পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার : বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলামের লেখার ব্যাপ্তি এতো ব্যাপক যে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে এক জীবনে তা জানা দুরূহ। রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী অনিমা রায় এক টিভিতে গাইলেন ‘ছিঃ ছিঃ চোখের জলে; ভিজাসনে আর মাটি’। সত্যিই তাই! কবিদের অন্তর্দৃষ্টি প্রখর। তাই তারা আগাম অনেক কিছু অনুধাবন করতে পারেন। তা না হলে বাংলাদেশের মানুষ এখন জঙ্গি নিয়ে যে চোখের পানিতে মাটি ভেজাচ্ছে সেটা রবীন্দ্রনাথ এতো আগে জানতেন কিভাবে!
বাংলাদেশে রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে অনিশ্চয়তা, ভীতি-আতঙ্ক আর অবিশ্বাসের বীজ বপন হয়েছে সে যন্ত্রণায় মানুষ কাঁদছে। সন্ত্রাস আর জঙ্গি নিধনের যে মহারণ চলছে তাতে দেশের সর্বত্রই আতঙ্ক, ঘরে ঘরে চাপাকান্না। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ার শিক্ষার্থীদের কার নামে জঙ্গি তকমা লাগে এ ভয়ে গার্জেনদের মধ্যে উৎকন্ঠা। সোনার এই বাংলাদেশে শহর-বন্দর-গ্রামজুড়ে হাজারো প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবার চোখে সংশয়। সাধারণ মানুষতো আতঙ্কে। সুবিধাভোগী বৃত্তবানদের চোখেই প্রশান্তির সরোবর বয়ে যাচ্ছে না। মানুষ একে অপরের চোখে স্থিরভাবে তাকিয়ে থাকার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে। সবাই যেন হারিয়ে গেছি অবিশ্বাসের অরণ্যে। যেখানে বিশ্বাসের রোদ (সত্য) পৌঁছে অনেক বাধা-বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে। আবার গহীনতার কারণে কোথাও কোথাও রোদ (সত্য) পৌঁছানোরই সুযোগ নেই।
অথচ আমরা অতীতে অবিশ্বাসের অরণ্যবাসী ছিলাম না। কখনো কখনো প্রশান্তির সরোবরের দ্বীপচরের বাসিন্দা হয়তো হয়েছি; কিন্তু সেখান থেকে বিশ্বাস ও আস্থার তরণী পাড়ি দিয়ে মূল জমিনে ফিরে এসেছি। এখন অবিশ্বাসের অরণ্য আমাদের অন্ধকার থেকে আরো গহীন অরণ্যের অবিশ্বাসের অন্ধকার কুঠুরীতে নিয়ে যাচ্ছে। আমরাও ক্রমেই সেই আঁধারের কাছে নিজেদের সঁপে দিচ্ছি। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন জাতি আমরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। অভয়ারণ্যের জীবজন্তুরা যেমন সব সময় আতঙ্কে প্রহর গোনে আমাদের অবস্থাও ঠিক তেমনই। জঙ্গিবাদ ইস্যুতে স্বচ্ছ কাচকেও মানুষের চোখে ঘোলাটে মনে হয়।
দেশের হাতেগোনা কিছু ঘাতক-দানব ছাড়া ১৬ কোটি মানুষের সবাই চায় জঙ্গি নিধন। বিবেকবান কোনো মানুষই সন্ত্রাস জঙ্গিবাদকে কেউ প্রশ্রয় দিচ্ছে না। দু’তিনটি ভয়ানক ঘটনার পর রাষ্ট্রের সব যন্ত্রই জঙ্গি নিধনে ব্যস্ত। কিন্তু জঙ্গি নিধন নিয়ে সর্বত্রই অবিশ্বাসের মেঘ। অবিশ্বাসের মেঘের এই ছায়া কেবল ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির নয়। ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর, সর্বোপরি রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্ক হয়ে গেছে এখন অবিশ্বাসের পেন্ডুলাম। প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাষ্ট্রকে শতভাগ বিশ্বাস করেছে নাগরিকেরা এটা সত্য নয়; কিন্তু রাষ্ট্রের কর্মকা-ে মানুষ সবসময় সমর্থন জানিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে জঙ্গি নিধনে জাতীয় ঐক্যের ডাক ওঠার পরও সেটাকে এগিয়ে না নিয়ে বরং নিজেরাই ঐক্য হয়েছে প্রচার করায় মানুষ ভালভাবে নিচ্ছে না। জঙ্গি দমন রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক উদ্যোগ অথচ নাগরিকেরা সেটাকে ঘোর সন্দেহের চোখে দেখেছে। জঙ্গি কোনো রাষ্ট্রের একক সমস্যা নয়। এটা বৈষ্যিক সমস্যা এবং রাজনৈতিক সংকট। এ সংসট দূর করতে হলে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যের প্রয়োজন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার/ দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ/ ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ/কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ/এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।’ অথচ সরকার এটাকে শুধুই আইন-শৃংখলাজনিত সংকটের মতো পুলিশের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় মানুষের মনে সংশয় জেগেছে এ উদ্যোগের পেছনে কোনো রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি আছে কিনা! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন-‘দেশে যারা মানবাধিকারের কাজ করছে কিংবা নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য যে সব সংস্থা সক্রিয় তাদের নেতাদের সঙ্গে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বৈঠক হওয়া জরুরি। যাতে প্রকৃত সত্য সবাই জানার সুযোগ পায়। সন্ত্রাসীদের মুখ থেকে সত্য জানতে পারলেই তো জনগণ তাদের সন্তানদের সতর্ক করতে পারবে। সন্ত্রাসবাদ সাধারণ অপরাধ নয় যে তা কেবল পুলিশের বিবেচ্য বিষয় হবে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভেবে দেখতে হবে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালাতে গিয়ে তরুণদের ওপর পুলিশি খবরদারি বেশি হচ্ছে কিনা। তরুণদের সঠিক পথে রাখার বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। একটি নির্দোষ তরুণ যাতে নতুন করে ক্ষুব্ধ না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা একান্ত প্রয়োজন। সন্ত্রাসী আন্দোলনের সূত্র কিন্তু তরুণদের প্রতিবাদী মন-মানসিকতায়’। এ উপলব্ধি যথার্থই।
অভয়ারণ্য শব্দটি ব্যাপকভাবে পরিচিত। অনেক বনকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়; যাতে ওইসব বনের পশুপাখি নিরাপদে থাকেন এবং মানুষ সেগুলোকে হত্যা করতে না পারে। মানুষ হত্যা না করলেও অভয়ারণ্যে কিন্তু সব পশুর জন্য ‘অভয়ারণ্য’ থাকে না। অনেক পশুই অন্য পশুর খাদ্য হওয়ায় ওইসব পশু সব সময় আতঙ্কে থাকে। যেমন সুন্দরবনের বাঘের ভয়ে সব সময় আতঙ্কে থাকে হরিণ শাবক। জঙ্গি নিধনের সাঁড়াশি অভিযানে দেশের লাখ লাখ মানুষ ওই হরিণ শাকবের মতোই আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে। বিশেষ করে ব্যাচেলর এবং শিক্ষার্থী। ঢাকাসহ সারাদেশে যে সব ব্যাচেলর চাকরির সুবাদে মেসে থাকেন এবং যে সব শিক্ষার্থী লেখাপাড়ার জন্য এবং বেকার চাকরির খোঁজে ঢাকায় এসে মেসে রয়েছেন তারা এখন মহা-আতঙ্কে। চাকরির কারণে ঢাকায় মেসে থাকেন এমন অনেকেই জানিয়েছেন রাত আসে তাদের কাছে বিভীষিকা হয়ে। জঙ্গি ধরার নামে প্রতি গভীর রাতে পুলিশ মেস তল্লাশি করছে। দিনভর কাজকর্মের পর রাতে যখন গভীর ঘুমে যান তখনই তাদের মেস তল্লাশি শুরু করে আইন-শৃংখলা বাহিনী। ফলে তারা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। দৈনিক প্রথম আলোয় খবর বের হয়েছে রংপুর শহরের দুই হাজার ছাত্র-মেস বন্ধ হয়ে গেছে পুলিশি তল্লাশির ভয়ে। আবার সারাদেশে জঙ্গি তালিকার নামে অনেক নিরীহ তরুণ, যুবকের নাম রাজনৈতিক কারণে ‘তালিকায়’ দেয়া হচ্ছে। যা ওই সব নিরীহ তরুণদের ক্ষুব্ধ করছে। ওই সব তরুণদের পরিবার-পরিজন দুর্ভাবনায় পড়ে গেছেন। আবার যাদের ঘরে তরুণ যুবক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা-পড়া করছে তাদের ভয় আরো বেশি। কখন কার বিরুদ্ধে জঙ্গির তকমা পড়ে সে ভয়ে পরিবারের কর্তারা মহা-আতঙ্কে। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন মূলত এসব কারণে আইন-শৃংখলা বাহিনীকে দেশের বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, মানবাধিকারকর্মীর সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তাব করেছেন। এ ধরনের বৈঠক হলে প্রকৃত জঙ্গিদের সম্পর্কে ধারণা যেমন স্বচ্ছ হবে তেমনি নিরীহ সাধারণ তরুণ-যুবকদের রাজনৈতিকভাবে হয়রানির শিকার হতে হবে না। এতে জঙ্গি নিধনে সুবিধা হবে। অবিশ্বাসও কমে যাবে।
নিত্যদিন জঙ্গি নিধন নিয়ে মন্ত্রীদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য মানুষ শুনছে। দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বক্তব্যেও রকমভেদ আছে। যার জন্য কল্যাণপুরে ৯ জঙ্গি হত্যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সন্দেহ-বিতর্ক হয়। গুলশান ট্রাজেডির ঘটনায় হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর পাশের বাড়ি থেকে যদি দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক ভিডিও না করতেন তাহলে মানুষের মধ্যে সংশয় থাকতোই। তড়িঘড়ি করে বিভিন্ন পরিবার থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সদস্যদের ২৬২ জনের তালিকা প্রকাশ করা হলো। সেই তালিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় দেখা গেল কেউ বিয়ের জন্য, কেউ পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল করে, কেউ বাবা-মায়ের সঙ্গে রাগ করে বাড়ি ছেড়েছে। অনেকে ফিরে এসেছে। এক সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেরাই তালিকা খাটো করে ৬৮টিতে নামিয়ে আনায় সাধারণ মানুষের মনে বিশ্বাস-অবিশ্বাস ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বাসা বেঁধে বসে।
জঙ্গি দমনে সরকার তার ব্যর্থতা, সরকারের ক্ষমতা বলয় তাদের ‘লাভের গুড়’কে নিরাপদে রাখতে নাগরিকদের সামনে নানান বয়ান তুলে ধরছে। মন্ত্রী-এমপিদের বক্তব্য মানুষ বিশ্বাস করতে পারছে না। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্বিধা বীজের বপন হয়। সেই বীজ যখন অঙ্কুর মেলে তখন সামাজিক চিন্তকদের বিভাজন নাগরিকের সামনে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। জঙ্গি নামক দানবকে নিয়ে রাষ্ট্র বর্তমানে যে সংকটের মধ্যে আছে, সেই সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অবিশ্বাস, দ্বিধার লতাগুল্ম বেড়ে উঠছে আরো সজীবভাবে। সাম্রাজ্যবাদ ও জঙ্গিবাদ আস্ফালনরূপে রাষ্ট্র এবং সমাজের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তবে আশার কথা হলো- জঙ্গিবাদের সঙ্গে বাংলাদেশ জমিন তথা মাটিরই আত্মিক সম্পর্ক নেই। শ্যাওলার মতো আস্তরণ হয়ে ভাসছে। হয়তো সেটা এক সময় ভেসেই যাবে। কিন্তু মানুষের মধ্যে যে অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে এবং সাধারণ মানুষের কপালে ভাঁজ পড়েছে সেটা দূর করতে হলে সাবধানে জঙ্গি নিধন জরুরি। গণতন্ত্র, মানুষের ভীতি দূর করা, প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এডভোকেট সুলতানা কামাল বলেছেন, উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রের কোন বিকল্প নেই। গণতন্ত্র সীমিত হয়ে গেলে উন্নয়নও সীমিত হয়ে যাবে। দেশে উন্নয়ন হচ্ছে, নতুন রাস্তাঘাট, সেতু তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সেই সেতু, ব্রিজ দিয়ে একজন নারী নিরাপদে যদি চলাচল করতে না পারে তাহলে সেই উন্নয়ন দিয়ে আমরা কি করব। উন্নয়ন হচ্ছে দেশের জনগণের নিরাপত্তাবোধ, শান্তি, কথা বলার অধিকার, ন্যায়বিচারের অধিকার। জনগণকে বোধটা দিতে হবে যে তোমার কাজটা আমি করে দিচ্ছি। জনৈক কবি লিখেছেন- ‘মহানগরীতে এলো বিবর্ণ দিন, তারপর আলকাতরার মত রাত্রি’। আমরা বিবর্ণ দিন এবং আলকাতরার মত রাত্রি চাই না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।