পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার : হাতি! আমরাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্তন্যপায়ী প্রাণী। আমরা ঘাস-পাতা-কলাগাছ খাই। ভারতের মেঘালয়ের বনে-বাদাড়ে বাস করলেও আমাদের সামাজিক কাঠামো অন্য জীবজন্তুর থেকে আলাদা। সবচেয়ে বয়স্ক মাদি হাতির নেতৃত্বে আমরা ২৫ সদস্য একটি পরিবারের মতো একসাথে বাস করি। ভাগ্যবিড়ম্বনায় দলছুট হয়ে সোয়া মাস ধরে বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র নদ ও যমুনার বানের পানিতে ভাসছি। বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র, যমুনার সাড়ে ৩শ’ কিলোমিটার এলাকায় ঘুরছি। কলাগাছভোজী একটি হাতি সামাল দিতে পারছে না বাংলাদেশ সরকার; অথচ সুন্দরবন ধ্বংস হলে শত শত মানুষখেকো রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হাজার হাজার কুমির লোকালয়ে এলে তাদের সামাল দেবে কেমন করে?
পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ৩৮ দিন থেকে বানের পানিতে ভাসছি। আমার জন্য কেউ কিছু করছে না। না বাংলাদেশ সরকার, না সাধারণ মানুষ। শুনেছি বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের আমলারা আমার ভাগ্য নিয়ে চিঠি চালাচালি শুরু করছে। আমি পানিতে মরছি আর ওরা করছে চিঠি চালাচালি। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে পৃথিবী যখন ছোট হয়ে আসছে তখন আমলারা ব্যস্ত চিঠি নিয়ে। আমি হাতি। হিং¯্র না হওয়ায় মানুষ আমাকে পোষেও। তারপরও আমাকে উদ্ধারের বদলে ‘গালিভার’ ভেবে এ দেশের মানুষ লিলিপুটের মতো আচরণ করছে। বিপদে পড়া একটি হাতিকে দেখে নদীপাড়ের লাখ লাখ মানুষ যেন ভয়ে মরছে। অথচ বানের পানিতে ভাসতে ভাসতে আমার জীবন ওষ্ঠাগত। সবাই জানে হাতি গোশতভোজী নয়। মানুষ ও পশুপাখিকে খাওয়ার জন্য হত্যা করে না। আমরা কলাগাছ খাই। ৩৮ দিন ধরে নদীর চরে ঘুরে বেড়াচ্ছি; আমার জন্য কিছুই করতে পারছে না বাংলাদেশের মানুষ! শুনেছি রাজনৈতিক দলাদলির কারণে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে মানবপ্রেম উঠে গেছে; কিন্তু বিপদগ্রস্ত পশুর প্রতিও প্রেম নেই!
শুনেছি আমার দেশের (ভারত) প্রেসক্রিপশনে রামপালে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পর পরিবেশ দূষণে যদি সুন্দরবন ধ্বংস হয় আর সেখানের মানুষখেকো বাঘের দল যদি লোকালয়ে চলে আসে তাহলে তোমাদের অবস্থা কেমন হবে? বাঘ তো মানুষ খায়। কলাগাছভোজী একটি নিরীহ হাতিকে সামাল দিতে পারছ না; বন থেকে শত শত বাঘ যদি বের হয় তাহলে হাজার হাজার মানুষের অবস্থা কেমন হবে চিন্তা করছেন কি? সে চিন্তা না করেই ভারতের স্বার্থে সুন্দরবনকে ধ্বংস করতে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছেন? মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে তোমরা সাহসী জাতি। অথচ ম্যানহোলে শিশু পড়ে গেলে তাকে জীবিত উদ্ধার করতে পারো না। রানা প্লাজার মতো একটি বিল্ডিং ভেঙে পড়লে উদ্ধারকাজে তোমাদের মাসের পর মাস লেগে যায়। অবৈধভাবে রাস্তার ওপর নির্মাণ করা র্যাংকস ভবন ভাঙতে তিন মাস সময় ব্যয় করেও অর্ধশত মানুষকে জীবন দিতে হয়। নদীতে একটি স্টিমার ডুবলে তীরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন অথচ মানুষকে উদ্ধার করতে পারেন না। অথচ পাবনার রূপপুরে আণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য লাফালাফি করছেন। এটা আগুন নিয়ে খেলা নয় কি? একটি আণবিক চুল্লির বিস্ফোরণ ঘটলে কত হাজার লোকের প্রাণ যাবে, কত জমি-মাঠ-ঘাট পুড়ে ছাই হয়ে যাবে একবার চিন্তা করেছেন? চেরনোবিলের দুর্ঘটনার ইতিহাস তোমরা কি ভুলে গেলে? রাশিয়া-চীনের মতো তথ্যপ্রযুক্তিতে শক্তিশালী দেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সাহস দেখায় না। আর তোমরা?
বনের হাতির দোষ মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, শেরপুর ও জামালপুরের গ্রামগুলোতে মাঝে মাঝে হানা দেই। এতে বাংলাদেশের বেশ কিছু গ্রামের কৃষকের ক্ষতি হয়। আমি তো ভাগ্যাহত হাতি। দলছুট হয়ে বানের পানিতে ভেসে এসেছি। পরিবারের সবাইকে ছেড়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছি। পশু বলে কি আমার প্রতি তোমাদের হৃদয়ে একটু সহানুভূতি জাগবে না? আজ থেকে ৩৮ দিন আগে প্রকৃতির বৈরিতায় ধরাশায়ী হয়ে কুড়িগ্রামের রৌমারীর সাহেবের আলগা সীমান্ত দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের বানের পানিতে ভেসে বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে পড়েছি। প্রথমে আটকা পড়ি চরবাগুয়ার কাশবনে। বাংলাদেশে ভাসতে ভাসতে জীবন বাঁচানোর চেষ্টায় বিভিন্ন চরে ওঠার চেষ্টা করেছি। চরের বিবেকহীন মানুষের তাড়া খেয়ে আবার নদীতে চলে আসি। কখনো নদীর পানিতে ভাসছি কখনো চরে ওঠার চেষ্টা করছি। সোয়া মাসে এভাবে প্রায় সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার নদীপথ পাড়ি দিয়েছি। প্রথমে কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী, রাজীবপুর, গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি, সাঘাটা, বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি, জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ হয়ে ওই জেলার মাদারগঞ্জের ডাকাতিয়ার চরে উঠি। আমরা গোশতভোজী নই। ঘাস-পাতা, গলাগাছ খাই। তোমাদের জাতীয় পশু বাঘের মতো হিং¯্রও নই। বাঘ মানুষের রক্ত খায়। তারপরও নির্বোধের মতোই গ্রামবাসী তাড়া করে প্রতিদিন আমাকে নদীর পানিতে নামিয়ে দিচ্ছে। এখন পানিতে আটকে আছি। দিনরাত যে কিভাবে কাটছে তা তো বাংলাদেশের বানভাসী মানুষের জানার কথা। তাদের ঘরবাড়িতে পানি ওঠায় তারাও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নিদারুণ কষ্টে আছে। তারপরও তাদের মনে আমার প্রতি দয়ামায়া নেই? পশু হলেও আমার শরীর রক্তমাংসে গড়া। যখনই তীরে ওঠার চেষ্টা করছি মানুষ থালা-বাটি ও টিন বাজিয়ে ভয় দেখিয়ে আমাকে নদীতে নামিয়ে দিচ্ছে। দীর্ঘ সময়ে সঙ্গীহীন, ক্ষুধা ও বানের পানির সাথে বাঁচার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। জীবন প্রদীপ এখন নিভু নিভু।
দুঃখের কাহিনী কি বলব? ২৭ জুন সোমবার মেঘালয়ে বানের পানির ¯্রােতে ভেসে দলছুট হই। পরিবারের কে কোথায় আছে জানি না। মঙ্গলবার সকাল ৭টার দিকে ব্রহ্মপুত্র নদে আমাকে ভাসতে দেখে চরে রটে যায় মহিষ ভেসে আসছে। মহিষ ধরতে পারলে অনেক টাকা। এই লোভে কুড়িগ্রামের সাহেবের আলগা চরের লোকজন আমাকে পানি থেকে ওঠানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু আমি মহিষ নই হাতি বুঝতে পেরে তারা চলে যায়। এক সময় বানের পানি থেকে উঠি চরবাগুয়ার চরে। কিন্তু চরে খাবার না থাকায় চর ছাড়ার চেষ্টা করলে নদের তীব্র স্রোতের কবলে পড়ে ভাসতে থাকি। অতঃপর আটকা পড়ি খেড়–য়ার চরে। এভাবে ভাসতে ভাসতে রাজীবপুরের নয়াচর বাজারের পশ্চিমে মধ্যপাড়া নামক চরে কাদায় আটকা পড়ি। অতঃপর চড়াইহাটি চর, কীর্তনতারি চর, নয়াচর, মধ্যপাড়া চরে থাকি ৯ জুলাই পর্যন্ত। ক্ষুধার যন্ত্রণায় কয়েকটি গাছও উপড়ে ফেললে গ্রামবাসীর তাড়া খেয়ে আবার স্রোতে। ভাসতে ভাসতে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার এরেন্ডাবাড়ি নামক চরে উঠি। খাবার খোঁজার সময় মানুষের তাড়া খেয়ে নদীতে ভাসতে থাকি। ১২ থেকে ১৩ জুলাই এরেন্ডাবাড়ি চরের মানুষের তাড়া খেয়ে জামালপুরের চরহাগড়া নামক চরে গিয়ে উঠি। এ চরে জনবসতি ছিল না। কাশবন থাকায় এ চরে দুই দিন অবস্থান করি। ১৪ জুলাই গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের পাতিলতলা চরে; অতঃপর বগুড়ার সারিয়াকান্দির হরিরামপুর কাশিয়াবাড়ি চরে। এরপর আবার যমুনার পানির তোড়ে ভেসে সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার ছিন্নার চরে। সেখান থেকে জামালপুর উপজেলার মাদারগঞ্জের ডাকাতিয়া চরে। শুনেছি এক মাস আগে আমাকে উদ্ধারের জন্য বাংলাদেশের বন বিভাগের ময়মনসিংহ অঞ্চল একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করেছে। সে কমিটি কত শক্তিশালী যে দীর্ঘ ৩৮ দিনেও আমাকে উদ্ধার করতে পারল না। আরো শুনেছি ভারত থেকে ৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ আসবে আমাকে উদ্ধারের জন্য আলোচনায়। কোন দিন তারা আসবে জানি না। তবে ততদিনে আমার অবস্থা কেমন হবে কে জানে? এখানে একটি কথা না বললেই নয়। আমলাদের ‘সরকারি আইন’ বলে একটা কথা আছে। দুই দেশের আমলারা দলছুট একটি হাতিকে উদ্ধারের জন্য যেভাবে ফাইলে লাল ফিতার চর্চা করছেন তাতে আমি হয়তো বেঁচেই থাকব না।
আমি একটি হাতি। গলাগাছ খাই, সুযোগ পেলে মানুষের ক্ষেতের ধান খাই। বানের পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছি দীর্ঘ ৩৮ দিন ধরে। আমাকে উদ্ধার করতে পারছে না বাংলাদেশের কর্তারা। আর রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পর সুন্দরবন ধ্বংস হলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দল যখন প্রাণ বাঁচাতে লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়বে তখন এরা কি করবে? বানের পানিতে ভেসে বেড়ানো জীবন বিপন্ন হাতি হয়ে হাজার মিলিয়ন ডলারের এ প্রশ্ন রাখছি বাংলাদেশের মানুষের কাছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।