Inqilab Logo

রোববার, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

জঙ্গিমুক্ত দেশ গড়তে আমরা ঐক্যবদ্ধ

গুলশান-শোলাকিয়ায় নিহত ৪ পুলিশ পরিবারকে অনুদান অনুষ্ঠানে আইজিপি

প্রকাশের সময় : ১১ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : জঙ্গিদের স্থান এই বাংলার মাটিতে হবে না। পুলিশ জনগণসহ দেশের মানুষ জঙ্গি দমনে ঐক্যবদ্ধ। জঙ্গিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে প্রয়োজনে পুলিশ আরো কঠোর হবে।
গতকাল বুধবার পুলিশ সদর দফতরে রাজধানীর গুলশান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলায় নিহত চার পুলিশ সদস্যের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান অনুষ্ঠানে আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, যারা ভুল পথে গেছে, জঙ্গি পথে গেছে, তারা যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সহযোগিতা করবে। কোনো ডিস্টার্ব করবে না। তবে ‘তারা’ অতীতে কোনো অপরাধ করেলে তাদের বিষয় ‘ভিন্ন’। জঙ্গিবাদে জড়িতদের কোনো প্রকার ছাড় না দেওয়ার কথা পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘যারা জঙ্গি বিস্তারে কাজ করছে, এসব অশুভ শক্তিকে সম্মিলিতভাবে নির্মূল করা হবে। বাংলার মাটিতে জঙ্গিবাদের ঠাঁই নেই। যত ষড়যন্ত্রই হোক পুলিশ তৎপর আছে।
অনুষ্ঠানে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল ইসলাম বলেন, নিহত পুলিশ সদস্যরা আমাদেরকে ঋণী করে গেছেন। অনুদানের মাধ্যমে জীবনের মূল্য পরিশোধ করা যায় না। তবে আমরা দায়ের বোঝা কিছুটা কমাতে চেষ্টা করেছি। নিহতদের বাড়ির এলাকার সংশ্লিষ্ট এসপি পুলিশ সদস্যদের স্বজনদের খোঁজ নেবেন। তাদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য যা করার আমরা তাই করব।
সহকারী কমিশনার রবিউলের স্ত্রী সম্প্রতি একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছেন। তিনি এখনও হাসপাতালে ভর্তি। আইজিপি বলেন, ‘তিনি (রবিউলের স্ত্রী) সুস্থ হলে আমরা মধুমতি ব্যাংকে একটা চাকরির চেষ্টা করব।’
অতিরিক্ত আইজিপি মঈনুর রহমান চৌধুরী বলেন, পুলিশ এদেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছে। রক্ত দিয়ে এ দেশকে স্বাধীন করেছে। এবার জঙ্গি নির্মূল করতে রক্ত দিচ্ছে। নিজেদের জীবন দিয়ে এ দেশের মাটি থেকে জঙ্গিদের চিরতরে নির্মূল করবে। নিজেদের জীবন দেশের জন্য উৎসর্গ করে জাতিকে এমন বার্তাই দিয়ে গেছেন আমাদের বীর পুলিশ সদস্যরা।
গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর সেখানে অভিযানে গিয়ে প্রাণ হারান এসি রবিউল করিম ও ওসি মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। ছয় দিনের মাথায় শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতের কাছে জঙ্গি হামলায় মারা যান কনস্টেবল আনসারুল হক ও জহিরুল হক।
অনুষ্ঠানে তাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মা ও স্ত্রীকে সব মিলিয়ে ৯০ লাখ টাকার নগদ অর্থ ও সঞ্চয়পত্র তুলে দেওয়া হয়।
পুলিশের পক্ষ থেকে রবিউলের মা করিমন্নেছাকে ৫ লাখ ও স্ত্রী উম্মে সালমাকে ১৫ লাখ এবং সালাউদ্দিনের স্ত্রী রেমকিমকে ২০ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়।
এছাড়া আনসারুলের স্ত্রী নুরুন্নাহারকে ৫০ হাজার নগদসহ সাড়ে সাত লাখ ও মা রাবেয়া আক্তারকে ৫০ হাজার নগদসহ সাড়ে ৭ লাখ এবং জহিরুলের মা জোবায়দা খাতুনকে নগদ অর্থসহ ১৫ লাখ টাকার অনুদান দেওয়া হয়।
পাশাপাশি মধুমতি ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রত্যেক পরিবারকে ৫ লাখ টাকা করে মোট ২০ লাখ টাকার অনুদান দেওয়া হয়।
জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে। অন্য হাজারো মানুষ হয়ত প্রশংসা করছে। কিন্তু স্বজনরা? তাদের কেমন লাগে? বেশ কিছু দিন পেরিয়ে গেলেও চোখের জল যে বাধা মানে না। এই শোক কি ভোলার? অন্য কেউ কি বুঝতে পারবে বুকের ভেতর কতটা ব্যাথা পরিবারের সদস্যদের? বোঝার কথাও না। তবে যাদের সংবেদনশীলতা তুলনামূলক বেশি তারা কিছুটা হলেও বুঝতে পারেন প্রিয় মানুষ না থাকলে কেমন লাগে।
গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর জিম্মিদের বাঁচাতে গিয়েছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল করিম আর বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সালাহউদ্দিন আহমেদ। কিন্তু নিজের প্রাণ দিতে হয় তাদের।
কদিন যেতে না যেতেই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে জঙ্গি হামলার চেষ্টা ঠেকাতে গিয়ে প্রাণ দিলেন দুই কনস্টেবল আনসারুল হক ও জহিরুল ইসলাম। প্রাণ উৎসর্গ করা এই কর্মকর্তাদের জন্য গর্বের শেষ নেই পুলিশের। কিন্তু স্বজনরা? পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস ছিলেন অন্তত তিনজন। এখন পরিবারের সদস্যদের কী হবে? পাশে দাঁড়িয়েছে সরকার। ঈদের আগে কিছু সহায়তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এবার অনুদান দিলো পুলিশ।
পুলিশ সদর দফতরে আত্মদানকারী পুলিশ সদস্যদের স্বজনদের ডেকে এনে অনুদান তুলে দিলো পুলিশ। সেখানে ঝরে পড়লো অসংখ্য প্রশংসাবার্তা। কথা বললেন নিহত পুলিশ সদস্যদের স্বজনরাও। তাদের আবেগঘন বক্তব্য ছুঁয়ে যায় উপস্থিত পুলিশ সদস্য আর গণমাধ্যম কর্মীদেরও।

স্বজনরা বলেছেন, তাদের প্রিয়জন দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন এজন্য তারা গর্বিত। দেশের মানুষের নিরাপত্তার জন্য তাদের এই ত্যাগ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তবে এভাবে যেন আর কোনো মায়ের কোল খালি না হয় সে ব্যাপারে সবাইকে উদ্যোগ নিতে হবে।
নিহত পুলিশ কর্মকর্তা রবিউল করিমের ভাই শামসুজ্জামান শামস অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমার ভাইয়ের মৃত্যুর পরে আপনারা যারা আমাদের পাশে ছিলেন সবাইকে ধন্যবাদ। আপনাদের পোশাকের মাঝে আমার ভাইকে খুঁজে পাই। আপনাদের কাছে অনুরোধ, বিপথগামী যুবকদের আইনে আতওতায় এনে বিচারের ব্যবস্থা করুন। আর যেন কোনো মায়ের কোল খালি না হয় সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিন।’
সালাহউদ্দিন আহমেদের স্ত্রী রেমকিম বলেন, আপনারা যতদিন বাঁচবেন ততদিন তার জন্য দোয়া করবেন।
শোলাকিয়া হামলায় নিহত পুলিশ সদস্য আনসারুল হক ও জহিরুল ইসলামের পক্ষে কথা বলেন কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘পুলিশের যে সদস্যরা গুলশান এবং শোলাকিয়ায় কর্তব্য দেখিয়েছেন তা কখনো ভোলার নয়। তারা দায়িত্ব পালন না করলে জঙ্গিরা গ্রেনেড ছুড়তো এবং এতে হাজার হাজার লোক হতাহত হতো। তাদের সাহসিকতায় অনেক প্রাণ রক্ষা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘যে পুলিশ সদস্যরা প্রাণ দিয়েছেন তারা জাতীয় বীর।’ নিহত পুলিশ সদস্যদের তিনি বলেন, ‘আপনারা একা নন, আমরা আপনাদের পাশে আছি। প্রধানমন্ত্রী আপনাদের পাশে আছেন। পুরো জাতি আপনাদের পাশে আছে।’
কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, গুলশান হামলায় নিহতদের সহযোগিতায় এক কোটি ১০ লাখ টাকার একটি তহবিল গঠন করেছে পুলিশ।
গুলশান হামলায় নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পুলিশ কমিশনার বলেন, গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার দিন আমাকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরিয়ে তারা নিজেরাই শহীদ হলেন।
গত ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জিম্মি উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়ার সময় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা ও অপরাধ বিভাগের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. রবিউল করিম ও ডিএমপি থানার অফিসার ইনচার্জ ইন্সপেক্টর মো. সালাউদ্দিন খান নিহত হন।
আসাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ঘটনার দিন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা আমাকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরিয়ে দেন। তখন পুলিশের এসি রবিউল করিম ও ওসি সালাহউদ্দিন খানও তাদের সঙ্গে ছিলেন। পরে ভবনের দিকে গেলে আমরা আক্রান্ত হলাম এবং তারা শহীদ হলেন। এছাড়া ওই ঘটনায় আহত হন আরও ২৬ পুলিশ সদস্য।
তিনি আরও বলেন, আমি অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছি। যারা জঙ্গি হামলা মোকাবিলা করতে গিয়ে শহীদ হলেন তারা আমাদের জাতীয় বীর এবং দেশের অহঙ্কার। তাদের জীবনের বিনিময়ে আমরা এখন অনেক আস্থা ও সম্মান পাচ্ছি। এ জন্য নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারের পাশে আছি আমরা।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, নিহত চার পুলিশ সদস্যের পরিবারকে সহায়তা করতে ডিএমপি’র পক্ষ থেকে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে। ডিএমপির পুলিশ সদস্যরা নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী এ অর্থ সহায়তা দিয়েছেন। কিছুদিনের মধ্যেই এ টাকা নিহতদের পরিবার সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
এ সময় তিনি নিহতদের পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, কিছু ‘কুলাঙ্গার’ ছাড়া দেশের সব মানুষ আপনাদের পাশে আছেন।
অনুষ্ঠানে চার পুলিশ সদস্যের পরিবারকে মোট ৯০ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়। এর ৭০ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে পুলিশ কল্যাণ তহবিল থেকে আর ২০ লাখ টাকা দিয়েছে বেসরকারি মধুমতি ব্যাংক।
আত্মত্যাগ করেছেন যারা
আর্টিজান হামলায় নিহত পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল করিম ১৯৮৬ সালে মানিকগঞ্জ জেলার সদর থানার কাটিগ্রামে জন্ম নেন। তিনি বাংলাদেশ পুলিশের ৩০তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে ২০১২ সালের জুন মাসে সহকারী পুলিশ সুপার পদে যোগ দেন।
নিহত পুলিশ কর্মকর্তা সালাহউদ্দিন আহমেদ ১৯৬৭ সালে গোপালগঞ্জের ব্যাংকপাড়া গ্রামের জন্ম নেন। ১৯৯১ সালের আগস্টে তিনি পুলিশের উপপরিদর্শক পদে যোগ দেন। ২০০৭ সালে তিনি পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পান।
শোলাকিয়ায় নিহত পুলিশ সদস্য আনছারুল হক ১৯৮৭ সালে নেত্রোকোণার মদন থানার দৌলতপুর গ্রামে জন্ম নেন। তিনি ২০০৬ সালের অক্টোবরে কনেস্টেবল পদে যোগ দেন।
একই হামলায় নিহত জহিরুল ইসলাম ১৯৯২ সালে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানার ভাটিপাড়া গ্রামে জন্ম নেন। তিনি অবিবাহিত ছিলেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জঙ্গিমুক্ত দেশ গড়তে আমরা ঐক্যবদ্ধ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ