুমির মারা গেলেও সুস্থ রয়েছে ৪৬টি। তার মধ্যে ৩১টি মাদি কুমির, আর ১৫টি পুরুষ। একেকটি কুমির প্রাপ্তবয়স্ক হতে সময় লাগে প্রায় ৮-১০ বছর। প্রাপ্তবয়স্ক একেকটি মাদি কুমির ৪০-৮০টি করে ডিম দেয়। এরা ডিম দেয় সাধারণত বর্ষাকালে। ডিম ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রেখে ৮০-৯০ দিনে ইনকিউবেটরে বাচ্চা ফোটানো হয়।

গতকাল সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, কুমিরের এ খামারটি নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের কাছাকাছি ঘুমধুম পাহাড়ি এলাকার তুমব্রু গ্রামে অবস্থিত। এ গ্রামটি মিয়ানমার সীমান্তের খুবই কাছাকাছি। খামারের পাহাড় থেকে দেখা যায় মিয়ানমারও। বর্তমানে ওই খামারে কাজ করছেন দুজন প্রকল্প কর্মকর্তার অধীনে ২০ জন কর্মচারি। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই এ ওয়াইল্ড লাইফ ফার্ম থেকে ৪ শতাধিক কুমির মালয়েশিয়ায় রফতানি হতে যাচ্ছে বলে জানায় খামারটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। বর্তমানে খামারটিতে বাচ্চাসহ ছোট-বড় কুমিরের সংখ্যা ৩ হাজার ৪০০টি। খামারে উন্মুক্ত জলাশয় ও খাঁচার ভেতরে-দুইভাবেই কুমিরগুলোকে রাখা হয়েছে।
কুমির প্রকল্পের অ্যাডভাইজার ঝুলন কান্তি দে দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে চার শতাধিক কুমির মালয়েশিয়ায় রফতানির টার্গেট রয়েছে। এসব কুমির রফতানি করলে ৪০০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, কুমিরের প্রজনন মৌসুম এপ্রিল-মে মাস অর্থাৎ বর্ষাকালে। প্রজননের এক সপ্তাহের মধ্যে ডিম দেয়। প্রাপ্তবয়স্ক একটি কুমির গড়ে ৪০-৮০টি ডিম দেয়। ডিম সংগ্রহ করে রাখা হয় আন্তর্জাতিক মানের ইনকিউবেটরে। কারণ বাচ্চা ফোটানোর জন্য আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে সময় লাগে ৮০-৮৫ দিন। ডিম ফুটে কী কুমির জন্ম হবে তা নির্ভর করে তাপমাত্রার উপর। তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রির বেশি হলে পুরুষ বাচ্চা হওয়ার সম্ভবনাই বেশি। ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হওয়ার পর কিছুদিন ছোট ছোট হাউসে রাখা হয়। যেগুলোকে ধাপে ধাপে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে হ্যাচারিতে স্থানান্তর করা হয়। কয়েক মাস পরিচর্যা করার পর বাচ্চাদের পৃথক পৃথক পুকুরে স্থানান্তর করা হয়। নিয়মিত পরিচর্যায় ৩-৪ বছরেই চামড়া সংগ্রহ করার উপযুক্ত হয়। কুমিরের রোগবালাই নেই বললেই চলে। কুমিরের ছোট বাচ্চাদের প্রতিদিন খাবার দিতে হয়। বাচ্চাদের খাবার হিসেবে দেওয়া হয় মাংসের কিমা। আর বড় কুমিরের খাবার দেওয়া হয় সপ্তাহে একদিন। মুরগির মাংসের পাশাপাশি গরুর মাংস ও মাছ দেওয়া হয় খাবার হিসেবে। তিনি জানান, কুমিরের চামড়া বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আশা করা যায়, ২০২১-২০২২ সালে এখান থেকে প্রতি বছর ১ হাজার কুমিরের চামড়া রফতানি করা সম্ভব হবে। একেকটি কুমিরের চামড়া প্রকারভেদে ৪-৬শ ডলারে বিক্রি করা হয়। চামড়ার দাম নির্ভর করে আকৃতি ও গুণগত মানের ওপর। সরকারের অনুমতি পেলে দেশ-বিদেশের ফাইভস্টার হোটেলে কুমিরের মাংস বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব। তাছাড়া কুমিরের দাঁত, হাড়সহ অন্যান্য অংশ বিদেশে রফতানি করারও পরিকল্পনা রয়েছে খামার কর্তৃপক্ষের।

খামারের প্রকল্পের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আদনান আজাদ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বেশকিছুসংখ্যক কুমির বিদেশে রফতানির জন্য প্রস্তুুতি নেয়া হয়েছে। এসব কুমির বিদেশে রফতানি করা হলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে। তুমব্রু গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, কুমির খামারটি আমাদের তুমব্রু গ্রামের মতো অজোপাড়াগ্রামে গড়ে উঠায় স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের পথ সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে খামারটিতে ২০ জন কর্মচারী ও দুজন প্রকল্প কর্মকর্তা রয়েছেন। প্রতিদিনই খামারটি দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসে পর্যটকরা ভিড় জমাচ্ছেন। টেকনাফ থেকে কুমির দেখতে আসা দর্শনার্থী আরেফিন সিদ্দিকী তমাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের তুমব্রু এলাকায় কুমির চাষের একটি খামার গড়ে ওঠেছে বলে লোকমারফত শুনে খামারটি দেখতে এসেছি। স্বচক্ষে কুমিরের খামারটি দেখতে পেরে অনেক ভালো লেগেছে।

প্রাণিবিজ্ঞানীদের মতে, কুমিরের কোনো কিছুই ফেলনা নয়। কুমিরকে বলা হয় গোল্ড আয়রন অর্থাৎ সোনালি লোহা। এর প্রতি কেজি মাংস ৩০ ডলারে বিক্রি হয় বিদেশে। এর চামড়া বেশ দামি। ১ বর্গ সেন্টিমিটার চামড়ার মূল্য ১২ ডলার। চামড়া দিয়ে ব্যাগ, জুতাসহ অনেক মূল্যবান জিনিস তৈরি করা হয়। এ ছাড়া কুমিরের মাংস, হাড়, দাঁতও দামি। কুমিরের হাড় থেকে তৈরি হয় পারফিউম, দাঁত থেকে গয়না, পায়ের থাবা থেকে চাবির রিং তৈরী করা যায়। এ বিষয়ে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর উপ-পরিচালক রবীন্দ্র ঘোষ বলেন, কুমির রফতানি আশার আলো দেখাচ্ছে। এ খাত এগিয়ে নিতে কাজ করছে সরকার।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কুমির চাষ

৮ এপ্রিল, ২০২২
২৮ অক্টোবর, ২০২০
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ