Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কেটে রাখা হবে ৪ ব্যাংকের ১৪০ কোটি টাকা

কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ ১০ ব্যাংক

প্রকাশের সময় : ৫ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

অর্থনৈতিক রিপোর্টার : গত অর্থবছরের কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারায় দেশি-বিদেশি চারটি ব্যাংকের প্রায় ১৪০ কোটি টাকা কেটে রাখবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক চারটি হল- এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি ৫৫টি ব্যাংকের জন্য কৃষি ও পল্লী ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। প্রাথমিক হিসাবে এ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ব্যাংকগুলো সম্মেলিতভাবে এ খাতে ঋণ বিতরণ করে ১৭ হাজার ৬৪৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার থেকে ১ হাজার ২৪৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকা বেশি ঋণ বিতরণ হয়েছে। তবে ১০টি ব্যাংক তাদের বেঁধে দেয়া লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। এরমধ্যে সরকারি ব্যাংক ৬টি, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ৩টি এবং একটি বিদেশি ব্যাংক রয়েছে। এই ১০টি ব্যাংক তাদের লক্ষ্যমাত্রার থেকে ৭৪২ কোটি ১৫ লাখ টাকা কম ঋণ বিতরণ করছে। এরমধ্যে ৬টি সরকারি ব্যাংকের অংশই ৬০২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। বাকি ৪টি ব্যাংক ১৩৯ কোটি ৮১ লাখ কম ঋণ বিতরণ করছে।
সরকারি ব্যাংক ৬টি বাদে বাকি ৪টি ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রা থেকে যে পরিমাণ কম ঋণ বিতরণ করছে,  সেই পরিমাণ অর্থ কেটে রাখবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর জন্য ব্যাংকগুলোকে কোনো সুদ দেয়া হবে না। তবে পরবর্তীতে অতিরিক্ত ঋণ বিতরণ করে কেটে রাখা অর্থ ফেরত পাওয়া যাবে। অর্থাৎ পরবর্তী অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার অনর্জিত ঋণের টাকা বিতরণ করতে পারলে কেটে রাখা অর্থ ফেরত পাবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক।
সূত্রটি জানায়, ইউনিয়ন ব্যাংক কৃষি ও পল্লী ঋণের লক্ষ্যমাত্রার থেকে ৮৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা কম বিতরণ করেছে। এ জন্য ব্যাংকটিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বাধ্যতামূলভাবে সমপরিমাণ (৮৬  কোটি ৯৬ লাখ) টাকা জমা রাখতে হবে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ব্যাংকটির কৃষি ও পল্লী ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয়েছিল ১৩৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ঋণ বিতরণ হয়েছে ৪৮ কোটি ৪ লাখ টাকা।
মধুমতি ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয় ১৮ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকটি ঋণ বিতরণ করতে পেরেছে ১২ কোটি ১৭ লাখ টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার ৬৭ দশমিক ৬১ শতাংশ। অর্থাৎ কৃষি ও পল্লী ঋণ কম বিতরণ করায় এ ব্যাংকের ৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা কেটে রাখা (বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখা) হবে।
এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রার থেকে ৪২ কোটি ২ লাখ টাকা কম ঋণ বিতরণ করেছে। ব্যাংকটির কৃষি ও পল্লী ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয় ৫৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ঋণ বিতরণ হয়েছে মাত্রা ১২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারায় ব্যাংকটির ৪২ কোটি ২ লাখ টাকা কেটে রাখা হবে।
আর কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারায় ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ৫ কোটি টাকা কেটে রাখা হবে। ব্যাংকটির কৃষি ও পল্লী ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয় ৫ কোটি টাকা। তবে এ খাতে এক টাকাও ঋণ বিতরণ করেনি বিদেশি এই ব্যাংকটি।
এদিকে সরকারি মালিকানাধীন সোনালী, রূপালী, রাজশাহী কৃষি উন্নায়ন ব্যাংক (রাকাব), জনতা, বিডিবিএল এবং অগ্রণী এই ৬টি ব্যাংকও কৃষি ও পল্লী ঋণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি।
টাকার অঙ্কে লক্ষ্যমাত্রার থেকে কম ঋণ বিতরণে শীর্ষে রয়েছে রাকাব। ব্যাংকটি লক্ষ্যমাত্রার থেকে ৩৮৫ কোটি ৩ লাখ টাকা কম ঋণ বিতরণ করেছে। এ ব্যাংকের কৃষি ও পল্লী ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ঋণ বিতরণ হয়ছে ১ হাজার ১১৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এর পরের স্থানে রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটি লক্ষ্যমাত্রার থেকে ৬৪ কোটি ২ লাখ টাকা কম ঋণ বিতরণ করেছে। ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয় ৬৬০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে বিতরণ হয়েছে ৫৯৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
এছাড়া সোনালী ব্যাংক ৪৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, রূপালী ব্যাংক ৫০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা এবং জনতা ব্যাংক ৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা লক্ষ্যমাত্রার থেকে কম ঋণ বিতরণ করেছে। এরমধ্যে  সোনালী ব্যাংকের ১ হাজার ১৮০ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ১৫০ কোটি টাকা এবং জনতা ব্যাংকের ৭৫০ কোটি টাকা লক্ষ্যামাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের নির্ধারণ করে দেয়া লক্ষ্যমাত্রা বাধ্যতামূলকভাবে পূর্ণ করতে হবে। কোন ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হলে যে পরিমাণ কম ঋণ বিতরণ হবে সেই পরিমাণ অর্থ বাধ্যতামূলকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা করতে হবে। এই অর্থ  থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কোন প্রকার সুদ পাবে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষি ঋণ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক প্রভাষ চন্দ্র মল্লিক বলেন, নিয়ম অনুযায়ী যে ব্যাংকগুলো কৃষি ও পল্লী ঋণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি তাদের অর্জিত অংশের সমপরিমাণ অর্থ কেটে রাখা হবে। তবে সরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ সরকারি ব্যাংকগুলোর কৃষি ও পল্লী ঋণের অনর্জিত অংশ কেটে রাখা হবে না।
কতো দিনের মধ্যে ব্যাংকগুলো থেকে টাকা কেটে রাখা হবে জানতে চাইলে প্রভাষ চন্দ্র বলেন, ব্যাংকগুলো যে হিসাব দিয়েছে তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। যদি কোন ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণ কৃষি ও পল্লী খাতে না হয়, তাবে তা বাদ দেয়া হবে। সে হিসেবে হয়তো কোন কোন ব্যাংকের বিতরণ করা কৃষি ও পল্লী ঋণের পরিমাণ কমেও যেতে পারে। সব বিষয় যাচাই-বাছাই করে তারপর ব্যাংকগুলোর অনর্জিত ঋণের টাকা কেটে রাখা হবে। এক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগবে।
এদিকে গত ৩১ জুলাই ১৭ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা ও কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরমধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর জন্য ৯ হাজার ২৯০ কোটি টাকা এবং  বেসরকারি ও বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য ৮ হাজার ২৬০ কোটি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
কৃষি ও পল্লী ঋণের নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, শস্য/ফসল চাষের জন্য আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত স্বল্প  মেয়াদি কৃষি ঋণের ক্ষেত্রে সিআইবি রিপোর্ট ও সিআইবি ইনকোয়্যারির প্রয়োজন হবে না। এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রমের অনুমতি পাওয়া ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গাইডলাইন্স অন এজেন্ট ব্যাংকিং ফর ব্যাংকস’-এর নীতিমালা মেনে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণ করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে এজেন্টদের কমিশন বা সার্ভিস চার্জ হিসেবে গ্রাহকদের কাছ থেকে নির্ধারিত সুদের অতিরিক্ত দশমিক ৫০ শতাংশ আদায় করতে পারবে।
এ ছাড়া বাংলাদেশি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের জন্য নির্ধারিত কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণ লক্ষ্যমাত্রার ন্যূনতম ৩০ শতাংশ বাধ্যতামূলকভাবে নিজস্ব সক্ষমতায় তথা নিজস্ব নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিতরণ করতে হবে। কৃষি যন্ত্রপাতির জন্য দেয়া ঋণ কৃষিকাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত সকল ব্যক্তিকে একক অথবা গ্রুপভিত্তিতে দেয়া যাবে। কৃষি খাতের জন্য নির্ধারিত সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা হবে ১০ শতাংশ। আম ও লিচুর পাশাপাশি পেয়ারা উৎপাদনেও সারা বছর ঋণ দেয়া যাবে। অমৌসুমী সবজি বা ফল চাষে একর প্রতি ঋণ সীমার অনধিক ২৫ শতাংশ বিতরণ করা যাবে।
এ বিষয়ে গভর্নর ফজলে কবির বলেন, বেসারকরি ও বিদেশি ব্যাংকের ক্ষেত্রে স্ব স্ব ব্যাংকের মোট ঋণ ও অগ্রিমের ন্যূনতম আড়াই শতাংশ কৃষি ও পল্লী ঋণ হিসেবে বিতরণের বিধান রয়েছে। তবে ব্যাংকগুলোর সক্ষমতা ও শাখা স্বল্পতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিগত অর্থবছরের মতো চলতি অর্থবছরেও বেসরকারি ও বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ২০১৬ সালের ৩১ মার্চভিত্তিক নিট ঋণ ও অগ্রিমের ২ শতাংশ হার ধরে নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর নতুন ৯টি বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে মোট ঋণ ও অগ্রিমের ৫ শতাংশ হার ধরা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, গত অর্থবছরের ১৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৭ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ বেশি ধরে ২০১৬-১৬ অর্থবছরে ১৭ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাংকগুলোর জন্য কঠিন হওয়ার কথা নয়, কারণ আগের অর্থবছরে ১৭ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার পরিমাণে শিথিলতার পরও যে ব্যাংকগুলো লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে না তাদের অর্থবছর শেষে অনার্জিত অংশ বিনা সুদে বাংলাদেশ ব্যাংকে বাধ্যতামূলকভাবে জমা রাখতে হবে।




 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কেটে রাখা হবে ৪ ব্যাংকের ১৪০ কোটি টাকা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ