Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কালো তালিকায় পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ

প্রকাশের সময় : ৩ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল : গুলশানের হলি আর্টিজানের ঘটনার পর নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে জঙ্গি কার্যক্রমে অর্থের লেনদেন নিয়ে। একই সঙ্গে এসব লেনদেনের তদারকিতে থাকা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্সি ইউনিটের (বিএফআইইউ) কার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। গত মাসে এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অব মানি লন্ডারিং (এপিজি) তাদের রেটিং-এ বাংলাদেশ ব্যাংকের দক্ষতায় রেটিং দিয়েছে একেবারে নিম্নমানের। আর এ কারণে কালো তালিকায় পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অথচ এক বছর আগেও এপিজি একাধিক বিষয়ে দক্ষতায় সর্বোচ্চ রেটিং অর্জন করে বাংলাদেশ।
বিএফআইইউ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের রেটিংয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাংকগুলো খারাপ করেছে। তারপরও ঢাকায় এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে বলে আশায় ছিল বাংলাদেশ। সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরার সুযোগ পেত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু গুলশান হামলার পর এপিজির বার্ষিক সভাটি ২ মাস পেছানো হয়েছে। ঢাকার পরিবর্তে ভেন্যু নেয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অনেকেই মনে করছেন, ২০১৪ সালে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসা বাংলাদেশ হয়তো আবারও ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বা ‘কালো তালিকা’য় অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে। গত ২৩ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য (এপিজি)-এর ১৯তম বার্ষিক সভা বাতিল হওয়ায় এই আশঙ্কা আরও প্রকট হয়েছে।
দেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিদেশি বিনিয়োগসহ নানাভাবে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে বাংলাদেশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, কোনো দেশ মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাস অর্থায়ন প্রতিরোধ করতে না পারলে প্রথমে ওই দেশকে ধূসর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর আগে বাংলাদেশ ২০০৮ সালে ধূসর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এরপরও পরিস্থিতি উন্নতি না হলে ওই দেশকে কালো তালিকায় নেয়া হয়। এ ধরনের পদক্ষেপে বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ খারাপ হবে। যার বিরূপ প্রভাব পড়বে বিনিয়োগে।
ব্যাংকিং চ্যানেলের যে কোনো লেনদেন তদারকিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গাফিলতি আছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। কুরিয়ার ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা লেনদেন সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে হতে হবে বলে মনে করেন তিনি। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় চলে গেলে বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সুদের হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। একইভাবে বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। অভ্যন্তরীণ বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ পরিস্থিতিরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তিনি বলেন, গুলশানে জঙ্গি হামলার পর দেশের অর্থনীতিতে একটা বড় ধাক্কা আসতে পারে এমন আশঙ্কা অনেকেই করছেন। এতোমধ্যে বিদেশিরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে কোনো বিদেশিই বিনিয়োগে আসতে আগ্রহী হবেন না। ড. সালেহউদ্দিন জানান, শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের কারণে তৈরি পোশাকের ব্যবসা এসেছিল বাংলাদেশে। ওই সময় বিনিয়োগকারীরা সেখানে নিরাপত্তা পায়নি বলেই বাংলাদেশমুখী হয়েছিলেন। একইভাবে বাংলাদেশে নিরাপত্তা-সংকট দেখা দিলে কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগ করবেন না।
সূত্র মতে, এক সময়ে বিএফআইইউ প্রতিমাসে বিভিন্ন ব্যাংকের জাল-জালিয়াতি ও জঙ্গি অর্থায়ন বিষয়ে রিপোর্ট প্রদান করত। প্রতি বছর ৫০/৬০টি কেস ধরে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হতো। যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এশিয়া প্যাসিফিক মানি লন্ড্রারিং-য়ে ২০১৪ সালে সর্বোচ্চ রেটিং অর্জন করে। বর্তমানে জঙ্গি অর্থায়নের রিপোর্টিং শূন্যের কোটায় নেমেছে। গত অর্থ-বছরে মাত্র ১টি অভিযোগের রিপোর্ট প্রদান করা হয় বিএফআইইউ থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র মতে, মহাব্যবস্থাপক হিসেবে দেব প্রসাদ দেবনাথ বিএফআইইউ’র দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে জাল-জালিয়াতি নিয়ে কোনো ব্যবস্থাতো দূরের কথা; এবিষয়ক কোনো তথ্যই প্রকাশ পাচ্ছে না। এখানকার পরিদর্শকরা যে সব কেস ধরেন তার নোট উপরে না পাঠিয়েই নিজেই ব্যাংকগুলোর সাথে আলোচনার মাধ্যমে ‘ব্যক্তিগত সুবিধার’ বিনিময়ে এসব অভিযোগ বাতিল করে দেন। অথচ জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধ আইনের উদ্দেশ্যই ছিল, দেশের ভেতরে ও বিদেশে পাচার হওয়া অর্থের লেনদেন প্রতিরোধ করা। এতে, ব্যাংকগুলো সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য দিলে, সে প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশ্লেষণ করবে ও আইনি ব্যবস্থা নেবে। এমন আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নিয়ে সমালোচনা ছিল বরাবরই।
এদিকে, গত মাসে এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অব মানিলন্ডারিং (এপিজি) তাদের রেটিং-এ বাংলাদেশ ব্যাংকের দক্ষতায় রেটিং দিয়েছে একেবারে নিম্নমানের। এ রকম অবস্থায় সম্প্রতি গুলশানের হলি আর্টিজানের মতো ঘটনায় জঙ্গি অর্থের লেনদেন নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
ব্যাংকিং চ্যানেলে জঙ্গি অর্থের লেনদেন আদৌ তদারকি হচ্ছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ খানিকটা অভিযোগ করলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে। তিনি বলেন, যে সব মাধ্যমে একজন থেকে অন্যজনে টাকা পাঠানো হয়, সেগুলো কি মনিটর করা হচ্ছে। এগুলোতে আরও বেশি জোর দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক হঠাৎ হঠাৎ এসব বিষয়ে জোর দেয়ায় ব্যাংকের উপর হয়রানি হয়। এভাবে হঠাৎ হঠাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের জেগে ওঠা ঠিক নয়। এটাকে চলমান রাখতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কখনো কিছু মামলা হলেও তার তদন্ত বা সুষ্ঠু বিচার না হওয়ারও সমালোচনা করেন সাবেক এই গভর্নর। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আল্টিমেটলি যদি বিচার না হয় বা শাস্তি না হয় তাহলে যারা এসব করছে তারা অনবরত এটা করবে। নতুনরা উৎসাহ পাবে। তিনি বলেন, ‘ফাইন্যান্স ফর টেরোরিসম’ একটি শক্ত আইন। এতে মৃত্যুদ-ের বিধানও আছে। এই আইনের আওতায় দ্রুত যদি বিচার করা যেত তাহলে জঙ্গি তৎপরতা বেশ কিছুটা দমন করা সম্ভব হতো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গুলশানে জঙ্গি হামলার ঘটনা না ঘটলে ২৮ জুলাই বাংলাদেশের জন্য কিছুটা সুসংবাদের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বাংলাদেশের অনুকূলে আসবে কিনা তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, দেশে যেভাবে জঙ্গি-সন্ত্রাসী হামলা হচ্ছে, তাতে সন্ত্রাস বা জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া পদক্ষেপ নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। যার প্রভাব পড়তে পারে আগামী সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিতব্য এপিজির বার্ষিক সভায়।
অবশ্য ইতোমধ্যে এপিজির খসড়া মূল্যায়ন প্রতিবেদনেও বার্তা দেয়া আছে যে, বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় যাচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন-সংক্রান্ত সর্বশেষ যে ঝুঁকি নিরূপণ প্রতিবেদন ও কৌশলপত্র তৈরি করেছে, তাতে সন্ত্রাসে অর্থায়নকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়নি বলেও জানিয়েছে এপিজি। একই সঙ্গে এ বিষয়ে বাংলাদেশের দালিলিক কোনো কৌশলপত্র নেই বলেও এপিজির মূল্যায়ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে, ২০১৫ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সফরে এসে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও বাস্তবায়ন খতিয়ে দেখে এপিজি। সেই সফরের প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে তারা ওই মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করে। সর্বশেষ মে মাসের শুরুতে এপিজির ৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসেছিল। তখন অর্থ পাচার ও জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধসহ বিভিন্ন ইস্যুতে এপিজি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে টানা ১৬টি বৈঠক করে বিএফআইইউ।
জানা গেছে, জঙ্গি অর্থায়ন নিয়ন্ত্রণ, অর্থ পাচার প্রতিরোধ এবং যে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অর্থায়ন বন্ধে প্রতি বছর এপিজির বার্ষিক সভা করা হয়ে থাকে। সংস্থাটির এবারের সভায় ৪১টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধি, ৮টি দেশ এবং ২৮টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রায় ৪শ’ প্রতিনিধি অংশ নেয়ার কথা ছিল। এই সম্মেলন সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতিও ছিল। কিন্তু গুলশানে জঙ্গি হামলার পর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এপিজি।
জানা গেছে, অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ১১টি মানদ- রয়েছে। এ ১১টি মানদ-ের মধ্যে যদি কোনো দেশ ৯ বা তার অধিক মানদ-ে ‘নিম্ন ও মধ্যম মানে’ থাকে, তাহলে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন রিভিউ গ্রুপভুক্ত (আইসিআরজি) হবে। যদি বাংলাদেশ ৮ বা তার কম মানদ-ে ‘নিম্ন ও মধ্যম মানে’ থাকে, তাহলে সে ক্ষেত্রে বিশ্বজনীন আন্তসরকার সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) মানদ- পূর্ণভাবে বাস্তবায়নকারী দেশের তালিকায় চলে যাবে।
বাংলাদেশ ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আইসিআরজি প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে এফএটিএফ পূর্ণভাবে বাস্তবায়নকারী দেশের তালিকাভুক্ত হয়। প্রতিবেশী ভারত এফএটিএফভুক্ত দেশ। প্রচলিত সাধারণ নিয়মে বিশ্বের কোনো দেশ আইসিআরজি প্রক্রিয়াভুক্ত থাকলে আন্তর্জাতিক আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সেই দেশটির ঋণপত্র বা এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খরচ বেড়ে যায়। এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মহাব্যবস্থাপক দেবপ্রসাদ দেবনাথের সাথে এ বিষয়ে একাধিকবার সেল ফোনে কথা বলার চেষ্টা করলে তাকে পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, এ বছর মানব পাচার, স্বর্ণ চোরাচালান, মাদক ব্যবসা ও ব্যাংকিং জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশে মানি লন্ডারিং হচ্ছে বলে এপিজি আগাম আভাস দিয়েছে। তবে বাংলাদেশ যাতে ধূসর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হয় সেজন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ে দুটি কমিটি কাজ করছে। ওই কমিটি সন্ত্রাসী অর্থায়ন ও মানি লন্ডারিং সংশ্লিষ্ট মামলাগুলোর তদন্তে সহায়তা ও মনিটরিং করছে বলে জানা গেছে।



 

Show all comments
  • Tania ৩ আগস্ট, ২০১৬, ১২:১৩ পিএম says : 0
    Bisoyti khub e udbeger
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কালো তালিকায় পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ