Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সেই স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছেন গ্রেনেড হামলায় আহতরা

নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন আলোচিত জজ মিয়া

খলিলুর রহমান : | প্রকাশের সময় : ২১ আগস্ট, ২০২০, ১২:০৪ এএম

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত ও আহত পরিবারের সদস্যরা ভালো নেই। নিহত পরিবারে শোক এখনও কাটেনি। একই ঘটনায় আহতরা দুঃসহ জীবনযাপন করছেন। এখনও তাদের সে দিনের নারকীয় স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এছাড়াও ওই ঘটনায় আলোচিত সেই জজ মিয়াও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। গতকাল মোবাইল ফোনে দৈনিক ইনকিলাবকে এ কথা বলেছেন জজ মিয়া।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা হয়। শুরু থেকেই নৃশংস ওই হত্যাযজ্ঞের তদন্ত ভিন্ন খাতে নিতে নানা চেষ্টা করা হয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে নতুন করে তদন্ত শুরু করে। বেরিয়ে আসে অনেক অজানা তথ্য। ২০০৮ সালের জুনে বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই তাজউদ্দীন, জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি-বি) নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। তদন্তে বেরিয়ে আসে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ওই হামলা চালানো হয়েছিল। হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড এসেছিল পাকিস্তান থেকে। ওই ঘটনার জজ মিয়ার নাটক সাজানো হয়েছিল। পরে আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর জজ মিয়কে মুক্তি দেয়। এরপর তাকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে ওই মামলার স্বাক্ষীও দেন তিনি।
তিনি বলেন, জীবন বিপন্ন করে সত্য উদঘাটনে স্বাক্ষ্য দিয়েছি। এখনো প্রতিদিন ভয়ে-আতঙ্কে কাটাই। অথচ সরকার থেকে পাইনি কোনো সহায়তা। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমি এখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আগে ভাড়া গাড়ি চালালেও এখন একটি বেসরকারি কোম্পানীতে চাকরি করি। যে টাকা বেতন পাই তাই দিয়ে চলে সংসার। তবে করোনাকালে অফিস থেকে অর্ধেক বেতন দেয়া হয়েছে। এতে অনেক কষ্ট হয়েছে। এ সময় কেউ সহযোগিতাও করেননি। বর্তমান কর্মস্থল নারায়ণগঞ্জ জানিয়ে তিনি বলেন, আমার বাসাও নারায়ণগঞ্জ। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে সেখানে থাকি। তবে নিরাপত্তার অভাবে তিন মাস পরপর বাসা পরিবর্তন করতে হয়। কিন্তু টাকার অভাবে এবারে আর বাসা পরিবর্তন করতে পারেননি তিনি।
শুধু জজ মিয়া নয়, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত ও আহত পরিবারের সদস্যরা ভালো নেই। নিহত পরিবারে শোক এখনও কাটেনি। একই ঘটনায় আহতরা দুঃসহ জীবনযাপন করছেন। এখনও তাদের সে দিনের নারকীয় স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
আমাদের মাদারীপুর জেলা সংবাদদাতা আবুল হাসান সোহেল জানান, গ্রেনেড হামলায় মাদারীপুরের নিহত ৪ পরিবারসহ আহত ৩ পরিবারের সদস্যরা ভাল নেই। একই ঘটনায় আহতরা পঙ্গুত্ব নিয়ে দুঃসহ জীবন-যাপন করছেন। নিহত চার জন হলেন- রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের চানপট্টি গ্রামের যুবলীগ নেতা লিটন মুন্সি, একই উপজেলার কদমবাড়ি ইউনিয়নের মহিষমারি গ্রামের সুফিয়া বেগম, কালকিনি উপজেলার কয়ারিয়া ইউনিয়নের রামারপোল গ্রামের নাছির উদ্দিন ও ক্রোকিরচর গ্রামের যুবলীগ নেতা মোস্তাক আহাম্মেদ ওরফে কালা সেন্টু। আহতরা হলেন- কালকিনি পৌরসভার বিভাগদি গ্রামের হালান হাওলাদার, কৃষ্ণনগর গ্রামের কবির হোসেন, ঝাউতলা গ্রামের সাইদুল হক সরদার।
জানা গেছে, রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের চানপট্টি গ্রামের যুবলীগ নেতা নিহত লিটন মুন্সির মা আছিয়া বেগম ও বাবা আইয়ুব আলী মুন্সি তাদের একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আজও তারা কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। নিহত লিটন মুন্সির এক মাত্র মেয়ে নুসরাত জাহান মিথিলা বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় যখন আমার বাবা মারা যায় তখন আমি খুবই ছোট ছিলাম। বাবা কি জিনিস তা বুঝতে পারি নাই। বাবার আদর পাওয়ার আগেই বাবাকে হারিয়ে। হামলার ঘটনায় অপরাধীদের বিচারের রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানাই। তাহলে এই ঘটনায় আমার বাবাসহ যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের আত্মা শান্তি পাবে। আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। লেখাপড়া শেষে আমি যেন একটা সরকারি চাকুরী পেতে পারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এ দাবি জানাই।
নাসিরের বড় ছেলে মাহাবুব হোসেন জানান, বাবার উপার্জনেই চলতো সংসার। বাবার মৃত্যুর পর টাকার অভাবে আমাদের লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কোন কোনদিন অর্ধপেট আবার কোনদিন খাবারই জোটেনি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দিয়েছেন। এখন সেই টাকার লভ্যাংশ দিয়ে আমার মা, আমি আর আমার ভাই নাজমুলকে নিয়ে কোনরকম বেঁচে আছি। এ ছাড়া আমাদের খবর আর কেউ রাখেনি।
গ্রেনেড হামালায় নিহত যুবলীগ নেতা মোস্তাক আহাম্মেদ ওরফে কালা সেন্টু। তার বাড়ি কালকিনি উপজেলার ক্রোকিরচর। সে বরিশালের মুলাদি নানা বাড়িতে বড় হয়েছে। এ কারনেই তার লাশ মুলাদিতেই দাফন করা হয়। সেন্টুর স্ত্রী আইরিন সুলতানা জানান, তিনি ঢাকার মার্কেন্টাইল ব্যাংকে চাকরি করেন। এক মেয়ে আফসানা আহমেদ রীদিকে নিয়ে ঢাকায় থাকেন। তিনি বলেন, এমন দু:খজনক স্মৃতি কি ভোলা যায়, না মুছে যায়। মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় থাকি। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকার অনুদান পেয়েছিলাম।সে সম্বল আর চাকরি থেকে যা পাই, তা দিয়েই মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভাবছি। তিনি ঢাকায় একা থাকেন, মহিলা মানুষের একা থাকা বিড়ম্বনা উল্লেখ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর যদি মৃতদের পরিবারের জন্য একটা বাসস্থানের ব্যবস্থা করতেন, তাহলে উপকৃত হতাম।
হালান হাওলাদার বলেন, শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর পরিমান স্প্রিন্টার রয়েছে। স্প্রিন্টার জ্বালা-যন্ত্রণা অসহ্য লাগে মাঝে মাঝে। হাটাচলা করতে খুব কষ্ট হয়। সে কারণে তেমন কাজ করতে পারি না। তারপরেও সংসারের খরচ মেটানোর জন্য ফেরি করে মুরগি বিক্রি করি। করোনার কারণে এখন তা বন্ধ আছে। আমরা যারা আহত আছি প্রধানমন্ত্রী যদি আমাদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতো তা হলে ভালো হতো। আহত অনেকে বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট থেকে প্রতি মাসে ভাতা পায়। আমি ভাতা পাই না। প্রধানমন্ত্রী যেন আমাদের কালকিনির আহত তিন জনের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করেন। আহত অনেকে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ফ্লাট পেয়েছে। আমি ফ্লাট পাইনি। আমার থাকার জন্য স্থায়ী বসত ঘরের প্রয়োজন।
আহত কবির হোসেন বলেন, গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হয়ে বাম হাতের ৫ আঙ্গুল বাকা হয়ে আছে। এ হাত দিয়ে কোন ভারি কাজ করতে পারি না। দুইবার আমি মাত্র এক লাখ ২০ হাজার টাকা পেয়েছি। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে যে টাকা দিয়েছে আমি সে টাকা পাইনি। তখন আমি টাকা রোজগারের জন্য মালয়েশিয়া ছিলাম। বিদেশে গিয়েও হাতের সমস্যার কারণে তেমন কাজ করতে পারিনি। বাধ্য হয়ে দেশে চলে আসি কয়েক মাস পূর্বে। এখন বেকার জীবন যাপন করছি। প্রধানমন্ত্রী সবাইকে যে এককালীন টাকা দিয়েছে আমাকেও যেন সে টাকা দেয়। প্রতিমাসে যেন ভাতার ব্যবস্থা করেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চাই।
কালকিনির ঝাউতলা গ্রামের সাইদুল হক সরদার বলেন, শেখ হাসিনাকে দেখার জন্য আস্তে আস্তে মঞ্চের ১০ থেকে ১২ হাত দূরত্বে চলে আসি। দাঁড়িয়ে মন দিয়ে নেত্রীর বক্তব্য শুনতে থাকি। বক্তব্য প্রায় শেষ। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু শেষ করতে পারেননি তার মধ্যে বোমা ফাটানোর শব্দ। সে ঘটনায় আহত হয়ে শরীরে স্পিন্টার নিয়ে যন্ত্রণাকর জীবন-যাপন করছি। শরীরে স্পিন্টারের যন্ত্রনায় তেমন ভারি কাজ করতে পারছি না। ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার বলে উন্নত চিকিৎসা দরকার। আমি উন্নত চিকিৎসা কি ভাবে করবো। এত টাকা পয়সাতো আমার নেই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাই তিনি যেন আমাদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। যাতে করে শরীর থেকে স্প্রিন্টার বের হয়ে যায়। বাঁচার তাগিদে বিভিন্ন কাজ কর্ম করেও ভালো কিছু করতে পারছি না। ছোট একটা চায়ের দোকান দিয়ে সংসার চালাই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গ্রেনেড-হামলা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ