Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আপাদমস্তক প্রতারক ১০ দিনের রিমান্ডে

প্রকৃতপক্ষে ধুরন্ধর, অর্থলিপ্সু ও পাষণ্ড প্রকৃতির লোক : ডিবির প্রতিবেদন

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১৭ জুলাই, ২০২০, ১২:০১ এএম

রিজেন্ট হাসপাতালের এমডি মাসুদ পারভেজ ১০ এবং শিবলী ৭ দিনের রিমান্ডে

আত্মগোপনে থাকার পর র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার মো. সাহেদ আদালতেও ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটালেন। কড়া পুলিশি পাহারায় গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার সিএমএম আদালতে আনার পর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কান্নাজুড়ে দেন এই প্রতারক। শুধু তাই নয়, নিজেকে করোনায় আক্রান্ত বলেও দাবি করেন দেশজুড়ে আলোচিত সাহেদ। কোমরে মোটা দড়ি বেঁধে তাকে আদালতে হাজির করা হয়। সাহেদের গায়ে ছিল নীল রঙের শার্ট, শরীরে বুলেট প্রæফ জ্যাকেট, মাথায় হেলমেট, চোখে কালো চশমা। আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি নিজের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন।

অন্যদিকে করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে প্রতারণা এবং রোগীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার কথা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাহেদ স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. আব্দুল বাতেন। সাহেদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডে পাওয়ার পর গতকাল দুপুরে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।

এছাড়া রিজেন্ট হাসপাতালের এমডি মাসুদ পারভেজের ১০ এবং সাহেদের আরেক সহযোগী ও রিজেন্ট হাসপাতালের কর্মী তরিকুল ইসলাম ওরফে তারেক শিবলীর ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল বৃহস্পতিবার আদালত এ আদেশ দেন। মো. সাহেদের গোপন অফিস থেকে জালটাকা উদ্ধারের ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা দায়ের করেছে র‌্যাব। গতকাল র‌্যাবের পক্ষ থেকে এ মামলা করা হয়।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু বলেন, আদালতে মো. সাহেদ বলেছেন যে, তিনি নিজেই করোনাভাইরাস রোগী। অভিযুক্তরা করোনাভাইরাসের ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে রাষ্ট্রের ক্ষতি করেছেন। এমনকি বিদেশ থেকেও এজন্য অনেককে ফেরত আসতে হয়েছে। তাই তদন্তের স্বার্থে রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুরের অনুরোধ করেছিলেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।

আদালতকে প্রতিবেদন দিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) বলেছেন, সাহেদ নিজেকে ক্লিন ইমেজের লোক বলে দাবি করেন। তবে প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রকৃতপক্ষে সাহেদ একজন ধুরন্ধর, অর্থলিপ্সু ও পাষন্ড প্রকৃতির লোক। অর্থ হাতিয়ে নেয়ার প্রশ্নে তার কাছে মানুষের জীবন-মৃত্যুর কোনো মূল্য নেই। সাহেদ তার সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট ও চিকিৎসা দেয়ার নামে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সাহেদের প্রতারণার বিষয়টি জানার পর কোনো রোগী যদি প্রতিবাদ করতেন, তাদের তিনি বিভিন্নভাবে হুমকি দিতেন। এর ফলে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পেতেন না। গত মার্চ মাস থেকে এখন পর্যন্ত সাহেদ করোনার ভুয়া রিপোর্ট ও চিকিৎসার প্রতারণার মাধ্যমে তিন থেকে চার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

১০ দিনের রিমান্ডে সাহেদ
করোনাভাইরাস নমুনা পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে দায়ের করা মামলায় সাহেদকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। একই মামলায় তার দুই সহযোগীরও রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। রিজেন্ট হাসপাতালের এমডি মাসুদ পারভেজকে ১০ দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়েছে। সাহেদের আরেক সহযোগী ও রিজেন্ট হাসপাতালের কর্মী তরিকুল ইসলাম ওরফে তারেক শিবলীর ৫ দিনের রিমান্ড শেষে আবার সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসিম শুনানি শেষে রিমান্ডের এই আদেশ দেন।

এর আগে ডিবির পুলিশ পরিদর্শক গাফফারুল আলম সাহেদ, মাসুদ পারভেজ ও তারেক শিবলীকে আদালতে হাজির করে তাদের ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। তিনি উত্তরা পশ্চিম থানায় দায়ের হওয়া প্রতারণা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। শুনানি শেষে আদালত রিমান্ডের আদেশ দেন। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সাহেদকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে নেয়া হয়। বুধবার সকালে সাতক্ষীরায় গ্রেফতার করে ঢাকায় আনার পর রাতে তাকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) হাজতখানায় রাখা হয়। সাহেদের মামলা তদন্ত করছে ডিবি। এর আগে বুধবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে সাতক্ষীরার দেবহাটা সীমান্ত থেকে অবৈধ অস্ত্রসহ সাহেদকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তার বিরুদ্ধে দেবহাটা থানায় অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেফতারের পরই তাকে হেলিকপ্টারে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।

প্রতারণার কথা স্বীকার সাহেদের : ডিবি
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. আব্দুল বাতেন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে প্রতারণার কথা স্বীকার করেছে। এছাড়া রিজেন্ট হাসপাতালের বেশ কিছু মেশিনপত্র র‌্যাবের অভিযানের আগেই সরিয়ে ফেলার কথাও বলেছেন। সেসব মেশিন দিয়ে কী করা হত, সেগুলো এখন কোথায় রাখা হয়েছে, সে বিষয়েও সাহেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে জানিয়ে এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, তাকে রিমান্ড আনা হয়েছে, দেখা যাক জিজ্ঞাসাবাদে কী কী বলেন।

তিনি আরো বলেন, সাহেদ রিজেন্ট হাসপাতালে করোনা পরীক্ষার নামে বিভিন্ন মানুষকে যে জাল সনদ দিয়েছে, তাতে শুধু মৃত্যুর কোলেই ফেলে দেয়া হয়নি, হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। একইসঙ্গে তার এ ধরনের কর্মকান্ডে দেশের ভাবমর্যাদাও ক্ষুন্ন হয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের প্রতারণা করে আসছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। তার সব ধরনের প্রতারণা সুচারুভাবে বের করতে তদন্ত করা হবে।

কাঠগড়ায় কান্না, আমি নিজেও করোনা রোগী
আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাহেদ বললেন, আমি নিজেও করোনা রোগী। আমার বাবা করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। একমাত্র আমিই বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসা সেবা দেই। আমি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই। গতকাল ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে তোলা হলে রিমান্ড শুনানির মাঝখানে বিচারককে তিনি এসব কথা বলেন।

ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু বলেন, কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আসামি সাহেদ একসময় কাঁদতে থাকেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, করোনায় আমার বাবা মারা গেছে। আমরা তাকে বলি, শান্ত হোন, আগেই এটা বোঝা উচিৎ ছিল আপনার।

সাহেদের আইনজীবী মনিরুজ্জামান রিমান্ডের বিরোধিতা করে বলেন, কোনো কথিত ভুক্তভোগী এ মামলা করেনি, করেছে পুলিশ। অথচ তার কাছ থেকে (সাহেদ) ব্যাপকভাবে সাধারণ জনগণ উপকৃত হয়েছে। তার অনেক শুভানুধ্যায়ী রয়েছেন, যারা তার কাছে থেকে কোনো বিনিময় ছাড়া উপকৃত হয়েছেন।

অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু রিমান্ড আবেদনের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন, এই সাহেদ বিদেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করেছে। তার কারণে ইতালি থেকে বাংলাদেশি শ্রমিক, প্রবাসী কর্মীদের ফেরত আসতে হয়েছে। তিনি পরীক্ষা না করেই ভুয়া করোনা সার্টিফিকেট দিয়েছেন। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। তারা একটা চক্র। এ চক্রের আরো লোকজনের নাম ঠিকানা জানার জন্য, আরো তথ্য উদ্ধারের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করতে ১০ দিনের রিমান্ডে দেয়া হোক।

রাষ্ট্রপক্ষের এই পিপির কথায় সমর্থন দিয়ে অতিরিক্ত পিপি কে এম সাজ্জাদুল হক শিহাব বলেন, ৬ হাজারে বেশি ভুয়া করোনা পরীক্ষার সার্টিফিকেট আসামিরা দিয়েছিল। প্রত্যেক সার্টিফিকেটের জন্য ৪/৫ হাজার টাকা আদায় করত তারা। তারা বড় রকমের ধড়িবাজ, প্রতারক।

সাহেদের বিরুদ্ধে জাল টাকার মামলা দায়ের
উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা জানান, উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর সড়কের একটি বাসা থেকে জালটাকা উদ্ধারের ঘটনায় র‌্যাবের একজন এসআই মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে সাহেদকে। এছাড়া রিজেন্টের এমডি মাসুদ পারভেজসহ অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রতারণাসহ নানা অপকর্মের ঘটনায় ইতঃপূর্বে সাহেদের বিরুদ্ধে ৬০টি মামলার সন্ধান পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যার মধ্যে একাধিক মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক আসামি ছিলেন সাহেদ।



 

Show all comments
  • গোলাম মোস্তফা চঞ্চল ১৭ জুলাই, ২০২০, ১১:৩৮ এএম says : 0
    আমিতো মনেকরি যে, এই মহা প্রতারক সাহেদ-এর স্বপক্ষে আদালতে যেসকল আইনজীবীরা জেরায় অংশগ্রহন করেছেন, তাহারাও নিঃসন্দেহে জাতীর সাথে প্রতারণা মূলক কর্মকান্ডেই অংশগ্রহন করছেন।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সাহেদ

৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ