Inqilab Logo

মঙ্গলবার ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দ্বীনি শিক্ষা ও ইসলামের অতন্দ্র প্রহরী বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন

প্রকাশের সময় : ১২ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী
 (৩০ জুলাই প্রকাশিতের পর)
॥ দুই ॥
কোরআনে ফিতনা সৃষ্টিকে হত্যার চেয়ে মারাত্মক পাপ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বলা হয়েছে ‘আল ফিতনাতু আশাদ্দু মিনাল কাতলি’। আয়াতে বর্ণিত দুইটি শব্দ ফিতনা ও কতল খুবই পরিচিত। কতল সহজবোধগম্য শব্দ-খুন করা, হত্যা করা। কাতেল বলা হয় খুনী বা হত্যাকারীকে এবং মকতুল বলা হয় নিহতকে। রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি হাদিসে কাতেল ও মকতুল (হত্যাকারী ও নিহত)-এর পরিণতির কথা উল্লেখ করেছেন। একটি ঘটনা প্রসঙ্গ তিনি হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি দুই জনকেই জাহান্নামী বলে আখ্যায়িত করেছেন। ওই ঘটনায় নিহত ব্যক্তির জাহান্নামী হওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন যে, নিহত ব্যক্তি প্রাণে রক্ষা পেলে সেও হত্যাকারীকে হত্যা করার মানসিকতা পোষণ করতো।
অন্যায়ভাবে যে কোনো মানুষকে হত্যা করা মহাপাপ। হত্যাকারীর পরিণাম জাহান্নাম। কোরআনে বলা হয়েছে, হত্যার চেয়ে জঘন্য হলো- ফিতনা সৃষ্টি করা। হত্যাকারীর চেয়েও কঠিন শাস্তি হবে ফিতনা সৃষ্টিকারীর। ফিতনা শব্দের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আছে। এর সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা না করেও বলা যায়, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি ইত্যাদিকে ফ্যাসাদও বলা হয়। যার উল্লেখ কোরআনের বহু রয়েছে। কাজেই ফিতনা, ফ্যাসাদ একই সাথে ব্যবহার করা হলে দুইটি শব্দই সমর্থকের পর্যায়ে এসে যায়। জায়গায় যদিও দুইটির মধ্যে তফাত বিদ্যমান। ফিতনা সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যাপক গোলযোগ, অরাজকতা এমনকি হত্যা, খুন তথা রক্তপাতের আশঙ্কাও থাকে অধিক। সুতরাং ফিতনা সৃষ্টিকারী যদি খুনী হয় তাহলে তার শাস্তিও হবে ডবল ফিতনা সৃষ্টিকারী ও খুনী হিসেবে। বর্তমান সন্ত্রাস ও জঙ্গি তৎপরতা এ ফিতনারই অংশ। সুতরাং, এর মূলে আঘাত করা না গেলে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূল করা সম্ভব হবে না। বর্তমানে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিষয়টি বহু আলোচনা-বিতর্কের ঝড় তুলেছে এবং সন্ত্রাসী-জঙ্গিদের যেসব পরিচয়-বিবরণ সামনে উঠে আসছে তাতে নানা জনের নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও অভিমতও প্রকাশ পাচ্ছে। ওরা ধর্মান্ধ-বিপথগামী বলেও আখ্যায়িত হচ্ছে। ইসলামদ্রোহী তাগুতী শক্তিগুলো মুসলমানদের হাতে অতীতের পরাজয়ের গ্লানি কখনো ভুলতে পারেনি। বিশেষত প্রধান ক্রসেডগুলোতে মুসলমানদের নিকট তাদের শোচনীয় পরাজয়ের প্রতিশোধ স্পষ্ট হয় নতুনভাবে মুসলিম বিদ্বেষকে উজ্জীবিত করা থেকে এবং তারা রণাঙ্গনের রণকৌশলে নবায়ন করে ভিন্ন উপায় অবলম্বন করেছে। আর তা হচ্ছে, ইসলামকে বিকৃত করার এবং ইসলামের নানা বিষয়ে (মৌলিকসহ) সংশ্রয় সৃষ্টি করা। এ ব্যাপারে তারা ইহুদিদের পূর্ণ সমর্থন-সহযোগিতা সহজেই লাভ করেছে। কেননা এক্ষেত্রে ইহুদিরা পূর্ব থেকেই সক্রিয় ছিল এবং ইসলামের বিরুদ্ধে লাখ লাখ প্রচারপত্র ও বইপুস্তক ছেপে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের প্রচার মাধ্যমগুলো তো অহরহ ইসলামবিদ্বেষ প্রচারণায় লিপ্ত। ইহুদিদের ইসলামবিরোধী এ প্রচারণার জাল ইসলামবিদ্বেষী পরাশক্তিগুলোর সহায়ক উৎস হিসেবে কাজ করেছে এবং তাদের কৌশল বিনির্মাণের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
বর্তমান শতকের গোড়ার দিকের কথা। বুশ-ব্লেয়ারের ষড়যন্ত্রমূলক ইরাক ধ্বংস পরিকল্পনা (যা পূর্ব হতেই গ্রহীত হতে থাকে) বাস্তবায়িত হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি ভিন্ন রূপ ধারণ করে। বুশ-ব্লেয়ারের ষড়যন্ত্র পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বহুজাতিক বাহিনী গঠনের আহ্বান জানানো হলে দেখা যায় মধ্যপ্রাচ্যসহ বহুদেশ তাতে শরীক হওয়ার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা আরম্ভ করে এবং আরব বিশ্বের কোনো কোনো দেশ তাদের উদারতার পরাকাষ্টা প্রদর্শন করে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। অর্থাৎ ইরাকে জঙ্গি হামলা পরিচালনার জন্য তাদের ভূমি ব্যবহারের অবাধ সুযোগ প্রদান করে অর্থাৎ সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে সেখান থেকে ইরাকের জঙ্গিবিমান হামলার মাধ্যমে লাখ লাখ টন বোমা নিক্ষেপ করা হয়। বুশ-ব্লেয়ারের জঙ্গি পরিকল্পনা সফল হয় এবং ইরাক ধ্বংসের মধ্যদিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে ইরাকে বুশ-ব্লেয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দৈনিক ইনকিলাব ও বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের নানামুখী ভূমিকা বিশেষ একটি মহলের গাত্রদাহের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল। জানা যায়, তখন ঢাকায় তাদের একটি বিশেষ সেল গঠিত হয়েছিল কেবলমাত্র ইনকিলাবের ভূমিকা মনিটরিং করে আগ্রাসী শক্তির কেন্দ্রে রিপোর্ট করার জন্য। এ রিপোর্ট নিয়মিত প্রেরিত হতো। কথিত হয়ে থাকে যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন পুকুরের মাছ যারা অন্ধকার রাতে বিষ প্রয়োগে হত্যা শুরু করেছিল তারা এ মহলের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল এবং তারা আমদানি করা তথাকথিত ‘শির্ক’ বিরোধী মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পুকুরে ‘মৎস্য নিধন’ অভিযান শুরু করেছিল যা সরকারের হস্তক্ষেপে প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছিল। তখন পুকুরে মৎস্য নিধনকে ধর্মান্ধতা আখ্যায়িত করা হতে থাকে।
ধর্মান্ধতা সম্পর্কে বলতে গেলে এ কথাও বলতে হয় যে, এ ধর্মান্ধতা সকল ধর্মেই বিদ্যমান। যেমন হিন্দু ধর্মের কথাই উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে। এ ধর্মে জাহেলি যুগের ন্যায় এখনো বহু কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার ব্যাপক প্রচলন পরিদৃষ্ট হয়। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক তাদের ‘গোমাতা’র কথাই ধরা যাক, তারা গোমাতার পূজা করে বলে ভারতের মুসলমানদের গরু কোরবানি করতে দেয়া হয় না। এটাকে তারা বলে ‘গোহত্যা’। এ সম্পর্কে অনেক কথা বলার থাকলেও আপাতত তা থেকে বিরত থাকলাম। ইহুদিদের মধ্যেও ধর্মান্ধতার কমতি নেই। খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদের কথা নাইবা বললাম, তবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের প্রথম দিকের ক্রুসেড ধর্মান্ধতাই সক্রিয় ছিল বলে নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক বিবরণ হতে জানা যায়। পরে বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের মুসলমানদের নিকট শোচনীয় পরাজয়ের গ্লানি কলঙ্কের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তারা রণকৌশল পরিবর্তন করে ইহুদিদের সাথে হাত মিলায় এবং ইসলামবিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে ইসলামের বিকৃতি, ভুল ব্যাখ্যা, অপপ্রচার এবং ইসলামকে সংশয়যুক্ত করার প্রচার-অভিযানে লিপ্ত হয়েছে বলে পূর্বে আভাস দেয়া হয়েছে। বস্তুত এ অভিযানের অংশ হিসেবে তারা মুসলমানদের বৃহত্তর ঐক্য বিনষ্টের নিমিত্তে পরস্পরবিরোধ, দ্বন্দ্ব-কলহ এমনকি মুসলমানদের মধ্যে পরস্পর যুদ্ধ-হানাহানি এবং রক্তপাত ঘটানোর নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে। ইসলামের বিকৃতি, ভুল ব্যাখ্যা এবং নানা বিষয়ে সংশয় সৃষ্টির অপপ্রয়াসে তারা লিপ্ত। তারা গণতন্ত্রের নামে, মানবতার নামে ভিন্ন পন্থায় মুসলমানদের শুভাকাক্সক্ষী রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। ইসলামী নামে বিভিন্ন দল সংগঠন সৃষ্টি করার নেপথ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আবার এক দলকে অপর দলের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে, লেলিয়ে দিয়ে ঘোলা পানিতে মৎস্য শিকারে আত্মনিয়োগ করেছে। বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের সরকার উৎখাতে এসব দল সংগঠনকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সর্বাত্মক মদদ জোগাচ্ছে। লিবিয়া-সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন আরব দেশের রক্তাক্ত করুণ পরিস্থিতি কী তারই কারণ নয়? শরণার্থী-অভিবাসী সমস্যা সৃষ্টির অন্তরালে এবং বিভিন্ন সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে হাজার হাজার অভিবাসীর সলিল সমাধি বরণের পর যারা প্রাণে বেঁচে বিভিন্ন অমুসলিম দেশে আশ্রয়প্রার্থী হচ্ছে তার সংখ্যা, অজানা হলেও বহু হবে। ওদেরকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দেশে সংকট যেমন দেখা দিয়েছে, নানা রকমের নাটকও চলছে এবং মানবতার প্রতি সহানুভূতি, সহমর্মিতা প্রদর্শনের প্রশংসনীয় উজ্জ্বল বহু দৃষ্টান্তের কথাও জানা যাচ্ছে। তবে এমন অভিযোগও রয়েছে যে, কোনো কোনো শরণার্থী-অভিবাসী আশ্রয় শিবিরে সুকৌশলে ধর্মান্তর ন্যক্কারজনক কাজও চলছে। ক্ষমতাধর শক্তিগুলোর ইশারা-ইঙ্গিতে বৈষয়িক তথা আর্থিক-সামরিক সাহায্য মদদে যেসব দল-সংগঠন ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের সংগ্রাম-আন্দোলনে মত্ত তাদের পরিচিতি সন্ধান করতে গেলে অদ্ভুত, বিস্ময়কর সব তথ্য বের হয়ে আসছে। ইসলামের বিকৃতি তথা ধর্মান্ধতা হচ্ছে সেগুলোর একটি।
আরো একটি ব্যাপার হচ্ছে এই যে, মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রতিক রক্তাক্ত ঘটনাবলীর পূর্বে সেখানে নাকি আরব বসন্তের সৃষ্টি হয়েছিল। পশ্চিমের গগন হতে প্রবাহিত মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে অনুভূত এ স্নিগ্ধ সুবাসে কোকিল-বুলবুলিদের কতদিন মুগ্ধ করে রেখেছিল তা জানা যায়নি। আন্দোলনের ¯্রােতে সম্ভবত সেই আরব বসন্ত ভেসে গিয়েছে। কেননা পরে সেই আরব বসন্তের কথা কারো মুখেই নেই।
যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জজ ডব্লিউ বুশের নাম স্মরণ করতে হয়। কেননা তাদের ইরাক বিজয় ছিল ইতিহাসের এক চাঞ্চল্যকর আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিস্ময়কর ঘটনা। আরব বসন্ত এর পরের ঘটনা। তাদের হাতে ইরাক ধ্বংস-পতনের এক যুগ পর চিলকটে যে ঐতিহাসিক রিপোর্ট সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেড় লাখ ইরাকি নিহত এবং প্রায় দশ লাখের বেশি ইরাকি বাস্তুহারা হওয়ার তথ্যের পাশাপাশি আরো এক তথ্য হচ্ছে সাদ্দাম হোসেনের বাথ পার্টির চাকরি হারানো প্রায় চার লাখ সেনা সদস্য এক পর্যায়ে ইসলামিক স্টেট (আইএস) গঠন করে। (চলমান)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন