পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
ঐতিহাসিক হাইয়া সোফিয়া মসজিদে গত শুক্রবার দীর্ঘ ৮৬ বছর পর জুমা আদায়ের মধ্য দিয়ে প্রথম নামায অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে খুতবা প্রদান ও ইমামতি করেন দেশটির ধর্মমন্ত্রী প্রফেসর ড. আলি আব্বাস এরবাশ। ওসমানি রীতি মোতাবেক কুরআনের আয়াত খচিত তরবারি হাতে নিয়ে ধর্মমন্ত্রী মিম্বরে আরোহণ করেন। এসময় মুসল্লিদের কাতারে উপস্থিত ছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান ও তার মন্ত্রিসভার সিনিয়র সদস্যগণ। ইনকিলাবের পাঠকদের উদ্দেশে পেশ করা ঐতিহাসিক খুতবার বাংলা অনুবাদ :
প্রথমে উপস্থিত মুসল্লিদের প্রতি আল্লাহর রহমত নাযিলের দু’আ করে এরবাশ বলেন, মোবারক এ সময়ে পূণ্যময় এ স্থানে আমরা ঐতিহাসিক একটি সময় অতিবাহিত করছি। খুতবায় ধর্মমন্ত্রী বলেন, ‘হাইয়া সোফিয়া কুরবানি ঈদের একেবারে আগ মুহূর্তে, পবিত্র জিলহজ্জ মাসের তৃতীয় দিনে মুসল্লিদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হচ্ছে। আজকের পর তুর্কী জাতির অন্তরে ব্যথা বেদনায় রূপ নেয়া হাইয়া সোফিয়ার প্রতি আক্ষেপ দূর হবে। তাই প্রথমে মহান আল্লাহর অসংখ্য শুকরিয়া আদায় করি।
আজ হাইয়া সোফিয়ার গম্বুজ থেকে ‘আল্লাহু আকবার’ ‘লা ইলাহা ইল্লাহ’ ও দরূদের মধুর ধ্বনী ভেসে আসার দিন। আযানের সুমধুর সুর আজ আয়া সুফিয়ার সুউচ্চ মিনারা থেকে ইথারে পাথারে ছড়িয়ে পড়ার দিন। আজ খুশিতে চোখে আসা পানি নিয়ে নামাযে দাঁড়ানো, খুশু-খুজু’র সাথে রুকুতে যাওয়া ও কৃতজ্ঞতায় মহান আল্লাহর সামনে নিজেদের ললাট মাটিতে ঠেকানোর দিন। আজ বিনয় ও আত্মমর্যাদা প্রকাশের দিন। এমন একটি দিন আমাদেরকে উপহারদাতা, এ জগতের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ স্থান মসজিদে আমাদেরকে একত্রকারী ও পূণ্যময় ইবাদতগাহ আইয়া সুফিয়াতে আমাদেরকে প্রবেশাধিকার প্রদানকারী ক্ষমতাধর আল্লাহর অসংখ্য কৃতজ্ঞতা আদায় করছি।
হাজার দরূদ ও সালাম সেই মহামানব রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি যিনি আমাদেরকে সুসংবাদ প্রদান করে গেছেন নিন্মোক্ত ভাষায়, ‘কনস্টান্টিনোপল একদিন বিজয় হবেই। সে বিজয়ে নেতৃত্বদানকারী সেনাপতি কতই না উত্তম সেনাপতি এবং মহান সে বিজয়ের সৈনিকগুলো কতই না উত্তম সৈনিক।’ শত সহস্র সালাম বর্ষিত হোক প্রিয় নবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ সুসংবাদের ভাগিদার হওয়ার জন্য পথে বেরিয়ে পড়া ইস্তাম্বুলের আধ্যাত্মিক রাহবার আবু আইয়ুব আনসারি রাদিয়াল্লাহু আনহু’র প্রতি। আরও সালাম বর্ষিত হোক তার অন্যান্য সাহাবি ও তাদের পথের অনুসারিদের প্রতি।
ইসলামে ফাতহ তথা বিজয় মানে ভোগদখল নয়; আবাদ করা, ধ্বংস নয়; উৎকর্ষ সাধন। ইসলামের এ শিক্ষা বুকে ধারণ করে আনদলুতে আগমনকারী সুলতান আলপ আরসলান ও এখানকার মাটিকে মাতৃভ‚মি হিসেবে গ্রহণ করে আমাদের কাছে আমানত হিসেবে রেখে যাওয়া শহিদ, গাজি ও ঈমানের নূরে এ ভ‚মিকে আলোকিতকারী আধ্যাত্মিক রাহবারদের প্রতিও হাজার হাজার সালাম। বিশেষভাবে রহমত বর্ষিত হোক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিশিষ্ট বুযুর্গ শামসুদ্দিন রাহ.-এর প্রতি, যিনি ফাতিহ সুলতান মোহাম্মাদের মনোজগতে বিজয়ের অঙ্কুর রোপণ করেছিলেন এবং ১৪৫৩ সালেন পহেলা জুন এ হাইয়া সুফিয়াতে প্রথম জুমায় ইমামতি করেছিলেন।
হাজারো সালাম, ফাতিহ সুলতান মোহাম্মাদের প্রতি। যিনি আল্লাহর এ আয়াত থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন, ‘কোনো বিষয়ে যখন পোক্তা ইচ্ছা করে ফেল তখন কেবল আল্লাহর উপর ভরসা কর। মূলত আল্লাহ তা‘আলা তার ওপর ভরসাকারীদের পছন্দ করেন।’ ফাতিহ সুলতান মোহাম্মাদ ছিলেন এমনই একজন। ফলে তিনি আল্লাহর উপর ভরসা করে ইস্তাম্বুল বিজয়ে সে যুগের সবচেয়ে উন্নত কৌশল ব্যবহার করেছিলেন। জাহাজগুলোকে তিনি স্থল দিয়ে চালনা করেন। আল্লাহর ওপর ভরসা ও তার একান্ত সাহায্যের ফলে তিনি ইস্তাম্বুলে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করেছিলেন। বিজয়ীর বেশে ইস্তাম্বুলে প্রবেশ করে সুলতান মোহাম্মাদ এখানকার একটি পাথর কণাতেও ক্ষতি সাধন করার অনুমতি দেননি। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। পাশাপাশি হাইয়া সেফিয়াকে মিনারা দিয়ে সুসজ্জা দানকারী, জগদ্বিখ্যাত স্থাপতিসম্রাট মি’মার সিনানের প্রতি সালাম। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে শত বছর পরও আজ হাইয়া সোফিয়া সমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে।
পৃথিবীর সাত মহাদেশের উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম যে যেখান থেকেই হাইয়া সেফিয়াকে নতুন করে মসজিদে হিসেবে খুলে দেয়ার ফলে খুশি প্রকাশ করছেন- তাদের সবার প্রতি সালাম। হাইয়া সোফিয়াকে আজকের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য যারাই শ্রম দিয়েছেন সবার প্রতি সালাম। হাইয়া সোফিয়া পনের শ’ বছর ধরে মানব ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। তাই এটি জ্ঞান বিজ্ঞান, প্রজ্ঞা ও ইবাদতের অন্যতম মারকায। হাইয়া সোফিয়া মহান আল্লাহর দাসত্ব ও তার কাছে নিঃশর্ত আনুগত্যের অন্যতম নিদর্শন।
ফাতিহ সুলতান মোহাম্মাদ চোখের মণি এ ইবাদতখানাটিকে কেয়ামত পর্যন্ত আবাদ রাখার জন্য মুমিনদেরকে আমানত হিসেবে ওয়াকফ করে গেছেন। মুসলিম হিসেবে আমাদের বিশ্বাস, ওয়াকফকৃত সম্পদে কারো হস্তক্ষেপ বৈধ নয়; ওয়াকফকৃত সম্পদের প্রতি প্রসারিত হাত পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। ওয়াক্ফের শর্তগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ পূরণ করতে হয়। গাদ্দারি করলে আল্লাহর লানত বর্ষিত হয়। সুতরাং ইতিহাস পরম্পরায় হাইয়া সোফিয়া কেবল তুর্কী জাতির মালাকানাধীন কোনো সম্পত্তি নয়; বরং গোটা মুসলিম উম্মাহর সম্পদ।
হাইয়া সোফিয়াতে ইসলামের ঐতিহাসিক সাম্যের বাণী উচ্চারিত হয়েছিল সুলতান মোহাম্মাদের জবানে। ইস্তাম্বুল বিজিত হওয়ার পর প্রাণভয়ে হাইয়া সেফিয়ায় আশ্রয় নেয়া জনগণের সামনে ফাতিহ সুলতান মোহাম্মাদের আশ্বাসবাণী ছিল নিম্নোক্ত ভাষায়, ‘আজকের পর থেকে আপনাদের স্বাধীনতা ও জানমালের বিষয়ে কোনো ভয় থাকবে না। কারো সম্পদ লুণ্ঠন করা হবে না। কারো প্রতি অবিচার করা হবে না। ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের কারণে কাউকে কষ্ট দেয়া হবে না।’ বাস্তবেও তিনি এমনি করেছিলেন। তাই এ হাইয়া সেফিয়া, শতাব্দির পর শতাব্দি ভিন্নধর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা, ঐক্য ও সংহতির নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
হাইয়া সেফিয়াকে নতুন করে মসজিদ হিসেবে ব্যবহার করার অর্থ হবে, দীর্ঘ পাঁচশ’ বছরের পুরনো ঐতিহ্যে তাকে ফিরিয়ে নেয়া। হাইয়া সোফিয়ায় নামায আদায়ের মধ্য দিয়ে গোটা জগত এ শিক্ষা লাভ করবে যে, একত্ববাদ, জ্ঞান বিজ্ঞান ও উত্তম আখলাকের উপর প্রতিষ্ঠিত ইসলামি সভ্যতা কিছুটা আক্রান্ত ও ধূলিধূসর হয়ে পড়লেও সময়ের ব্যবধানে তা আবারো উৎকর্ষের চ‚ড়ায় আরোহণের পথ খুঁজে বের করবে।
হাইয়া সেফিয়াতে আযানের সমধুর সুর উচ্চারিত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাইতুল মাকদিসসহ পৃথিবীর অন্যান্য ‘ব্যথিত’ মসজিদগুলো ও সেখানকার অধিবাসীদের অন্তরাত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে। মহান এ মসজিদকে নামাযীদের জন্য উন্মুক্ত করতে পারা তুর্কী জাতির ঈমান ও দেশপ্রেমের পরিচায়ক। তুর্কীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে ইশারা করছে তাদের এই অটল সিদ্ধান্ত।
ইসলামি সংস্কৃতিতে মসজিদগুলো একতা, সংহতি, ভ্রাতৃত্ব ও শান্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পবিত্র কুরআনে মসজিদ আবাদকারীদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘মসজিদগুলোকে কেবল সেসব লোক আবাদ করে, যারা আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস করে, যাকাত প্রদান করে ও আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না। মূলত এমন লোকদের ব্যাপারেই আশা করা যায় যে, তারা হেদায়েতপ্রাপ্ত।’
যে মসজিদের মিনার থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসে না, যে মসজিদের মিম্বারে কেউ আরোহণ করে না, যে গম্বুজের নিচে গুণ গুণ আওয়াজ ওঠে না, যে মসজিদের আঙ্গিনায় মুসল্লিদের পদাচারণ হয় না- তার চেয়ে কষ্টদায়ক দৃশ্য এ জগতে আর কী হবে পারে! ইসলাম বিদ্বেষীদের রোষানলে দুনিয়ার আনাচে-কানাচে আজ বহু মসজিদের দরজায় তালা ঝুলছে। এমনকি বোমা মেরে মসজিদ উড়িয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটছে। মজলুম ও অসহায় মুসলিমরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তাই দুনিয়াবাসীকে ফাতিহ সুলতান মোহাম্মাদ ফাতিহের পাঁচশ’ বছর পূর্বে দেখিয়ে যাওয়া আদর্শ আজ স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। গোটা মানবতার প্রতি, বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো জুলুমকে আজই ‘থামো’ বলার সময় এসেছে।
আমাদের উচিৎ পুরো পৃথিবীতে ন্যায় পরায়ণতাকে বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট হওয়া। শত সমস্যায় জর্জরিত লোকদের আশ্রয়স্থল হওয়া। জুলুম, অন্যায়, অবিচার, আর্তনাদ ও অসহায়ত্বের অমানিশায় ছেয়ে যাওয়া ভূখন্ডে ইনসাফের পতাকা উড্ডীন করা। নিম্নোক্ত আহ্বানে আমাদের সাড়া দেয়া উচিত, ‘হে মুসলমান, ঈমানকে তুমি এতটা মাধুর্য মিশিয়ে গ্রহণ করো এবং সে অনুযায়ী চলো যে, তোমাকে হত্যা করতে আসা লোকটিও ঈমানের দিশা পেয়ে যাবে।’ ঈমানি এ বিপ্লব আমাদেরকেই শুরু করতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুর ভাষায়, ‘মানব সন্তান হয় আমার দীনি ভাই, না হয় সৃষ্টিগতভাবে আমরা সবাই সমান।’ আমরা আরও বিশ্বাস করি, মানুষ হিসেবে এ পৃথিবী আমাদের সম্মিলিত বসবাসের ঘর। তাই ভাষা, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠী- যাই হোক না কেন, মানুষ মাত্র আমরা সবাই দুনিয়া নামের এ ঘরের সদস্য এবং শান্তি নিরাপত্তা ও উত্তম আচরণ পাওয়ার হকদার। ফলে সবাই আপন ধর্মমত অনুসারে নিরাপত্তার সাথে বসবাসের অধিকার রাখে।
পূণ্যময় এ স্থানে দাঁড়িয়ে সমগ্র মানবতাকে লক্ষ্য করে বলতে চাই, ‘হে মানব জাতি! হাইয়া সেফিয়া মসজিদ অন্যান্য মসজিদগুলোর মতো আল্লাহর সব বান্দার জন্য সদা খোলা থাকবে। আধ্যাত্মিকতা, ঈমান, আল্লাহর ইবাদত ও সৃষ্টির প্রতি গবেষণার ক্ষেত্রে হাইয়া সোফিয়ার অবদান অন্যান্য সময়ের মতো এখনো চলমান থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের ঐতিহ্যের সাথে মিশে থাকা, হৃদয়ের স্পন্দন মহান এ ইবাদতখানার খেদমত করার তাওফিক দান করুন। এ মসজিদের যথাযত মূল্যায়ন করার তাওফিক দান করুন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।