Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভাদ্র মাসের তাল শ্রাবণেই বাজারে

প্রকাশের সময় : ২ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সরকার আদম আলী, নরসিংদী থেকে : বাংলা ও বাঙালির জনপ্রিয় ফল তাল। ভাদ্র মাসের প্রচÐ গরমে তাল পাকে বলে তালকে বলা হয় ভাদুরে ফল। আর ভাদ্র মাসের গরমকে বলা হয় তালপাকা গরম। বছর ঘুরে ভাদ্র মাস এলেই পাকা তালের মোহনীয় গন্ধ জানান দেয় এটা ভাদ্র মাস।
বাঙালিরা পাকা তাল দিয়ে মুখরোচক খাবার তৈরি করে। তালের পিঠা, তালের বড়া, তালের ক্ষীর বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাবার। যুগ যুগ ধরে বাঙালিরা ঘরে ঘরে এসব খাবার তৈরি করে নিজেরা খায় এবং অতিথি আপ্যায়ন করে।
‘ভাদ্র মাসের তাল না খেলে কালে ছাড়ে না বলে’ বাঙালি সমাজে প্রবাদও রয়েছে। তবে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এখন ভাদ্র মাসের পূর্বেই বাজারে পাকা তাল উঠতে দেখা যায়। এ বছর শ্রাবণের প্রথম দিক থেকেই বাজারে পাকা তাল উঠতে শুরু করেছে। দামও অত্যন্ত চড়া। এক হালি পাকা তালের দাম হাঁকা হচ্ছে ২শ থেকে ৩শ টাকা। তাল খেতে দুধ, চিনি, গুড়, কিশমিশ, বাদাম, নারকেল, সাগুদানা, আলুবুখারা ও বিভিন্ন গরমমসলার মতো বিভিন্ন দামি উপকরণ প্রয়োজন হয় বলে সাধারণ মানুষ এমনিতেই তাল খেতে খুব একটা আগ্রহী হয় না। এর উপর তালের দাম শুনে সাধারণ মানুষ এর ধারেকাছেও যায় না।
বাংলাদেশে তালের প্রাচুর্য ও জনপ্রিয়তার কারণে বাঙালির শিল্প-সাহিত্যে তাল ও তালগাছের উপর রচিত হয়েছে অনেক গল্পকথা, কল্পকথা, গান, কবিতা, প্রবাদ, প্রবচনসহ বিভিন্ন রচনাবলী।
প্রবীণজনেরা জানিয়েছেন, আজ থেকে ৩ দশক পূর্বেও বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে প্রচুর সংখ্যক তালগাছ ছিল। দিগন্তবিস্তৃত গ্রামগুলোতে তালগাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতো। সে সময় গ্রামগুলো চিহ্নিতকরণের প্রতীক ছিল তাল গাছ। কবি তাই নিজের গ্রামকে পরিচিত করেছেন ‘ঐ দেখা যায় তাল গাছ, ঐ আমাদের গাঁ’ বলে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে।’
এসব আকাশছোঁয়া তাল গাছে প্রচুর তাল ধরতো। পাকা তাল কখনো বাজারে বিক্রি হতে দেখা যেতো না। বাজারে তালের আষাঢ়ীও বিক্রি হতো না। মাঝে মধ্যে রাখালরা দু-একটা আষাঢ়ী অতি কষ্টে গাছ থেকে পেরে কাঁচি দিয়ে কেটে খেতো। ভাদ্র মাস এলে গাছ থেকে পাকা তাল দাপুড়-দুপুড় করে গাছের নীচে পরে থাকতো। পাকা তালের এসব দাপুড়-দুপুড় পতনকে পিঠে কিল পড়ার সাথে তুলনা করা হতো। কোন কারণে কেউ কারো পিঠে কিল মারলে বলতো পিঠে যেন তাল পড়েছে। গ্রামের যেসব পুকুর পাড়ের চারদিকে তালগাছ থাকতো তাকে বলা হতো তালপুকুর। নজরুল সাহিত্যে তালপুকুরকে কবিতায় স্থান দেয়া হয়েছে। নজরুল তার কবিতায় লিখেছেন, ‘বাবুদের তালপুকুরে হাবুদের ডাল কুকুরে।’ গ্রামের তালগাছের গোড়ায়ই থাকতো ভয়ংকর সব সাপেদের গর্ত। রাতের বেলায় গাছ থেকে পাকা তাল পরে বিষাক্ত সাপের শরীর থেঁতলে দিতো। সাপের উপর তালপড়া নিয়ে রচিত হয়েছে কল্পকথা।
তাল পতনে থেঁতলে যাওয়া সাপ নাকি তালকে বলে ‘কালা কালা কেচলি, তুই কেন আমারে ছেঁচলি।’ তখন তাল নাকি প্রত্যুত্তরে বলে, ‘জানিস না আমার জাতের ধারা? তুই কেন আছিলি আমার তলে খাড়া?’ প্রবীণ সাহিত্যিকদের মতে যদিও এটি একটি গল্পকথা। তবু এতে তালের প্রকৃত মাহাত্ম্যই বর্ণিত হয়েছে। অর্থ হচ্ছে, তাল পাকলেই গাছ থেকে ঝরে পরে যায়। এটাই প্রকৃত পাকা তালের বৈশিষ্ট্য। পাকা তাল কখনো গাছ থেকে পেরে কেউ খেতো না। গাছ থেকে পরলেই তাল খাবার উপযুক্ত হতো আজকাল বাজারে যেসব তাল আমদানী হয় তার বেশীরভাগই হচ্ছে পীড়কাটা বা গুচ্ছকাটা। যেসব কাঁচা তাল গুচ্ছ থেকে পেরে ঘরে রেখে পাকিয়ে বাজারে নিয়ে বিক্রি করা হয় সেসব তালকে বলা হয় পীড়কাটা তাল বা ইচঁড়ে পাকা তাল। এসব তালের স্বাদ হয় তেতো। পক্ষান্তরে যেসব তাল পেকে গাছ থেকে মাটিতে পড়ে সেসব তালই হচ্ছে প্রকৃত খাবার উপযুক্ত তাল। মানুষ যুগ যুগ ধরে গাছ থেকে পতিত তাল কুড়িয়ে নিয়ে খেতো। এছাড়াও তাল ও তাল গাছ নিয়ে বাঙালি সমাজে অনেক সুন্দর সুন্দর প্রবচন ও প্রবাদ রয়েছে। যেমন রয়েছে তাল পাখার ব্যবহার। গ্রামের নববধুরা ভাদ্রের প্রচÐ গরমে তালের পাখা দিয়ে বাতাস দিয়ে নতুন বরকে ঠান্ডা করে। দেশের গাঙ্গেয় উপত্যকাগুলোতে যুগ যুগ ধরে তালের নৌকার প্রচলন ছিল। স্থানীয়ভাবে এগুলোকে বলা হতো ‘কুন্দা’। এসব তালের নৌকা গাঙ্গেয় উপত্যকার ছেলে-মেয়েদের বিয়ের কাজে ব্যবহৃত হতো। গ্রামের ছেলে মেয়েরা ‘কাঁচা তাল পাকা তাল’ বাক্যটি দ্রæত উচ্চারণের প্রতিযোগিতা করে। গ্রামে ছোট ঘটনা বড় হলে তিলকে তাল বানানো বলে তিরস্কার করা হতো। এছাড়া তালের পানিতে চুন মিশিয়ে দই বানিয়ে গ্রামের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা তালের বটুতে বেড়ে খেলা করতো। আজ আর সে দিন নেই। গ্রামের বড় বড় তাল গাছগুলোকে কেটে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। তাল কাঠের নামে আলাদা তাল কাঠের দোকান সাজিয়ে তালের কাঠ বিক্রি করা হচ্ছে। বর্তমান সল্পসংখ্যক তাল গাছে যাও কিছু তাল ধরে তার বেশিরভাগই বিক্রি হয় আষাঢ়ী হিসেবে। শহরের অলি-গলিতে বিক্রি হয় তালের আষাঢ়ী। যার ফলে তাল বলতে এখন আর বেশি কিছু অবশিষ্ট থাকে না। বলতে গেলে দেশে এখন পাকা তালের খুবই সংকট। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীরা ১০ টাকা হালির তাল এখন বিক্রি করছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা হালি দরে।
এছাড়াও তালে রয়েছে বিভিন্নমুখী অর্থ। তালের একটি অর্থ হচ্ছে এক বিঘৎ পরিমাপ। আরেক অর্থ হচ্ছে ধাক্কা, ধকল ও আকষ্মিক বিপদ, কোন কিছুর পিন্ড বা দলাকে তাল বলা হয়। কোন কিছুর সাথে কোন কিছু মিশিয়ে ফেললে তাকে বলা হয় তালগুল পাকানো। হিন্দু ধর্মে তাল ও বেতাল নামে দুটি শব্দ রয়েছে। এ দুজনই পিশাচ। রাজা বিক্রমাদিত্য এদেরকে নিজের অনুচরে পরিণত করে ছিলেন। সংগীতের বিভাগ বা মাত্রাকে তাল বলা হয়। ক্ষীণদেহী ব্যক্তিদেরকে বলা হয় তালপাতার সেপাই। তাল গাছে যে বাবুই পাখী থাকে তাদেরকে বলা হয় তালচোঁচ। বেদান্তিকরা ভাদ্রমাসের শুক্লা নবমীকে তাল নবমী বলে থাকে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভাদ্র মাসের তাল শ্রাবণেই বাজারে
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ