পোশাক রপ্তানিতে উৎসে কর ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব
আগামী পাঁচ বছরের জন্য তৈরি পোশাক রপ্তানির বিপরীতে প্রযোজ্য উৎসে করহার ১ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে পোশাক খাতের দুই সংগঠন
শামসুল হক শারেক, কক্সবাজার অফিস : লবণ ছাড়া কোন খাবারই চলে না। সাম্প্রতিক সময়ে ইন্ডাস্ট্রিতেও ব্যাপকহারে ব্যবহৃত হয়ে আসছে লবণ। লবণের প্রয়োজনীয়তা মানুষের জীবনে অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। লবণের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে অতীতে নানাভাবে লবণ উৎপাদনের কাজ হয়েছে। যেমন লোনাপানি সিদ্ধ করে তৈরী করা হতো লবণ। সীমিত আকারে জমি চাষ করেও লবণ উৎপাদন করা হয়। কালক্রমে জনসংখ্যা ও ইন্ডাস্ট্রি বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে লবণেরও চাহিদা বেড়ে যায়। দেখা দেয় ব্যাপক আকারে লবণ চাষের প্রয়োজনীয়তা। শতাব্দীকাল থেকে লবণ উৎপাদনে ভূমিকা রেখে আসছেন কক্সবাজার উপকূলের মানুষ। কক্সবাজারের লবণ চাষীরা আজ সফল। বলতে গেলে জেলার লবণ বিপ্লব ঘটেছে। কক্সবাজারে উৎপাদিত লবণ দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানীর সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। লবণ একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ খাত হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। পাশাপাশি সরকারের লবণ আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রশংসিত হয়েছে সর্বত্র।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশে কক্সবাজার জেলার উখিয়া ছাড়া ৭ উপজেলা এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালীতেই রয়েছে লবণ উৎপাদন উপযোগী জমি। এই জমির পরিমাণ বিসিকের হিসেব মতে ৯৪ হাজার একর হলেও বাস্তবে এর পরিমাণ দুই লাখ একরের কাছাকাছি। রোদ বৃষ্টিতে হাঁড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে হাজার হাজার চাষী লবণ উৎপাদন ও লবণ খাতে দেশকে স্বনির্ভর করতে চেষ্টা চালিয়ে আসছে যুগের পর যুগ। দেশে উৎপাদিত লবণ দিয়েই দেশের প্রয়োজন মেটানো গেলে বিদেশ থেকে লবণ আমদানির প্রয়োজন হয়না। এতে দেশ লবণ খাতে হবে স্বনির্ভর। কিন্তু ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রিক কয়েকটি সিন্ডিকেট সরকারকে ভুল বুঝিয়ে এবং দেশে কৃত্রিম লবণ সংকট দেখিয়ে ভারত থেকে লবণ আমদানি করে আসছিল প্রতিবছর। এতে নিজেরা লাভবান হলেও দেশের স্বনির্ভর লবণ খাতকে বিপর্যস্ত করে রাখে তারা। চলতি লবণ মৌসুমে সরকার বিষয়টি শক্ত হাতে হেন্ডেল করে লবণ আমদানি বন্ধ ঘোষণা করে। এতেকরে এপর্যন্ত সেই সুবিধা ভোগী সিন্ডেকেট সফল হয়নি। এতে উৎসাহিত হয়েছে লবণ চাষীরা।
দেখা গেছে, গত কয়বছর লবণের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে চাষীরা লবণ চাষ ছেড়ে দিয়েছিল। চলতি মৌসুমে সরকারের লবণ আমদানি বন্ধ ঘোষণায় খুশী হয়েছে কক্সবাজারের লবণ চাষীরা। নতুন উদ্দম ও প্রেরণায় মাঠে নেমেছে প্রায় ৫০ হাজার লবণ চাষী। মৌসুমের এই পর্যন্ত তারা সফল হয়েছে। এই পর্যন্ত যে পরিমাণ লবণ উৎপাদন হয়েছে এতে ধরে নেয়াযায় মৌসুমের বাকি সময় আবহাওয়া অনুকূল থাকলে লক্ষমাত্রার দ্বিগুণ লবণ উৎপাদন হতে পারে। তাতে অমদানির প্রয়োজন তো হবেই না বরং উদ্বৃত্ত লবণ রপ্তানী করা যাবে। তবে একাধিক চোরাচালান সিন্ডিকেট কৌশলে লবণ আমদানির ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে বলেও জানা গেছে।
বিসিকের কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আবসার উদ্দিন জানান, চলতি লবণ মৌসুমে ৬০ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে। এতে ৪০ হাজার চাষী লবণ উৎপাদনে নেমেছে। তিনি আরো জানান, গত বছর ১৬ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এবারে প্রায় ১৮ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদনের টার্গেট নিয়ে চাষীরা মাঠে নেমেছে। এপর্যন্ত দুই লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হয়েছে বলেও তিনি জানান। প্রতিদিন গড়ে যে পরিমাণ লবণ উৎপাদন হচ্ছে এতে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে সার্ফেলাস লবণ উৎপাদন হতে পারে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
জানা গেছে, জেলা প্রশাসক আলী হোসেন লবণ উৎপাদনের বিষয়টি নিয়মিত মনিটরিং করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে লবণ চাষীদের কল্যাণে বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়, জনপ্রতিনিধি ও লবণ চাষী সমন্বয়ে একাধিক সভা হয়েছে। এতে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে যথাযথভাব তদারকী ও চাষীদের সহায়তা দানের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয় বলে জানা গেছে।
এদিকে কুতুবদিয়া, হেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া-রাজাখালী ও টেকাফের মাঠে দেখা যাচ্ছে ধবধবে সাদা লবণের ছড়াছড়ি। এখন চাষীরা মাঠে প্রতিমণ সাদা লবণের মূল্য পাচ্ছে ৩ শত পঞ্চাশ টাকা থেকে ৪ শত টাকা। এতে তারা বেজায় খুশী। সরকারের লবণ আমদানি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তে লবণ চাষীরা সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। পাশাপাশি লবণ আমদানিকারক চক্রগুলোর চক্রান্ত এখনো থামেনি বলে জানিয়ে তা বন্ধ করার দাবী জানান তারা।
লবণের ব্যাপক চাহিদার কারণে উৎপাদিত লবণ পরিশোধন ও বাজারজাতকরণের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে অন্তত ৩৬০টি লবণ মিল-কারখানা। এসব মিলের মধ্যে শুধু কক্সবাজার সদরের বিসিক শিল্প নগরী ইসলামপুর কেন্দ্রিক ৪০ মিলসহ জেলায় ছোট বড় মিলে গড়ে উঠেছে অন্তত ৫০টি লবণ কারখানা। এ পেশায় সম্পৃক্ত রয়েছে অন্তত ৫ লক্ষাধিক কৃষক ও ব্যবসায়ী পরিবার। কিন্তু উৎপাদিত লবণ ও লবণের মিল-কারখানাগুলো দেশের ৬টি রাঘব বোয়াল মিলারের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে বলে তাদের অভিযোগ। সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না কৃষকের রক্তঝরা ঘামের। এ কারণে কৃষকেরা লবণ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। ফলে বিদেশে রপ্তানীযোগ্য এ লবণ আজ মৃতপ্রায়। বেকার ও কর্মহীন হয়ে পড়েছে অন্তত ১০ লাখ শ্রমিক। তাছাড়া ‘লালফিতায় বন্দি’ রয়ে গেছে সরকারের গৃহীত ‘লবণনীতিমালা’ও।
বিসিকের হিসাব মতে, প্রতি কেজি লবণে আয়োডিন প্রয়োজন হয় .০৯ গ্রাম। প্রতি কেজি ৪ হাজার ৭০০ টাকা হিসাবে এর দাম পড়ে ৪২ পয়সা। এর সঙ্গে বিদ্যুৎ, শ্রমিক, প্যাকেজিংসহ আনুষঙ্গিক খরচ পড়ে সর্বোচ্চ ২ টাকা ৫০ পয়সা। সব মিলিয়ে এক কেজি প্যাকেটজাত লবণ উৎপাদনে খরচ হয় সর্বোচ্চ ৭ টাকা। কোম্পানী ভেদে এ খরচ আরো কম। যদিও বা খরচ আরো কিছুটা বেশি বলে হিসাব দিচ্ছে ট্যারিফ কমিশন।
২০১০-১১ সালের দিকে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে বলা হয়, উৎপাদন থেকে শুরু করে আয়োডিন মেশানো, প্যাকেজিং ও আনুষঙ্গিক খরচ হিসাব করলে প্রতি কেজি লবণের দাম ৮ টাকার বেশি হওয়ার যৌক্তিকতা নেই। তার পরও তা ৩০-৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে আয়োডিনের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি হলেও স্থানীয় বাজারে লবণের দামকে সহনীয় রাখতে এক্ষেত্রে ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার।
বিসিকের হিসাবে, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতি কেজি আয়োডিন কেনা হচ্ছে ৬ হাজার ৩শ’ টাকায়। সরকার ভর্তুকি দিয়ে তা ৪ হাজার ৭শ’ টাকায় মিল মালিকদের কাছে বিক্রি করছে। এতে কেজি প্রতি আয়োডিনে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে ১৬শ’ টাকা।
বিসিকের প্রকল্প পরিচালক আবু হাতের খান জানান, পুষ্টিমান বাড়াতে লবণে আয়োডিন মেশানো হয়। কিন্তু আয়োডিণযুক্ত লবণের দাম বেশি হওয়ায় দেশের অধিকাংশ দরিদ্র মানুষ এ লবণ কিনতে পারে না। এতে সরকার ভর্তুকি দিলেও তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে কম।
অভিযোগ রয়েছে, ৩ টাকার লবণ ৩০ টাকায় বিক্রি করে দেশের ১৬ কোটি মানুষের পকেট কাটছে একটি অসাধু সিন্ডিকেট। গরীব অসহায় লবণ চাষাদের বঞ্চিত করে কেজিপ্রতি এতো বিরাট অংক হাতিয়ে নিচ্ছে একটি সিন্ডিকেট। এবারে মাঠে লবণের দাম বাড়ায় খুশী নয় ওই সিন্ডিকেট।
এদিকে নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত দামে লবণ বিক্রির দায়ে গত বছরের এপ্রিলে পাঁচটি কোম্পানির আমদানি সনদ বাতিল করে সরকার। সনদ বাতিলের আগে মন্ত্রণালয় থেকে নোটিস করা হলেও কোম্পানিগুলো কোনো জবাব দেয়নি বলে জানা গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো এসিআই সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ইউনাইটেড সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, পূবালী ভ্যাকুয়াম ইভ্যাপোরেটেড সল্ট প্ল্যান্ট, ডায়ানা ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড ও মোল্লা সল্ট (ট্রিপল রিফাইন্ড) ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।
কক্সবাজার লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি ও ইসলামপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাস্টার আব্দুল কাদের বলেন, সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও একটি অসাধু চক্র বিসিকের দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তার যোগসাজসে লবণ আমদানি করছে। ফলে দেশীয় লবণ মাঠে মার খাচ্ছে। অনুৎসাহিত হয়ে পড়েছে কৃষকেরা। একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে লবণ মিলসমূহ। ইতিমধ্যে কক্সবাজারের ১৫টি মিলসহ বন্ধ হয়ে গেছে শতাধিক লবণমিল। তিনি বলেন, দেশের ৩৬০ লবণমিল ও ১৬ কোটি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে লবণ খাতে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। ৬ মিল মালিকের কাছে মানুষ জিম্মি হয়ে গেলে জনগণকে অদূর ভবিষ্যতে আরো চড়া দামে লবণ কিনতে হবে। তাছাড়া সস্তা লবণ অতিরিক্ত দামে কিনতে হওয়ায় ভোক্তারা সরকারের উপর ক্ষীপ্ত হচ্ছে। এ জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
এদিকে কক্সবাজার সদরের এমপি সাইমুম সরওয়ার কমল এ প্রসঙ্গে বলেন, গোটা দেশে লবণ সরবরাহ করছে কক্সবাজারের চাষী। তারা যাতে লবণের ন্যায্যমূল্য পায় এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজর রয়েছে। তাই এই মৌসুমে লবণ আমদানির অনুমতি দেয়নি সরকার। এতে করে লবণ চাষীরা ন্যয্যমূল্য পাচ্ছে। তবে এই সুযোগে অস্বাভাবিক মূল্য বাড়ানোও অন্যায্য বলে মনে করেন তিনি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।