পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
টিভি খুললেই টকশোতে শোনা যেত তার দরাজ কণ্ঠ। ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণে সরকারকে উপদেশ দেন। নিজেকে সৎ নীতিবান হিসেবে জাহির করে জাতিকে জ্ঞানদান করেন। প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে তার ছিল নিত্য ওঠাবসা। স্যাটেলাইট টিভির বদৌলতে রাতারাতি হয়ে ওঠেন দেশের বুদ্ধিজীবী। প্রভাবশালী রাজনীতিকদের অন্দরমহল ছিল তার নখদর্পণে। আদালতের ভাষায় ‘ভদ্রবেশী অপরাধী’ এবং সাধারণ মানুষের ভাষায় ‘ভয়ঙ্কর প্রতারক’ সাহেদ করিম ওরফে মো. সাহেদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছে।
গতকাল অস্ত্র মামলায় রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ করিমকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। ঢাকার এক নম্বর মহানগর স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের বিচারক কেএম ইমরুল কায়েশ এ রায় ঘোষণা করেন। এ ছাড়াও সাহেদ করিমের বিরুদ্ধে আরো কয়েকটি মামলার বিচার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তদন্ত চলছে কয়েকটি মামলার। রায় ঘোষণার পর সাহেদ বলেন, ‘আমি ন্যায় বিচার পাইনি’, হাইকোর্টে অপিল করবো।
ঢাকার এক নম্বর মহানগর স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামলায় সাহেদকে ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইনের ১৯(ক) ধারায় যাবজ্জীবন ও (চ) ধারায় ৭ বছরের কারাদন্ড দেন। দুটি সাজা একত্রে চলবে বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া ওই অস্ত্র বাজেয়াপ্ত ও যে গাড়ি থেকে অস্ত্রটি উদ্ধার করা হয়েছে, তার মালিকানা যাচাই করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। গত ২৭ আগস্ট এই মামলায় অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন আদালত। এরপর ওই দিনই এই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ১০ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেন আদালত। এরপর গত ১০ সেপ্টেম্বর মামলার বাদী গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের পরিদর্শক এসএম গাফফারুল আলমের জবানবন্দির মধ্য দিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
মামলাটির রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১৪ জনের মধ্যে ১১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। এরপর আসামির আত্মপক্ষ সমর্থন ও উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ২০ সেপ্টেম্বর মামলার বিচার কাজ শেষ হয়। ওই দিন ২৮ সেপ্টেম্বর রায়ের দিন ধার্য করা হয়।
রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মোহাম্মদ সাহেদ করিম বিলাসবহুল পাজেরো গাড়ি হাঁকিয়ে চলতেন। সমাজের উপর তলায় চলাফেরা করায় গাড়িতে ভিভিআইপি ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড, সাইরেনযুক্ত হর্ন ব্যবহার করতেন। গাড়ির আগে-পিছে আরো দুই গাড়িতে অবৈধ ওয়ারল্যাস সেট আর অস্ত্রসহ প্রহরায় থাকত দেহরক্ষীরা। ভিআইপি প্রতারক সাহেদ প্রভাবশালীদের হাত করেই এ কার্যক্রম চালিয়েছেন। রিজেন্ট হাসপাতাল বন্ধের পর পর্যায়ক্রমে তার উত্থানের কাহিনী বের হয়ে আসে।
আওয়ামী লীগের প্রবাসী বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য সাহেদকে করোনার জাল সার্টিফিকেট ব্যবসা করার প্রতারণায় ১৫ জুলাই সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। আলোচিত এই সাহেদ টিভির বুদ্ধিজীবী হয়ে চালাতেন তদবির-বাণিজ্য। আগে প্রতারণার অভিযোগে দুইবার জেল খেটেছেন। করোনাভাইরাস মহামারীতে তার মালিকানাধীন রিজেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার নামে ভয়াবহ প্রতারণা বাণিজ্যে মেতে ওঠেন ভয়ঙ্কর এই প্রতারক সাহেদ করিম। প্রশাসন ও সরকারের গুরুত্ব¡পূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে তার ছবি পুঁজি করে প্রতারণা, তদবির ও চাপাবাজির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার মালিক হন।
সাতক্ষীরার সিরাজুল করিমের ছেলে মোহাম্মদ সাহেদ নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। মাত্র এসএসসি পাস করেন তিনি। তবু নিজেকে আওয়ামী লীগ নেতা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক দাবি করতেন সাহেদ। বিগত ২০ বছর ধরে নানা প্রতারণা, ছলচাতুরি, বাটপারি করতেন।
আদালতে রায় ঘোষণার কিছুক্ষণ আগে সাহেদকে এজলাস কক্ষের কাঠগড়ায় তোলা হয়। এসময় তাকে স্বাভাবিক দেখা যায়। নিশ্চুপভাবে অনেকটা ভাবলেশহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে তিনি রায় শোনেন। এসময় ভেতরে তিনি কোনো কথা বলেননি বা প্রতিক্রিয়া দেখাননি। এ সময় ঢাকার এক নম্বর মহানগর স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের বিচারক কেএম ইমরুল কায়েশ রায় পড়া শুরু করেন। প্রথমে ১৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১ জনের দেয়া জবানবন্দির সারাংশ পড়ে শুনান বিচারক।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, আমাদের সমাজে সাহেদের মতো ভদ্রবেশী অপরাধীদের জন্য এই রায় একটি বার্তা। মামলার বাদীর জবানবন্দির বরাত দিয়ে আদালত বলেন, আসামি মাদক মামলায় হেফাজতে থাকা অবস্থায় তার স্বীকারোক্তি মতে উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথের পরিত্যক্ত গাড়ির পেছনের সিটের নিচ থেকে অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়। জব্দ তালিকার সাক্ষীও গাড়ি থেকে অস্ত্র উদ্ধারের কথা বলেছেন। পরে তদন্ত কর্মকর্তার অনুসন্ধানে উঠে আসে ওই গাড়িটি সাহেদ কিস্তিতে কিনেছিলেন। তিনি এতই চতুর যে অস্ত্রের কথা জানা সত্তে¡ও বিচার চলাকালে একবারও আদালতে তা স্বীকার করেননি।
আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেছেন, এই অস্ত্রটি সাহেদের মালিকানায় ছিল না; তিনি জানতেনও না। যে গাড়ি থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে তা সাহেদের নয়, এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। অথচ সাহেদ কিস্তিতে গাড়িটি কিনেছিলেন বলে তদন্তে প্রমাণিত হয়। তার কাছে চাবি নিয়েই তালাবদ্ধ গাড়ির তালা খুলে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। তাই এতে প্রমাণিত হয় অস্ত্র সম্পর্কে তিনি জানতেন ও তার মালিকানাধীন গাড়ি থেকেই তা উদ্ধার করা হয়। সুতরাং এখানে তার অস্ত্র সম্পর্কে জানা থাকা ও মালিকানার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। এছাড়া এই আসামি এতই ধুরন্ধর যে মালিকানার বিষয়টি তিনি কখনও আদালতে স্বীকার করেননি। তাই তিনি এখানে কোনো অনুকম্পা পেতে পারেন না। এরপর আদালত সাহেদের বিরুদ্ধে দন্ডের ঘোষণা করেন।
র্যাব গত ১৫ জুলাই সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে সাহেদকে গ্রেফতার করে। এরপর তাকে নিয়ে উত্তরায় অভিযান চালিয়ে অস্ত্র উদ্ধার করে সংস্থাটি। পরে উত্তরা পশ্চিম থানায় র্যাব অস্ত্র আইনে একটি মামলা দায়ের করে। দীর্ঘ তদন্তের পর ৩০ জুলাই ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখায় তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক মো. শায়রুল মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এরপর ১৩ আগস্ট মামলাটি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে বদলির আদেশ দেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জুলফিকার হায়াত।
রায় ঘোষণার পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) তাপস কুমার পাল বলেন, এই মামলায় আমরা রাষ্ট্রপক্ষে যাবতীয় সাক্ষ্যপ্রমাণ আদালতে তুলে ধরেছি। আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী আসামির সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছে।
সাহেদের প্রতিক্রিয়া : রায় ঘোষণার সময় সাহেদ করিম এজলাস কক্ষের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। রায় ঘোষণার পর দুপুর ২টা ১০ মিনিটে তাকে এজলাস কক্ষ থেকে বের করে আনা হয়। প্রিজনভ্যানে তোলার সময় এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে সাহেদ বলেন, ‘আমি ন্যায়বিচার পাইনি, হাইকোর্টে আপিল করবো’। সাহেদের আইনজীবী মনিরুজ্জামান রায়ের পর বলেন, দ্রুততার সঙ্গে মামলার বিচার চলার সময়ই আমাদের আশঙ্কা তৈরি হয়। যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায়ের মধ্যে দিয়ে সেই আশঙ্কাই সত্যি হলো। এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবো।
করোনা প্রতারণা : প্রতারক সাহেদের বিরুদ্ধে আরো ৩২টি মামলা রয়েছে। অথচ সে বুদ্ধিজীবী হিসেবে দেশের এলিট শ্রেণির সঙ্গে চলাফেরা করতেন। সাহেদের প্রতারক হয়ে ওঠার কাহিনী হলো, ২০১০ সালে ধানমন্ডি এলাকায় বিডিএস কিক ওয়ান এবং কর্মমুখী কর্মসংস্থান সোসাইটি (কেকেএস) নামে দুটি এমএলএম কোম্পানি খুলে গ্রাহকদের কাছ থেকে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এক সময় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে গা-ঢাকা দিলে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। ২০১১ সালে তাকে প্রতারণা মামলায় গ্রেফতার করা হয়। কয়েক মাস জেল খাটার পর সে জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে আসে। এরপর প্রতারণার অর্থ দিয়ে তিনি রিজেন্ট গ্রæপ নামে ব্যবসা শুরু করেন। চালু করেন রিজেন্ট হাসপাতাল।
বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। প্রথম মারা যায় ১৮ মার্চ। আর করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে সাহেদের উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতাল স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে যুক্ত হয় গত ২১ মার্চ। অথচ হাসপাতালটির অনুমোদনের মেয়াদ ২০১৪ সালেই শেষ হয়। অনুমোদনহীন একটা হাসপাতাল মহামারীর মতো সময়ে কী করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার তালিকাতে যুক্ত হলো তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
এ সময় স্বাস্থ্য অধিদফতর দাবি করে সারা দেশে করোনা আক্রান্তদের নমুনা সংগ্রহের জন্য ২৫টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেয়া হয়। সেই তালিকায় রিজেন্ট হাসপাতালের নাম নেই। অথচ রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক (এমইউ) সই এর খবর প্রকাশ পায়। কিন্তু শর্ত ভঙ্গ করে গত সাড়ে তিনমাসে প্রায় সাড়ে চার হাজার রোগীর করোনা টেস্ট করে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা নিয়েছেন। তারপর করোনা রোগীদের চিকিৎসা বাবদ এক কোটি ৯৬ লাখ টাকার বিল স্বাস্থ্য অধিদফতরে জমা দেয় রিজেন্ট হাসপাতাল। অধিদফতর হয়ে সেই বিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে প্রায় অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় ছিল। সে সময় প্রতারণা ধরা পড়ে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।