Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপকূলবাসীর দুর্ভোগ কমেনি

কমছে জোয়ারের পানি বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় গ্রামের পর গ্রাম

ইনকিলাব রিপোর্ট | প্রকাশের সময় : ২৪ আগস্ট, ২০২০, ১২:০২ এএম

অমাবশ্যার অস্বাভাবিক জোয়ারের পানি কিছুটা কমলেও উপকূলবাসীর দুর্ভোগ কমছে না। মৌসুমের রেকর্ড পরিমাণ জোয়ারে চট্টগ্রাম ও বরিশাল নগরীর বিভিন্ন এলাকা এখনো পানির নিচে। ফলে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন নগরবাসী। চট্টগ্রামে স্কুল, কলেজ হাসপাতালসহ অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পানি এখনো নামেনি। গুদাম আড়ত ও দোকানপাটে নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার মালামাল। গত কয়েক বছরে শত শত কোটি টাকা ব্যয় হলেও পানিবদ্ধতার কবল থেকে চট্টলাবাসীর মুক্তি মিলেনি। খুলনায় অস্বাভাবিক জোয়ারের পানির চাপে বেড়িবাঁধ ভেঙে ডুবে গেছে মৎস্য ঘের, ফসলের ক্ষেত ও ইটভাটা। প্লাবিত হয়েছে শত শত ঘরবাড়ি। ফলে উপকুলীয় এলাকার লাখ লাখ মানুষ চরম বিপাকে পড়েছেন। জোয়ারের পানিতে সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণি প্রজনন কেন্দ্রসহ প্লাবিত হয়েছে বনাঞ্চলের নিম্নাঞ্চল। জোয়ারে কুয়াকাটা সৈকতের দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৪-৫ফুট পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে বনবিভাগের রিজার্ভ ফরেস্ট ও কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান। চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছে কুয়াকাটার মসজিদ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান।

বরিশাল ব্যুরো জানায়, দক্ষিণাঞ্চলে একটানা ৯৬ ঘন্টার দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া পরিস্থিতির কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। ফুসে ওঠা সাগর গতকাল কিছুটা স্তিমিত হওয়ায় জোয়ারের উচ্চতা কমতে শুরু করেছে। তবে এখনো দক্ষিণাঞ্চলের ৯০টি নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। নদী আর মূল ভূখন্ড একাকার হয়ে যাওয়ায় নৌযোগাযোগ অসম্ভব ঝুকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলাই এখনো সাগরের জোয়ার আর উজানের ঢলের সাথে ভাদ্রের বড় অমাবশ্যার বর্ষনের প্লাবনে বিপর্যস্ত। গতকাল নদ-নদীর পানি প্রায় ১০ সিন্টিমিটার কমলেও এখনো সমগ্র উপকূলভাগ জলোচ্ছাস ও প্লাবনের কবলে। ভোলা সদর উপজেলা ছাড়াও বোরহানউদ্দিন, তজুমদ্দিন, চরফ্যাশন ও মনপুরায় বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধে ধসে মূলভূখন্ডে পানি প্রবেশ করে গ্রামের পর গ্রাম ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। বরগুনা ও পটুয়াখালীরও বেশ কিছু এলাকার বাঁধে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ফসলের জমি আর বসত বাড়ি সব একাকার হয়ে গেছে জোয়ারের পনিতে। এ অঞ্চলের দেড় লাখ হেক্টর জমির উঠতি আউশ ধান ছাড়াও আরো প্রায় দেড় লাখ হেক্টরের রোপা আমন ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ফসল এখনো পানির তলায়। এছাড়াও আরো প্রায় সোয়া ৪ লাখ পুকুর, দীঘি প্লাবিত হয়ে কোটি কোটি মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। বরিশাল সহ দক্ষিণঅঞ্চলের সবগুলো নদী বন্দরে ১ নম্বর সতর্ক সংকেত বহাল রাখা হয়েছে। পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিসহ কোন কোন স্থানে মাঝারি থেকে ভারি এবং অতি ভারি বৃষ্টির আশঙ্কার কথাও বলেছে আবহাওয়া বিভাগ। আজ থেকে পরবর্তি ৪৮ ঘন্টায় উত্তর বঙ্গোপসাগরে আরেকটি লঘু চাপ সষ্টির আশংকার কথা বলা হয়েছে আবহাওয়া বিভাগ থেকে ।

খুলনা থেকে আবু হেনা মুক্তি জানান, ঘূর্ণিঝড় আমফানের আঘাতের ঘাঁ শুকাতে না শুকাতে রিং-বাঁধ ভেঙে ও আগের ভাঙন পয়েন্ট দিয়ে পানি ঢুকে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে বৃহত্তর খুলনার উপকুলীয়াঞ্চল। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে টানা বৃষ্টি ও অমাবস্যার কারনে নদ-নদীতে অস্বাভাবিক জোয়ারের পানির চাপে এসব এলাকর বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। ফলে ডুবে গেছে মাছের ঘের, ফসলের ক্ষেত ও ইটভাটা। প্লাবিত হয়েছে শত শত ঘরবাড়ি। ফলে উপকুলীয় এলাকার লাখ লাখ মানুষ চরম বিপাকে পড়েছেন। বাগেরহাটের চিতলমারীতে প্রবল জোয়ার ও বৃষ্টির পানিতে শতকরা ৮৫ ভাগ সবজি ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। হঠাৎ করে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ফলন্ত সবজি নষ্ট হওয়ায় চাষিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এদিকে মোংলা বন্দরের পশুর ও সুন্দরবনের নদ-নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছে বনবিভাগ। রাত ও দিনের দু’দফা জোয়ারের পানিতে সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণি প্রজনন কেন্দ্রসহ প্লাবিত হয়েছে বনাঞ্চলের নিম্নাঞ্চল।

চাঁদপুর থেকে বি এম হান্নান জানান, জেলা সদর ও হাইমচরসহ চারটি উপজেলায় মেঘনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী তীরবর্তী ১৬টি ইউনিয়নের প্রায় ৩০ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কয়েকদিন জোয়ারের পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় চাঁদপুর সদর ও হাইমচরে বসতবাড়ি, মৎস্য খামার, ফসল ও সড়কের ক্ষতি হয়েছে অধিক হারে। গত দুদিন ধরে চাঁদপুরে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা অনেকটা ব্যহত হচ্ছে। জোয়ারের পানিতে চাঁদপুর শহরের বঙ্গবন্ধু সড়ক, রহমতপুর আবাসিক এলাকা, নাজির পাড়াসহ নিম্ন এলাকাগুলোর সড়কের অবস্থা খুবই করুন। হাইমচর উপজেলার মেঘনার পূর্ব পাড়ের নদী তীরবর্তী এলাকায় জোয়ারের পানিতে ফসল, সড়ক ও বসতবাড়ি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক হারে। অনেক স্থানে পাকা সড়ক ভেঙে খালে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষ ওইসব খাল পার হওয়ার জন্য অস্থায়ীভাবে সাঁকো দিয়ে পার হচ্ছেন। বিশেষ করে হাইমচর উপজেলার পানের বরোজগুলো গত মাসের জোয়ারের পানি এবং বর্তমান জোয়ারের পানিতে লোকসানের মুখে পড়েছে।

চট্টগ্রামের আনোয়ারা থেকে নুরুল আবছার তালুকদার জানান, চট্টগ্রামের আনোয়ারার উপকূল রায়পুর ইউনিয়নের বারআউলিয়া এলাকায় তিন দিন ধরেই উঠানামা করছে জোয়ারের পানি। এলাকার খোলা বেড়িবাঁধ দিয়ে বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের পানিতে ইউনিয়নের বিভিন্ন ওয়ার্ডের ১০ হাজারেরও অধিক মানুষ পানি বন্ধি হয়ে মানবেতর জীবণ যাপন করছে। জোয়ারের পানিতে বসত ঘর, করস্থান, মসজিদ-মাদ্রাসা, পুকুর, মৎস্য ঘের ডুবে একাকার হয়ে যায়।

ঝালকাঠি জেলা সংবাদদাতা জানান, জেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর পানি বিপদসীমার ৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল শহরের রাস্তাঘাটের পানি কিছুটা কমলেও নদী তীরের বাসিন্দারা এখনো পানিবন্দি রয়েছে। অরক্ষিত বেড়িবাঁধ দিয়ে ঢুকে পড়া পানিতে গ্রামের ফসলের ক্ষেত ও মাছের ঘের নিমজ্জিত রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পান চাষীরা।

লক্ষীপুর থেকে এস এম বাবুল জানান, টানা বৃষ্টি আর মেঘনার অস্বাভাবিক জোয়ার পানিতে লক্ষীপুরে কমলনগরে মতিরহাট-তোরাবগঞ্জ সড়ক, নবীগঞ্জ-চরলরেন্স সড়কে ব্রীজ ও বুড়িরঘাট নদীতীর রক্ষা বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে জেলার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে কয়েকটি এলাকার। পাশাপাশি নতুন করে প্লাবিত হয়েছে অন্তত ২০টি গ্রাম। পানিবন্দি হয়ে চরম দুভোর্গে রয়েছে এসব এলাকার প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। অন্যদিকে সদর উপজেলার বুড়িরঘাট এলাকায় ৫০০ মিটার নদীর তীররক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয় কয়েকটি গ্রাম। ফলে এসব এলাকার প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে চরম দুর্ভোগে দিন কাটছে।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে আবু কাওছার জানান, প্রবল জোয়ারে উপক‚লে বাঁধ ভেঙ্গে সাতক্ষীরার বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ঘর বাড়ি ছেড়ে উচ্চু স্থানে আশ্রায় নিয়েছে হাজারো মানুষ। এক দিকে আকাশ হতে বৃষ্টির পানি অন্যদিকে সমুদ্রের লোনা পানি বসতবাড়িতে ঢুকে পড়ায় নাস্তানাবুদ গোটা জেলা। গত দুই চারদিনের টানা বৃষ্টি ও প্রবল জোয়ারে জেলার নিন্মাঞ্চল পানিতে ভাসছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় পাঁচ লক্ষাধীক মানুষ। দিনভর বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করেও প্রবল জোয়ারে কাছে অসহায় হতে হচ্ছে উপক‚লবাসী। স্থায়ী টেকসই বেঁড়ি বাঁধের নানা আশ্বাসের পরও বাস্তবে তা দেখা পায়নি ক্ষতিগ্রস্তরা। ফলে নিদারুন কষ্টে দিনাপাতিত করছে তারা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ