পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
দলমত নির্বিশেষে তিনি ছিলেন আইনজীবীদের অভিভাবক। বটবৃক্ষের মতো সারাজীবন দিয়েছেন ছায়া। পেশায় তিনি ছিলেন দুঃসাহসিক আইনি যোদ্ধা। বিচারাঙ্গনে তিনি ছিলেন ‘আদালত-সহায়ক আইনজীবী’ কিংবা ‘আদালত-বন্ধু’ (অ্যামিকাস কিউরি)। পেশাদার আইনজীবীদের কাছে ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ‘স্যার’ এবং দীক্ষাগুরু। আইন ও বিচারাঙ্গনের তিনি বাতিঘর। জাতীয় সঙ্কট-সন্ধিক্ষণে তিনি ছিলেন আলোকবর্তিকা। রাজনীতিতে যিনি ছিলেন একাধারে সমালোচক এবং পথ নির্দেশক। নিজে আজীবন রাজনীতির বাইরে থাকলেও রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে যাকে দেখা গেছে দেশ ও জাতির প্রত্যাশার পাশে। সেই বর্ষীয়ান আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হক আর নেই। গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ৮টায় তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যায় ভুগছিলেন।
দেশের শীর্ষস্থানীয় এ আইনজীবীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ বিভিন্ন দফতরের মন্ত্রী-রাজনৈতিক দলের প্রধানগণ শোক প্রকাশ করেছেন। মরহুমের প্রতি প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
এদিকে বর্ষীয়ান এ আইনজীবীর মৃত্যুতে আইন ও বিচারাঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। মৃত্যুর সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আদ্-দ্বীন হাসপাতালে ভিড় জমাতে শুরু করেন আইনাঙ্গনের মানুষ ও সামাজিক সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যক্তিবর্গ।
সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর আদ্-দ্বীন হাসপাতাল জামে মসজিদে ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে মরহুমের লাশ নেয়া হয় তার পল্টনের বাসায়। সেখান থেকে দুপুর সোয়া ১২টায় লাশ নেয়া হয় বায়তুল মোকাররম মসজিদে। জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তার দ্বিতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে লাশ আনা হয় তার দীর্ঘদিনের কর্মক্ষেত্র সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে। সেখানে তৃতীয় নামাজে জানাজা শেষে বনানীর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
এর আগে রক্তশূন্যতা ও প্রস্রাবের সমস্যাসহ বার্ধক্যজনিত জটিলতা দেখা দেয়ায় গত ১৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় মগবাজারের আদ্-দ্বীন হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ব্যারিস্টার রফিক উল হককে। কিন্তু গত ১৭ অক্টোবর তিনি কিছুটা সুস্থবোধ করলে সকালের দিকে রিলিজ নিয়ে বাসায় ফিরে যান। ওইদিন দুপুরের পরপরই ফের তাকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। চিকিৎসকরা জানান, রক্তশূন্যতা, ইউরিন সমস্যাসহ বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ভুগছিলেন প্রবীণ এ আইনজীবী। তিনি ডা. রিচমন্ড রোল্যান্ড গোমেজের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এর আগে গত জুনে ডায়াবেটিকের পরিমাণ কমে যাওয়ায় শারীরিক অবস্থার অবণতি হলে তখনও আদ্-দ্বীন হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণে ছিলেন। তখন তিনি পল্টনের বাসায় অবস্থান করেই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন। ২০১৭ সালে বাম পায়ের হাঁটুতে অস্ত্রোপচারের পর থেকে তার চলাফেরা সীমিত হয়ে পড়ে। এ কারণে গত ৩ বছর ধরে তিনি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছিলেন না।
প্রসঙ্গত: রাজনৈতিক বিভাজনের এই যুগে ব্যারিস্টার রফিক উল হক ছিলেন অবিভাজ্য। বর্তমান দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দীর্ঘ দিন ধরে একে অন্যের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। এ সময়েও ব্যারিস্টার রফিক উল হক ছিলেন দুই পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য। তিনি একাধারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবী হিসেবে উচ্চ আদালতে আইনি লড়াই চালান। ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সরকারামলে রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতিতে একমাত্র তিনিই ছিলেন সরব, সক্রিয় এবং সাহসী আইনজীবী। শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার তৎকালিন বন্দিত্বকে তিনিই উচ্চ আদালতে প্রথম চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। শেখ হাসিনার জামিন হয় তারই শুনানিতে। এর আগে এরশাদ সরকারামলে ব্যারিস্টার রফিক উল হক ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষেও তিনি আইনি লড়াই করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সঙ্গেও কাজ করেছেন তিনি। আইনাঙ্গনের লড়াকু যোদ্ধা ব্যারিস্টার রফিক উল হক ছিলেন সকল রাজনৈতিক সংকটকালিন ন্যায়ের পক্ষে এক সাহসী যোদ্ধা। এ কারণে দলমত নির্বিশেষে তার তৈরি হয় তার গ্রহণযোগ্যতা। তবে সময় সময় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার সমালোচনা করতেও পিছ পা হননি তিনি।
সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্তে জানাযায়, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ১৯৩৫ সালের ২ নভেম্বর কলকাতার সুবর্ণপুর গ্রামে জন্ম নেন। তিনি ১৯৫৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, ১৯৫৭ সালে দর্শন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৮ সালে এলএলবি পাস করেন। ১৯৬২ সালে যুক্তরাজ্য থেকে বার এট ল’ সম্পন্ন করেন তিনি। ১৯৬৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে এবং ১৯৭৩ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে আইন পেশা শুরু করেন । ৬ দশকের বর্ণাঢ্য আইন পেশায় তিনি সব সময়ই ছিলেন স্রোতের বিপরীতে। ২০০৭ সালে তিনি দুই নেত্রীর মুক্তি তথা গণতন্ত্রের পক্ষে আইনি লড়াইয়ে নামেন। একই সঙ্গে গণমাধ্যমেও সরব হন। পরবর্তীতে আওয়ামলী লীগ এবং বিএনপি’র পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানে সংলাপ-সমঝোতার আহ্বান জানান। ক্রান্তিলগ্নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক নানা বিষয়ে পরামর্শ দিতেন।
মরহুম ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের সামাজিক পরিচয় ছিল আইনের প্রাজ্ঞ বিচারক হিসেবে। একজন মানবতাবাদী আইনজীবী হিসেবেও তার বিশেষ খ্যাতি ছিল। সবকিছুকে ছাপিয়ে ‘মানবিক ব্যারিস্টার রফিক উল হক’র পরিচয়ও কম ঔজ্জ্বল্য পায়নি। তিনি জীবনের আয়ের সিংহভাগ ব্যয় করেছেন মানুষের কল্যাণে। তার কাজ ও ভাবনায় একটি সমৃদ্ধ ও স্নিগ্ধ রুচীর ছাপ মেলে। আইন পেশার বাইরে তাকে দেখা গেছে দেশ ও জাতির কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একজন মানবিক মানুষ হিসেবে। ক্যান্সার হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ, মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, দাতব্য প্রতিষ্ঠানসহ অন্তত ২৫টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। আদ্-দ্বীন হাসপাতালের তিনি ছিলেন ট্রাস্টি। আইন পেশা থেকে লব্ধ অর্থ তিনি ব্যয় করতেন রোগাক্রান্ত ও আর্ত মানবতার সেবায়। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ১শ’ শয্যার হাসপাতালটি এখনও নির্মাণাধীন। ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন সুবর্ণ ক্লিনিক। ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায়ও ভূমিকা রাখেন তিনি। বারডেম হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ ও নূরজাহান ওয়ার্ড, আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালের চেয়ারম্যান, আদ্-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ট্রাস্টির ছিলেন রফিক-উল হক। নিজের উপার্জিত আয় উজার করে নিজে বেছে নেন সাদাসিধে জীবন। তার স্ত্রী ডা. ফরিদা হকের মৃত্যুর পর তিনি অনেকটাই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। সময় কাটতো ঢাকার পুরোনা পল্টনস্থ বৃক্ষ-ছায়া সুনিবিড় দোতলা বাড়িতে।
সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্তে জানা যায়, ব্যারিস্টার রফিক উল হকের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২ নভেম্বর। তৎকালিন অবিভক্ত ভারতের কলকাতার সুবর্ণপুর গ্রামে। পিতা-মমিনুল হক পেশায় ছিলেন ডাক্তার। মা নূরজাহান বেগম গৃহিণী। ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯৫১ সালে। ১৯৫৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং ১৯৫৭ সালে দর্শন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। ১৯৫৮ সালে এলএলবি পাস করেন। আইনজীবী হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশা শুরু করেন। ১৯৬২ সালে যুক্তরাজ্য থেকে ব্যারিস্টারি সম্পন্ন করে চলে আসেন তৎকালীন পাকিস্তানের বাংলাদেশ ভূখন্ডে। বসবাস শুরু করেন ঢাকায়। ১৯৬৫ সালে পূর্ব-পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট বারের আইনজীবী এবং ১৯৭৩ সালে আপিল বিভাগে সিনিয়র অ্যাডভোকেট হিসেবে যোগ দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফৌজদারি আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। রফিক-উল হক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পরীক্ষক ছিলেন।
নিজে রাজনীতির বাইরে থেকেও ক্রান্তিলগ্নে বিভিন্ন বিষয়ে তিনি অগ্নিগর্ভ মন্তব্য করেন। ২০১৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের সময় বহিরাগতরা সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে প্রবেশ করে হামলা চালালে তিনি বলেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের জানাজা হয়ে গেছে। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি বলেছিলেন, আদালত হাওয়া বুঝে রায় দেন। এসব মন্তব্য তখন ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়।
ব্যারিস্টার রফিক উল হকের ইন্তেকালে পৃথক বিবৃতিতে শোক জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ.ম. রেজাউল করিম, রেলমন্ত্রী অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম সুজন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু, সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এম. আমীর উল ইসলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদসহ সিনিয়র আইনজীবী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ। এছাড়া বিএনপি’র চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি.এম. কাদের, বিকল্প ধারার বাংলাদেশ’র চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, ‘নাগরিক ঐক্য’র আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)র চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থ, ইসলামী আন্দোলন’র আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম, খেলাফত মজলিস’র আমীর মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক ও মহাপচিলক ড. আহমদ আবদুল কাদের, বাতিল প্রতিরোধ পরিষদ’র সভাপতি হাজী জালালউদ্দিন বকুল প্রমুখ ব্যারিস্টার রফিক উল হকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন। শোকবাণীতে তারা জানান, ব্যারিস্টার রফিক উল হকের মৃত্যুতে জাতীয় অভিভাবকত্বের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। জাতি একজন অভিভাবককে হারাল। অপূরণীয় এক শূন্যতার সৃষ্টি হলো।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।