Inqilab Logo

শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪, ১৫ আষাঢ় ১৪৩১, ২২ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

হজরত আয়েশা (রা.) : মাতৃজাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় যার ভূমিকা অতুলনীয়

প্রকাশের সময় : ৫ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কে, এস, সিদ্দিকী
 (২২ জুলাই প্রকাশিতের পরে)
সমগ্র উলামায়ে ইসলামের সর্বসম্মত অভিমত এই যে, ইসলামে সর্বোত্তম নারী তিনজন হজরত খাদিজাতুল কোবরা (রা.), হজরত ফাতেমা (রা.) এবং হজরত আয়েশা (রা.)। তারা বলেন প্রথম হজরত ফাতেমা (রা.) দ্বিতীয় হজরত খাদিজা (রা.) এবং তৃতীয় হজরত আয়েশা (রা.)। আল্লামা ইবনে হাজমের দাবী, হজরত আয়েশা (রা.) কেবল আহলে বায়তের মধ্যে নন এবং শুধু নারী সমাজের মধ্যে নন বরং তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পর সর্বাধিক উত্তম। আল্লামা সৈয়দ সুলায়মান নদভী এসব অভিমত উদ্ধৃত করার পরে উল্লেখ করেন এ ব্যাপারে আমাদের বিশ্বাস আল্লামা ইবনে তাইমিয়া এবং তাঁর শাগরিদ হাফেজ ইবনে কাইয়েমের সাথে। তাঁরা লিখেছেন যে ফজিলতের উদ্দেশ্য যদি পরকালীন মর্যাদা হয় তাহলে সেই অবস্থা আল্লাহই জানেন কিন্তু জাগতিক মর্যাদার দিক দিয়ে বাস্তবাত হচ্ছে এই যে, তাঁদের ফজিলত বা মর্যাদা বিভিন্নমুখী। যদি বংশমর্যাদার কথা ধরা যায়, তাহলে হজরত ফাতেমা সর্বোত্তম। আর যদি ঈমানের দিক দিয়ে প্রথম অগ্রাধিকার বিবেচনা করা হয়, তাহলে বলতে হবে ইসলামের সূচনালগ্নে যেসব সমস্যা সংকটের মোকাবিলা এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাহায্য-সহযোগিতা ও তাঁর সান্ত¡না সন্তুষ্টির দিক থেকে হজরত খাদিজাতুল কোবরা (রা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব সবার ওপর। কিন্তু যদি শিক্ষা-জ্ঞান, দ্বীনের খেদমত এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সমস্ত শিক্ষা ও উপদেশাবলীর প্রচার-প্রসারের শ্রেষ্ঠত্বের দিক সামনে রাখা হয়, তাহলে হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে না।
উম্মুল মোমেনীন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) সরাসরি এবং প্রত্যক্ষভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সান্নিধ্যে থেকে তাঁরও কাছ থেকে বহু বিষয় ইলম হাসেল করেন। এ সম্পর্কে বিশিষ্ট শাহাবা ও তাবেয়ীগণ যেসব অভিমত ব্যক্ত করেছেন তা পাঠ করলে তাঁর অসাধারণ প্রতিভাজ্ঞান ও শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। বিশিষ্ট সাহাবী হজরত আবু মূসা আশআরী (রা.) বর্ণনা করেন আমরা সাহাবীগণ এমন কোনো মুশকিল বিষয়ের সম্মুখীন হয়নি যা আমরা আয়েশা (রা.)-এর নিকট পেশ করিনি এবং সে সম্পর্কে আমরা কিছু অবগত হয়নি। অর্থাৎ কঠিন কঠিন সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে আমরা তার কাছ থেকে আরো নানা বিষয় সম্পর্কে অবগত হতে পেরেছি। (তিরমিজি)।
হজরত উরওয়া ইবনে জোবায়র (রা.) বলেন, আমি হালাল, হারাম, ইলম, কাব্য এবং তিব্ব চিকিৎসা শাস্ত্রে উম্মুল মোমেনী আয়েশা (রা.) অপেক্ষা অধিক জ্ঞানী আর কাউকে দেখেনি। (হাকেম) অপর বর্ণনায় আছে; কোরআন, করায়েজ, হালাল, হারাম, ফেকা, কাজা, তিব্ব, আরবের ইতিহাস এবং বংশ শাস্ত্রে আয়েশা (রা.)-এর চেয়ে অধিক জ্ঞানী আর কাউকে আমি দেখিনি। একদিন হজরত আমীর মোআভিয়া (রা.) তাঁর এক দরবারীকে জিজ্ঞাসা করলেন, লোকদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আলেম কে? সে বলল আমিরুল মোমেনীন! আপনি। তিনি বললেন না আমি নই। আল্লাহর কসম! সত্য সত্য বল। সে বলল তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে আয়েশা (রা.)। (হাকেম)।
বিভিন্ন সাহাবার শাগরেদ বিশিষ্ট তাবেয়ী আতা ইবনে আবিরে বাহ (র.) বলেন- আয়েশা (রা.) ছিলেন সর্বাধিক ফকীহ সর্বাপেক্ষা আলেম এবং জনগণের মধ্যে অতি প্রিয়। (হাকেম)
বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম জোহরী বলেন, আয়েশা (রা.) সকল লোকের মধ্যে সবচেয়ে বড় আলেম ছিলেন, খ্যাতনামা সাহাবাগণ তাঁর কাছে জিজ্ঞাসা করতেন। (তবকাত)।
বিশিষ্ট তাবেয়ী আবু মাল সাইবনে আবদুর রহমান ইবনে আওয়া বলেন: হাদীসে নববী ফেকা রায় এবং কোরআনের আলেম আমি আয়েশা (রা.)-এর চেয়ে অগ্রসর আর কাউকে দেখিনি।
ফরায়েজ সম্পর্কে সুখ্যাত সাহাবাগণ হজরত আয়েশাকে জিজ্ঞাসা করতেন বলে বিশিষ্ট তাবেয়ী মাসরুক শপথ করে বলেন। (হাকেম)।
ইমাম জোহরীর সাক্ষ্য হচ্ছে: যদি সকল পুরুষের এবং সকল উম্মুল মোমেনীনের ইলম এক পাল্লায় রাখ তা হলে হজরত আয়েশা (রা.)-এর ইলম তাদের মধ্যে সবচেয়ে ব্যাপক হবে। (হাকেম)।
কোনো কোনো মোহাদ্দেস হজরত আয়েশা (রা.)-এর ফজিলাত সম্পর্কে হুজুর (সা.)-এর এই হাদীস বর্ণনা করেছে ‘খুজু শাতরা দ্বীনিকুম আন হোমায়রা অর্থাৎ, তোমাদের দ্বীনের একটা অংশ এবং হোমায়রা (আয়েশা) হতে শিক্ষা কর।
বিশিষ্ট সাহাবীগণ হাদীসেও নানা বিষয়ে হজরত আয়েশা (রা.) শরণাপন্ন হতেন। তাবেয়ীন যুগে হাদীসের আলেমগণ তাঁর কাছ থেকে হাদীস গ্রহণ করতেন, শিক্ষা নিতেন। তাদের সংখ্যা দেড়শ থেকে দুইশ এর নাম সংকলিত হয়েছে। তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে অনেকে শিক্ষা গ্রহণ করে হাদীস বর্ণনা করেন। পর্দানশীল যেমন মহিলা চার দরসে বসে শিক্ষা লাভ করেছেন তাদের সংখ্যা প্রায় অর্ধশতকের নাম পাওয়া যায়। (সীরাতে আবেশীয়)।
সীরাত লেখক গাউসুল মোমেনীন হজরত আয়েশা সিদ্দিকী (রা.)-এর বহুমুখী প্রতিভা ও তাঁর নানা শাস্ত্রজ্ঞানের বিবরণ দান করেছেন, যার কিছুটা আভাস পূর্বে প্রদান করা হয়েছে। পরিশেষে আমরা তাঁর কোরআন মাজীদের অগাধ জ্ঞান ও তাফসীর ছাড়াও বিশেষভাবে কোরআন সংকলন সম্পর্কে গৃহীত উদ্যোগের প্রতি আলোকপাত করতে চাই। এ পর্যায়ে উল্লেখ করা দরকার যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নবুওয়াত রেসালত জীবনের মক্কি ও মদনা যুগের তেইশ বছর মদ্দতে সমগ্র কোরআন মাজীদ নাজিল হয়েছে। হযরত আয়েশা (রা.) নবুওয়াত বা নুজুলে কোরআনের চতুর্দশ বর্ষে, ৯ বছর বয়সে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন সঙ্গিনী হবার সৌভাগ্য লাভ করেন। তাই হুজুর (সা.)-এর সঙ্গে থাকার সময়কাল তাঁর প্রায় দশ বছর, যা মদীনা জীবন। এতে প্রমাণিত যে, নুজুলে কোরআনের অর্ধেকেরও অধিক সময় হজরত আয়েশা (রা.)-এর বুদ্ধি-জ্ঞান হবার পূর্বের ঘটনা। কিন্তু এ অসাধারণ হৃদয়বান, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারিণী হযরত আয়েশা (রা.) এ খোদা প্রদত্ত মেধা ওধী শক্তিবলে কোরআনের জ্ঞান সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ থেকে লাভ করেন যা এক বিস্ময়কর ঘটনা অথচ এটি ছিল তাঁর খেলাধুলা করার শৈশবকাল কিন্তু তাঁর সে সময়টাও বৃথা যায়নি। এ সম্পর্কে বোখারী সূত্রে বলা হয় যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এ সময় প্রায় হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)-এর গৃহে গমন করতেন। হজরত সিদ্দীক (রা.) তাঁর গৃহে একটি মসজিদ স্থাপন করেছিলেন। তিনি সেখানে বসে অত্যন্ত একাগ্রতা ও বিনয়ের সাথে কোরআন মাজীদ তেলাওয়াত করতেন। স্বাভাবিকভাবে হজরত আয়েশা (রা.) এ সুযোগকে হাতছাড়া করেননি, তাঁর অসাধারণ স্মরণশক্তি দ্বারা তিনি উপকৃত হতেন। এ সম্পর্কে তিনি তাঁর খেলাধুলা অবস্থায় যেসব আয়াত নাজেল হয়েছে সেগুলোর কথা উল্লেখ করেন।
কোরআন সংকলনের ইতিহাস হতে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাত পর্যন্ত কোরআন লিখিত ও কিতাব আকারে সংকলিত হয়নি। হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) তাঁর খেলাফত আমলে তা বিন্যস্ত করেন। এ সময় অন্যান্য সাহাবাগণও নিজ নিজ তেলাওয়াতের জন্য কোরআন বিন্যস্ত বা জমা করতে থাকেন। অর্থাৎ যার নিকট যেসব আয়াত ছিল তিনি সেগুলো বিন্যস্ত করে তেলাওয়াত করতেন। এ পদ্ধতিতে কেবল সূরা সমূহের মধ্যে কোনটি পূর্বে হবে কিংবা কোনটি পরে হবে, তাতে বিরোধ ছিল। হজরত আয়েশা (রা.)-এর নিকটও এরূপ একটি সংগ্রহ বা সংকলন ছিল।
বোখারী শরীফের বর্ণনা অনুযায়ী, হজরত আয়েশা (রা.) তাঁর গোলামের দ্বারা কোরআনের একটি কপি লিখিয়ে ছিলেন, মুসনাদের বর্ণনায় এ গোলামের নাম আবু ইউনুস উল্লেখিত হয়েছে যিনি কিতাবত বা লিপি শাস্ত্রবিদ ছিলেন। বলা হয়ে থাকে, সে সময় কোরআনের কেরাত বা পাঠ সম্পর্কে ইরাকে বিরোধের প্রভাব ছিল অধিক। তখন একজন ইরাকবাসী হজরত আয়েশা (রা.)-এর নিকট এসে অনুরোধ জানায় তাকে কোরআন শিক্ষা দেওয়ার জন্যে। তিনি কারণ জিজ্ঞাসা করলে লোকটি বলে : আমাদের এলাকায় এখন পর্যন্ত লোকেরা অবিন্যস্ত এলোমেলো পাঠ করে আসছে। আমার ইচ্ছা, আমার কোরআনে বিন্নাস আপনার কোরআন অনুযায়ী সাধন করবো।’ তিনি বললেন, সূরাগুলোর পূর্বা-পরে কোনো ক্ষতি নেই। অতঃপর তিনি তাঁর কোরআনের কপি বের করে প্রতিটি সূরার শিরোনাম পাঠ করে লিখিয়েছেন বলে বোখারীর বর্ণনায় দেখা যায়।
কোরআন সংকলন সম্পর্কে হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.)-এর গোলাম আবু ইউনুস বলেন: আমাকে তিনি এক কপি কোরআন লিখে দেয়ার নির্দেশ দেন এবং বলেন, যখন তুমি এই আয়াত হাফেজু আলাছ ছালাওয়াতে ওয়াছ ছালাতিল ওস্তা (ওয়া ছালাতিল আছরি)Ñ এ আয়াত পর্যন্ত পৌঁছবে তখন আমাকে জানাবে। (আয়াতটির অর্থ তোমাজসমূহের হেফাজত করো বিশেষ করে মধ্যবর্তী নামাজের এবং আছরের নামাজের)।
আর ইউনুস বলেন, আমি যখন (উল্লেখিত) আয়াতটি পর্যন্ত পৌঁছি তখন তিনি আয়াতটি বর্ণিত রূপে লেখান এবং বলেন : আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে অনুরূপ শুনেছি। (তিরমিজি) মূল কোরআনে ‘ওয়া ছালাতিল আছর’ বাক্য নেই। এ কারণে মোফাসসিরগণ ‘ছালাতুল ওস্তা’ (মধ্যবর্তী নামাজ) বলতে আছরের নামাজ সাব্যস্ত করেছেন। তারা সকলে হজরত আয়েশা (রা.)-এর ব্যাখ্যাটাই গ্রহণ করেছেন। একটি বর্ণনা অনুযায়ী, উম্মুল মোমেনীনের গোলাম আবু ইউনুসের ন্যায় অপর গোলাম জাকওয়ানের দ্বারাও তিনি কোরআন লিপিবদ্ধ করাতেন।
পরিশেষে সীরাতে আয়েশা (রা.)-এর লেখক আল্লামা সৈয়দ সুলায়মান নাদভীর ভূমিকা হতে যতসামান্য উদ্ধতির মাধ্যমে নিবন্ধটি এখানে শেষ করতে চাই। তিনি বলেন :
“উম্মুল মোমেনীন হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.)-এর পবিত্র জীবন চরিত না শুধু এই জন্য পাঠযোগ্য যে, তিনি হেরমে নবুওয়াতের একজন পর্দানশীল পবিত্র জীবনের ঘটনাবলীর সমষ্টি ছিলেন বরং এই দিক থেকেও তাঁকে অধ্যয়ন করা জরুরি যে, তিনি দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম মানবের জীবনের সেই অংশ যা ‘পরিপূর্ণ নারী’র উৎকৃষ্টতম প্রতিচ্ছবি আমাদের সামনে উপস্থাপন করে।” (সমাপ্ত)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হজরত আয়েশা (রা.) : মাতৃজাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় যার ভূমিকা অতুলনীয়
আরও পড়ুন