Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অপরাধে জড়িত অবৈধ বিদেশীরা

প্রকাশের সময় : ৭ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

উমর ফারুক আলহাদী : ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িত অবৈধ বিদেশী নাগরিকেরা। জঙ্গি তৎপরতা, খুন, মাদক ব্যবসা, জাল মুদ্রা তৈরী, স্বর্ণ ও মাদ্রা পাচার, এটিএম কার্ড জালিয়াতি প্রতারণা এবং অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসাসহ নানা ধরনের গুরুত্বর অপরাধে জড়িত রয়েছে বলে জানিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এদের ব্যাপারে কোন সঠিক পরিসংখ্যানও নেই আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর হাতে। নেই কোন মনিটরিং। কে কোথায়, কত বছর ধরে অবস্থান করছেন, বা কি করছেন তারও কোন তথ্য নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন অপরাধে র‌্যাব-পুলিশ এদের গ্রেফতারও করা হয়। একটি সংস্থা জানিয়েছে, বাংলাদেশে ১২ হাজার বিদেশী নাগরিক অবৈধভাবে আছে। অন্য একটি সংস্থা বলছে, ৭০ হাজার, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বলছে ২০ হাজার, আবার সংশ্লিষ্ট অন্য একটি সংস্থার তথ্যমতে, রোহিঙ্গসহ বাংলাদেশে বসবাসরত বৈধ-অবৈধ প্রায় ৫ লাখ বিদেশি রয়েছে। তন্মেধ্যে ৪ লাখ ৯০ হাজার ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া অবৈধভাবে কাজ করছে। ফলে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকা। অবৈধ বিদেশীদের নিয়ে কোন মনিটরিও নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন অপরাধে কারাগারে বন্দি আছে ৭ শতাধিক বিদেশি। শুধু চলতি বছরেই খুন ও জঙ্গি তৎপরতাসহ নানা অপরাধ কর্মকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৭৩ বিদেশি নাগরিককে গ্রেফতার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অবৈধভাবে বসবাস করার অভিযোগে গত শুক্রবার রাজধানীর পল্লবী এলাকা থেকে ৪৪ জন নেপালীকে আটক করে তাদের দেশে ফেরৎ পাঠানো হয়েছে। অন্য সব অবৈধ বিদেশী নাগরিকেরা আছে বহাল তবিয়তে। এদের বেশিরভাগই গুরুতর অপরাধে জড়িত বলে পুলিশ, র‌্যাব ও ডিবির একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে ২০ দেশের বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে প্রায় ১৫ হাজার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি দেশের নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগের সংখ্যাই বেশি। এ তালিকার প্রথমেই আছে আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া, ঘানা, কঙ্গো, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিপাইন, আলজেরিয়া, সুদান, তানজানিয়া, উগান্ডা, শ্রীলঙ্কা, ভারত ও পাকিস্তান। এসব দেশের নাগরিদের কে কোথায় কী পেশায় আছেন, তার বেশিরভাগই অজানা পুলিশের। দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি রয়েছে ৭ শতাধিক বিদেশি। তাদের মধ্যে ৭৯ জন বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত।
র‌্যাব জানায়, বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকায় গত ৫ বছরে ২৮৬ বিদেশি নাগরিককে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। এদের অধিকাংশই মাদক, চোরাচালান, জাল মুদ্রা তৈরী, প্রতারণা, অস্ত্র ব্যবসা ও মুদ্রা পাচারে জড়িত। আবার কেউ কেউ জঙ্গি কর্মকা-েও জড়িত। এছাড়া পাকিস্তানের লস্কর ই-তৈয়বা, মিয়ানমারে আরএসও এবং ভারতের জঙ্গি সংগঠনের সাথে জড়িত কিছু নাগরিক অবৈধভাবে এদেশে অবস্থান করছে।
জানা যায়, সাধারাণত খেলোয়াড়, টুরিস্ট ভিসা নিয়ে কিংবা ব্যবসার কথা বলে বাংলাদেশে এসে বিদেশিরা অপরাধ কার্যক্রম চালাচ্ছে। ভিসা দেয়ার সময় ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করলে এ ধরনের অপরাধীর তৎপরতা অনেক কমে আসবে। দেশে অবৈধভাবে কত বিদেশি নাগরিক রয়েছে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নেই।
বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্র মতে, বাংলাদেশে বসবাসরত বেশিরভাগ বিদেশি নাগরিক ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কাজ করছেন। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, বিভিন্ন দেশের ৫ লাখ বিদেশি বর্তমানে বাংলাদেশ কাজ করছে। বায়িং হাউস, এনজিওসহ বিভিন্ন ধরনের চাকরি ও ব্যবসা করছে তারা। এদের মধ্যে মাত্র ১০ হাজার বিদেশির ওয়ার্ক পারমিট রয়েছে। বাকি ৪ লাখ ৯০ হাজার বিদেশি বৈধ অনুুমোদন ছাড়াই কাজ করছে। এতে বাংলাদেশ হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব।
তবে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) বলছে, দেশে-বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। এদের মধ্যে আফ্রিকার ১৫ হাজার বৈধ ও অবৈধ নাগরিক দেশে অবস্থান করছে। ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, আফগানিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, কঙ্গো, ঘানা, নাইজেরিয়া, আলজেরিয়া, আইভরিকোস্ট, সিয়েরা লিওন, সেনেগাল, ক্যামেরুন, ইথিওপিয়া ও লাইবেরিয়া থেকে আসা প্রায় ১২ হাজার নাগরিকের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তারা ফিরে যায়নি। এসব অবৈধ বিদেশি বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অপরাধ কর্মকা-ে জড়িত বেশিরভাগ বিদেশি বৈধ ভিসার পাশাপাশি জাল ভিসা ব্যবহার করে এদেশে প্রবেশ করছে। পুলিশের ইমিগ্রেশন ও সিকিউরিটি কন্ট্রোল অ্যান্ড অপারেশন (এসসিও) শাখার কিছু কর্মকর্তার সহযোগিতায় বিদেশীদের অনেকেই অবৈধভাবে দেশে প্রবেশ করার সুযোগ নিচ্ছে।
পুলিশের বিশেষ শাখার প্রধান (অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক) ড. জাভেদ পাটোয়ারী বলেন, আমরা জঙ্গি ইস্যুতে দিন-রাত কাজ করছি। সেই সাথে অবৈধ বিদেশীদের ব্যাপারেও তথ্য সংগ্রহ করছি। তিনি বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, চীন, কোরিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন এমন তথ্য আমাদের কাছে আছে। আমরা এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি।
ইমিগ্রেশনের একটি সূত্র জানায়, বিদেশীদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার মতো জনবল ইমিগ্রেশন শাখায় নেই। তারপরও অবৈধ এসব বিদেশীদের তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।
রাজধানীর উত্তরা, গুলশান, বারিধারার মতো অভিজাত এলাকায় এসব বিদেশি বাড়িভাড়া নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করে। পুলিশের চোখ এড়িয়ে তারা নির্বিঘেœ অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এসব এলাকায় বিদেশিদের অপরাধ দমনে পুলিশের ভূমিকার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে ডিএমপির গুলশান বিভাগের পুলিশ উপ-কমিশনার (ডিসি) মোস্তাক আহমেদ বলেন, বিদেশীদের ব্যাপারে ইতোমধ্যে বিভিন্ন তথ্য-সংগ্রহ করা হয়েছে। পুলিশের পক্ষে প্রতিটি বাড়ি অনুসন্ধান করে বিদেশিদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি অবৈধ বিদেশিদের সম্পর্কে তথ্য নিচ্ছে পুলিশ। এছাড়া অবৈধ বিদেশীদের অর্থাৎ অপরাধীদের শনাক্ত করার জন্য পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও বাড়ির মালিকদের সহযোগিতা করতে অনুরোধ করা হয়েছে। বাড়িওয়ালা কিংবা ফ্ল্যাট মালিকরা যাতে বিদেশিদের ভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে সচেতন হন, সেজন্য পুলিশের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে অনুরোধ করা হয়েছে। তবে বিদেশিরা বাড়িভাড়া বেশি দেয় বলে বাড়ির মালিক তাদের ব্যাপারে পুলিশের কাছে অনেকেই তথ্য দেন না।
২০১৫ সালের জুলাইয়ে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে প্রায় ২০ কেজি হেরোইনসহ গ্রেফতার করা হয় ভারতের তামিলনাড়ুর বাসিন্দা এলাম উরুগুকে। একই সময় ঢাকার উত্তরা থেকে কোটি টাকা মূল্যের এক কেজি হেরোইনসহ পুলিশ গ্রেফতার করে তাঞ্জানিয়ার নাগরিক মো. রাশেদ, কঙ্গোর নাগরিক জেমস, মঙ্গোলিয়ার নাগরিক চিচিকে। তারা ভিসা ছাড়াই বাংলাদেশে অবস্থান করে মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন।
২০ জানুয়ারি সেগুনবাগিচা থেকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই তালেবান অব পাকিস্তানের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। তারা হলোÑ মেহমুদ, উসমান ও ফখরুল হাসান। এর আগে রাজধানীর উত্তরা থেকে মাদক ও জাল ডলার বিক্রির অভিযোগে এক নারীসহ পাঁচ নাইজেরীয় নাগরিককে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। তারা হলোÑ ডুমানটিয়ার, মেরিটনি, জেরিনালিপেন, বমারছো ও ইউসুফ। গত বছর ২৩ ডিসেম্বর উত্তরার একটি বাড়ি থেকে অবৈধ ভিওআইপি সরঞ্জামসহ ৩৭ বিদেশিকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এর আগে ১১ জুন কারওয়ানবাজারের একটি আবাসিক হোটেল থেকে সাড়ে তিন কেজি কোকেনসহ গ্রেফতার করা হয় পেরুর নাগরিক জুয়ান পাবলো রেফায়েল। ২ জুন ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির বিভিন্ন সরঞ্জাম, বিদেশি মুদ্রা ও জাল ভিসাসহ শ্রীলঙ্কার নাগরিক মোহনাথারাস পন্নুথারাইকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ।
দেশে কতজন বিদেশী নাগরিক অবস্থান করছেন এবং কতজন বৈধ ও কতজন অবৈধ তারও নেই সঠিক কোনো পরিসংখ্যান। আবার যারা বৈধভাবে আছেন তাদের বিষয়ে হালনাগাদ সমন্বিত তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না। বিদেশীদের মধ্যে কবে কার ভিসা শেষ হয়, কে কোথায় অবস্থান করছেন, কতদিন ধরে আছেন, কে কী করছেন তার কোনো কিছুই মনিটরিং করার ব্যবস্থাও নেই। দেশ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট কোন সংস্থার কাছেই সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিনিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে শিল্প খাতে, ট্যুরিস্ট, শিক্ষা ও অনঅ্যারাইভালসহ বিভিন্ন ভিসায় বিদেশী এসব নগরিকরা বাংলাদেশে আসেন। যাদের বড় একটি অংশ ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও অবৈধভাবে এখানে অবস্থান করছেন। এদের বড় একটি অংশ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। আয়কর ফাঁকি দেয়াসহ চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর ঝামেলা এড়াতে বছরের পর বছর তারা ভিসা নবায়ন করছেন না। অনেকে আবার জড়িয়ে পড়েছেন প্রতারণাসহ ভয়ংকর সব অপরাধে।
এদিকে গত কয়েকদিন আগে অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাসরত প্রায় ১২শ’ বিদেশী নাগরিক বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিদেন দিয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাটি তাদের রিপোর্টে বলেছে, পাকিস্তান, ভারত, মিয়ানমার, আফগানিস্তান, ক্যামেরুন, ঘানা, কঙ্গো, নাইজেরিয়া, আইভরিকোস্ট, সেনেগাল, সিয়েরা লিওন, ইথিওপিয়া, আলজেরিয়া, লাইবেরিয়াসহ আফ্রিকা মহাদেশের ১৬টি দেশের নাগরিকরা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে এসে নানা অপরাধী চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অপরাধে জড়িত অবৈধ বিদেশীরা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ