Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রামে মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস

প্রকাশের সময় : ১৮ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : নতুন বছরের শুরুতে ঘরভাড়া বেড়েছে। স্কুল-কলেজে বাড়ানো হয়েছে ভর্তি ও টিউশন ফি। গেল বছরের শেষদিকে বেড়েছে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম। সেই সাথে বেড়েছে গণপরিবহনের ভাড়াও। বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি এবং সরকারের দেয়া পে-স্কেলের অজুহাতে পণ্যমূল্যও বাড়ছে হু হু করে। কিন্তু সে অনুযায়ী সাধারণ মানুষের বেতন কিংবা আয় বাড়েনি। এতে করে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায় নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত পর্যন্ত সব শ্রেণীর মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। সরকারি পে-স্কেলভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যতীত অন্য চাকরিজীবীদের বেতন তেমন একটা বাড়েনি। শ্রমজীবী নিম্নআয়ের লোকজনের অবস্থাও আগের মত আছে। অর্থনীতিতে মন্দার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বড় বড় ব্যবসায়ীরা কোনো রকমে টিকে থাকলেও ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের অবস্থা এখন নাজুক। এ অবস্থায় নানামুখী ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দিশেহারা সাধারণ মানুষ। গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কয়েক মাস পর ঘোষণা করা হয় পে-স্কেল। এ ঘোষণার পরে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আর এর প্রথম শিকার হচ্ছে স্বল্প আয়ের সাধারণ মানুষ। নতুন বছরের শুরুতে স্কুলে স্কুলে শুরু হয়েছে ভর্তিযুদ্ধ। ভর্তিযুদ্ধে উত্তীর্ণ হওয়া শিক্ষার্থীদের স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছেন অভিভাবকেরা। কারণ নগরীর বেশিরভাগ স্কুলে ভর্তি ফি প্রায় দ্বিগুণ করে দেয়া হয়েছে। বেসরকারি প্রায় প্রতিটি স্কুলেই টিউশন ফিও বাড়ানো হয়েছে শতভাগ। কোনো কোনো স্কুলে আরও বেশি ভর্তি ও টিউশন ফি আদায় করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত সবগুলো স্কুলের টিউশন ফি শতভাগ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মহানগরীতে সরকারি স্কুলের সংখ্যা হাতে গোনা। এ কারণে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে বাধ্য হয়।
পে-স্কেল ঘোষণার অজুহাতে সব বেসরকারি স্কুল ইচ্ছেমতো ভর্তি ও টিউশন ফি বাড়িয়ে দিয়েছে। এর প্রতিবাদে অভিভাবকেরা বিভিন্ন এলাকায় মিছিল-সমাবেশ-মানববন্ধন করছে। নৌবাহিনী স্কুলের অভিভাবকেরা মানববন্ধন করতে গিয়ে পুলিশি হামলার শিকার হন। মহানগরীর অন্যতম ঐতিহ্যবাহী স্কুল বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা স্কুল এন্ড কলেজের অভিভাবকেরাও শনিবার বর্ধিত ফি কমানোর দাবিতে মানববন্ধন করেছে। সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত স্কুলের অভিভাবকেরা নগর ভবন ঘেরাওসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। ক্ষুব্ধ অভিভাবকেরা বলছেন, হঠাৎ করে ভর্তি ও টিউশন ফিসহ স্কুলের আনুষঙ্গিক খরচ একশ’ ভাগ কোথাও তারও বেশি বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বছরের শুরুতে নতুন বই, খাতা শিক্ষার্থীদের ইউনিফর্মসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে অভিভাবকদের এমনিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার উপর একলাফে ফি দ্বিগুণ করে দেওয়ায় সঙ্কটে পড়েছেন অভিভাবকেরা। স্কুল কর্তৃপক্ষ ফি বাড়ানোর পক্ষে নানা যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করছেন। এতে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না অসহায় অভিভাবকেরা। তবে কার কাছে গেলে এর সমাধান মিলবে সেটাও বুঝতে পারছেন না অভিভাবকেরা।
বছরের শুরুতেই নগরীতে বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর হিড়িক পড়েছে। বাড়িওয়ালারা আগেভাগেই নোটিশ দিয়ে বাড়ি ভাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছেন। নগরীর কয়েকটি এলাকায় ভাড়াটিয়াদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবছর নতুন বছরের শুরুতে ভাড়া বাড়ানো হয়। তবে এবার বিদ্যুৎ এবং চট্টগ্রাম ওয়াসার পানির দাম বাড়ানোর অজুহাতে ব্যাপকহারে ঘরভাড়া বাড়ানো হচ্ছে। কোনো কোনো বাড়িওয়ালা এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা ঘর ভাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমনিতেই বাড়ি ভাড়া আদায়ে কোনো নিয়মনীতি কেউ মানছে না। তার উপর নানা অজুহাতে চলছে ভাড়া বৃদ্ধি। বাড়িওয়ালাদের লাগাম টেনে ধরতে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও তা বাস্তবে দেখা যাচ্ছে না। এতে করে অসহায় হয়ে পড়েছেন ভাড়াটিয়ারা। গেল বছরের শেষ দিকে সরকার গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। আবাসিক খাতে গ্যাসের চুলা বাবদ ২০০ টাকা করে দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের দামও বেড়েছে। বর্ধিত দামের পাশাপাশি ভুতুড়ে বিল দিচ্ছে পিডিবির লোকজন। মহানগরীর বেশিরভাগ এলাকার গ্রাহকদের অভিযোগ, ইচ্ছেমতো বিল করে দিচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন। এতে করে অতিরিক্ত টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে গ্রাহকদের। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে গণপরিবহনের ভাড়া বেড়েছে অস্বাভাবিকহারে। মহানগরীতে নিজস্ব পরিবহন আছে এরকম মানুষের সংখ্যা কম। বেশিরভাগ মানুষই গণপরিবহনের উপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে কর্মজীবী এবং শ্রমজীবীদের পুরোটাই গণপরিবহনে যাতায়াত করছে। ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় যাতায়াত খাতেও ব্যয় বেড়েছে।
গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে বাজারে প্রায় প্রতিটি জিনিসের মূল্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দেশে আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। গ্রামের কৃষক ধানের দাম পাচ্ছে না। অথচ চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। সাধারণ মানুষ বেশি দামে চাল কিনছে। শীতের ভরা মৌসুমেও বাজারে শাকসবজির দাম ঊর্ধ্বমুখী। ব্যবসায়ীরা এজন্য পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি এবং পথে পথে চাঁদাবাজিকে দুষছেন। বাজারে গিয়েও সাধারণ মানুষকে অস্বস্তিকর পরিবেশের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সর্বক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায় সাধারণ মানুষের অবস্থা কাহিল। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের লোকজন কঠিন সঙ্কটে পড়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সংসার পরিচালনা এবং সন্তানদের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের অবস্থাও এখন শোচনীয়। নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তরাও সংসার পরিচালনা করতে হিমশিম খাচ্ছে।
কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রামের নেতা এস এম নাজের হোসেন বলেন, সরকারের যথাযথ নীতিমালা ও নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সবকিছুর মূল্য বাড়ানো হচ্ছে। সাধারণ মানুষ এতে করে চরম দুর্ভোগের মুখোমুখি হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে ভোক্তাদের সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যেখানে সরকার কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না সেখানে ভোক্তাদের নিজেদের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তিনি বলেন, অভিভাবকদের প্রতিবাদের মুখে ইতোমধ্যে নৌবাহিনী স্কুলে বর্ধিত ফি কিছুটা কমানো হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ স্কুলে অতিরিক্ত ফি আদায় করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে আমরা কোনো সদুত্তর পাইনি। শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছেন। মতামত পেলে পরবর্তী সময়ে স্কুলগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু এর মধ্যে স্কুলগুলো অতিরিক্ত ভর্তি ফি ও পুনরায় ভর্তি ফি আদায় করে নিচ্ছে। বাড়ি ভাড়া আইন অত্যন্ত পুরনো এবং এটি ভাড়াটিয়াদের পক্ষে নয় দাবি করে তিনি বলেন, এ আইনটি সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়ার কথা হলেও সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ কমিশন গঠন করার নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রামে মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ