Inqilab Logo

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মরা গরু নিয়ে বিপাকে নরেন্দ্র মোদী

প্রকাশের সময় : ৩১ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৩০ পিএম, ৩০ জুলাই, ২০১৬

স্টালিন সরকার : ভারতের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকা গেয়েছেন ‘পদ্মা আমার মা/ গঙ্গা আমার মা’ অথচ ভারতের উচ্চবর্ণের হিন্দুরা এখন বলছেন ‘গরু আমার মা’। গরুকে ‘মায়ের মর্যাদা দেয়ায় ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ’ প্রবাদের মতোই অর্থনৈতিক ক্ষতি স্বীকার করেও বাংলাদেশে গরু রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয় কয়েকটি রাজ্যে গরুর গোসত খাওয়া নিষিদ্ধ করেছে। গরুর গোসত খাওয়া নিয়ে খুনাখুনিও হয়েছে। সেই গরু নিয়ে বিপাদে পড়ে গেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দমোদর মোদী। না, জীবিত গরু নয়; মরা গরু নিয়েই হয়েছে তার এই মহাবিপদ। জাত-পাতের কারণে দেশের নি¤œবর্ণের দলিত সম্প্রদায়কে অবজ্ঞা করায় তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে রাস্তাঘাট থেকে মরা গরু সরাবে না। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের উদ্দেশ্যে তাদের বক্তব্যÑ‘গরু তোমাদের মা। রাস্তাঘাটে ও গোয়ালে মরে পড়ে থাকা গরু তোমরাই সরাও’। কয়েক দিন থেকে গুজরাটের বাড়িঘর থেকে শত শত মরা গরু না সরানোয় দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে বাতাসে। হাট-বাজার ও রাস্তা-ঘাটে চলাফেরা করা দায় হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের। বিশেষ করে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা মরা গরুর দুর্গন্ধে টিকতে পারছেন না। কিন্তু দলিতদের স্পষ্ট বক্তব্য রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সমান মর্যাদা দিতে হবে। না হলে তোমাদের মা গরু। তোমরাই মরা গরুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কর।
কট্টর হিন্দুত্ববাদী আরএসএসের ভাবশীষ্য নরেন্দ্র মোদীকে মরা গরু নিয়ে ‘উচিত শিক্ষা’ দিয়েছে ভারতের গুজরাটের দলিত (মেথর) সম্প্রদায়ের হিন্দুরা। বিপদে পড়ে ‘গরু মাতা’ শব্দটি ভুলতে বসেছেন নরেন্দ্র মোদী সরকার। অথচ ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপির ক্ষমতায় আসার পর নরেন্দ্র মোদীর সরকার গৃহপালিত পশু গরু নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ‘মহা রাজনীতি’ শুরু করেছেন। বাংলাদেশে গরু রফতানি এবং অবৈধভাবে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। প্রজ্ঞাপন জারি করে ভারতে বসবাসরত মুসলমানদের গরুর গোশত খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে ‘গরু হিন্দুদের মা’ অজুহাতে। গরুর গোশত খাওয়ায় মানুষকে খুন করেছে এবং ক’দিন আগেও বোরকা পরিহিত দুই মহিলার কাছে গরুর গোশত রয়েছে অভিযোগে তাদের নাজেহাল করেছে। সেই গরু নিয়ে এখন বিপাকে পড়ে গেছেন নরেন্দ্র মোদী। দলিত সম্প্রদায় স্পষ্ট করে মোদীর অনুসারীদের জানিয়ে দিয়েছে মরা গরুর লাশ এখন থেকে তোমরাই পরিষ্কার করবে। ঘটনাটি নরেন্দ্র মোদীর জন্য ‘ঢিল ছুঁড়ে পাটকেল খাওয়ার অবস্থা’। ধর্মগত জাতপাত চর্চায় মানুষ্যবোধবিবর্জিত ‘চেতনা’ উচ্চবর্ণ নি¤œবর্ণ ভারতে সমাজে এখনো বিদ্যমান। নি¤œবর্ণের দলিত হিন্দু সম্প্রদায়কে অচ্ছুত হিসেবে দেখে থাকে ভারতের তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দুরা। সেই নি¤œবর্ণের হাতে মরা গরু ইস্যুতে নাস্তানাবুদ অবস্থা উচ্চবর্ণের শাসক দল নরেন্দ্র দমোদর মোদীর বিজেপি। সেটা আবার মোদীর নিজ রাজ্য গুজরাটেই শুরু! খবর দিয়েছে এনডিটিভি ও দ্য হিন্দু।
কাশ্মীরে নিত্যদিন যেমন মুসলিম হত্যা চলছে; তেমনি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে দলিত সম্প্রদায় নানাভাবে লাঞ্ছিত-নিগৃহীত হচ্ছে। গুজরাটের উনা নামক শহরে দলিত সম্প্রদায়ের উপর জুলুম নির্যাতনের খবর চাউড় হয়ে গেছে দেশে-বিদেশে। ছড়িয়ে পড়েছে নির্যাতনের শিকার দলিত সম্প্রদায়ের প্রতিবাদের খবরও। জাতপাতের কারণে ভারতে দলিত সম্প্রদায়কে সামাজিকভাবে অচ্ছুত মনে করায় কার্যত তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হন। ইচ্ছে করলে দলিতরা কোনো হোটেলে প্রবেশ করে খেতে পারেন না। হেটেলে এবং রেস্তোরাঁয় দলিতদের জন্য আলাদা প্লেট-গ্লাস-চায়ের কাপ ব্যবহার করা হয়। এমনকি তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতে দলিতরা ঠিকভাবে ধর্মকর্মও করতে পারেন না। সম্প্রতি মন্দিরে প্রবেশে বাধা দেয়ার প্রতিবাদে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তামিলনাড়–র ২৫০টি দলিত পরিবার। এ ঘটনা ঘটে ওই রাজ্যের বেদারণ্যম ও কারুর জেলায়। এখন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনী এলাকায় গুজরাটে চলছে দলিত নির্যাতন। নি¤œবর্ণের হিন্দুদের উপর রাষ্ট্রীয়ভাবেই নানাভাবে জুলুম-নির্যাতন করা হচ্ছে। গত ১১ জুলাই মরা গরুর চামড়া ছাড়ানোর অপরাধে (!) দলিত সম্প্রদায়ের কয়েকজনের উপর নির্যাতন চালায় কট্টরপন্থী হিন্দু সংগঠন গো-রক্ষা সমিতি। এরা আরএসএসের ভাবশিষ্য। এ ঘটনার পর প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন রাজ্যের সুবিধাবঞ্চিত দলিত সম্প্রদায়। তখন থেকে চলছে বিতর্ক আর প্রতিবাদ। ভারতের উচ্চবর্ণের হিন্দুদের শিক্ষা দিতেই প্রতিবাদ হিসেবে গুজরাটের উনাসহ বিভিন্ন শহর আর গ্রামের গোয়াল ঘরে পড়ে থাকা মরা গরু সরানোর কাজ থেকে বিরত রয়েছেন দলিত সম্প্রদায়। মরা গরু রাস্তায়-খামারে, পথে-ঘাটে পড়ে থাকায় দুর্গন্ধে টেকা দায় হয়ে গেছে সাধারণ মানুষের। দ্য হিন্দু পত্রিকার খবরে বলা হয় গুজরাটের বিভিন্ন শহরের রাস্তায় অন্তত ৫শ’ থেকে হাজার মরা গরু পড়ে রয়েছে। কয়েক দিন থেকে পচাগলা গরু পড়ে থাকায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে চতুর্দিকে। কিন্তু নির্যাতনের প্রতিবাদে এসব মরা গরু সরাচ্ছেন না দলিত সম্প্রদায়ের লোকজন। তারা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ওই মরা গরু সরানোর দাবি জানাচ্ছেন। তারা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের উদ্দেশ্যে বলছেনÑ ‘গরু তোমাদের মা, তোমরাই মরা গরু পরিষ্কার কর। আমরা হাত দেব না। মায়ের লাশের সৎকার করা তোমাদের দায়িত্ব’। এ নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘরে-বাইরে মুখোমুখি হচ্ছেন নানান প্রশ্নের। বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেছেন তিনি। মরা গরুর দুর্গন্ধে টিকতে না পেরে সংবাদ সম্মেলন করে অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু বিব্রত প্রধানমন্ত্রী ‘লা জবাব’।
এনডি টিভির খবরে বলা হয়Ñ পরিস্থিতি বেগতিক দেখে প্রশাসনের লোকজন ট্রাক দিয়ে মরা গরু সরানোর প্রস্তাব করেছে। প্রতি মরা গরু সরানোর আগে ২শ’ টাকা দেয়া হতো। এখন প্রতি গরুতে ৫শ’ টাকা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। মরা গরুর বিকট দুর্গন্ধ বাতাসে এমনভাবে ছড়াচ্ছে যে, রাস্তা দিয়ে মানুষের চলাচল করা দায় হয়ে গেছে। ‘ঠেলার নাম বাবাজি’ প্রবাদের মতো স্থানীয় প্রশাসন থেকে একটি মরা গরু সরানোর জন্য এক হাজার টাকা পর্যন্ত দেয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে। কিন্তু দলিত সম্প্রদায় কোনো প্রস্তাবই মানছেন না। তারা নিজেদের অধিকারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন। তাদের দাবি আমরা টাকা চাই না নাগরিক অধিকার চাই। এক দেশে কেউ প্রথম শ্রেণির নাগরিক কেউ দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক থাকতে পারে না। অথচ বাস্তবতা হলো উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রতিনিধিত্বকারী বিজেপির সরকারের পক্ষে কোনোভাবেই এ দাবি মেনে নেয়া সম্ভব নয়। এ ঘটনায় ভারতের বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশ দলিত সম্প্রদায়ের পক্ষ নিয়েছেন। তারা এ নিয়ে লেখালেখি করছেন-বিবৃতিও দিচ্ছেন। বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্যÑ ‘কাজ কাজই, শ্রম বিভাজন হলো শ্রম বিভাজন, জাতপাতের দোহাই দিয়ে আর এত বড় সম্প্রদায়কে অচ্ছুত করে রাখা অমানবিক। নাগরিক হিসেবে সাংবিধানিকভাবে সবার সমান অধিকার দেয়া উচিত। দলিতদের একটি অংশ তাদের অধিকার আদায়ের চলমান সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে গুজরাটের আহমেদাবাদে সমাবেশ ডেকেছে। এনডিটিভির খবর মতে সেখানে অন্তত ১০ হাজার দলিত যোগ দেবেন। আশপাশের রাজ্য থেকে দলিত সম্প্রদায়ের লোকজন আহমেদাবাদে যাওয়া শুরু করেছেন। সাংবিধানিকভাবে দলিতদের নাগরিক হিসেবে সমান অধিকারের দাবিতে কিছুদিন আগে হায়দরাবাদের রোহিত ভেমুলা নামের এক দলিতছাত্র আত্মহত্যা করেন। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই উনায় ঘটে গেল নতুন করে নির্যাতনের ঘটনা। সেই নির্যাতনের জের ধরে দলিতরা গোটা রাজ্যে শুরু করেছে আন্দোলন। তারা নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার না পাওয়া পর্যন্ত মরা গরু সরাবে না এবং আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। গরু নিয়ে বড়াই করা নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকার মরা গরু নিয়ে এখন কি করেন সেটাই এখন দেখার বিষয়। কারণ নাগরিক হিসেবে দলিতদের সমান অধিকার না দেয়ায় মরা গরুর দুর্গন্ধই শুধু ছড়াচ্ছে না; গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দুর্বলের প্রতি আগ্রাসী নীতিতে বিশ্বাসী ভারতের ভাবমূর্তিও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।

 



 

Show all comments
  • Raihan ৩১ জুলাই, ২০১৬, ২:০৮ এএম says : 0
    Problems.....!!
    Total Reply(0) Reply
  • সোলায়মান ৩১ জুলাই, ২০১৬, ১:২৯ পিএম says : 0
    এই জাত বৈষম্য দূর হওয়া দরকার।
    Total Reply(0) Reply
  • Bulbul Ahmad ৩১ জুলাই, ২০১৬, ১:৩৪ পিএম says : 0
    amar mote tader ai andolon logical .
    Total Reply(0) Reply
  • সবুজ ৩১ জুলাই, ২০১৬, ১:৩৫ পিএম says : 0
    রাষ্টের সকল মানুষকে সমান অধিকার দেয়া উচিত।
    Total Reply(0) Reply
  • Arif ৩১ জুলাই, ২০১৬, ২:০২ পিএম says : 0
    এবার লও ঠেলা,
    Total Reply(0) Reply
  • সিফাত ৩১ জুলাই, ২০১৬, ২:০৩ পিএম says : 0
    প্রতিবাদের অভিনব ভাষা।
    Total Reply(0) Reply
  • amir ৩১ জুলাই, ২০১৬, ৫:৩২ পিএম says : 0
    HAHAHHAHA EBAR BUJO THELA KOTO DANE KOTO CAL .................
    Total Reply(0) Reply
  • শরৗফ ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ৭:১১ পিএম says : 0
    নরেন্দ্র মোদি এর ফলাফল পাবে আগামী জানুয়ারির নিবাচনে. মুসলিমরা নরেন্দ্র মোদি এবং তার পাটৗকে ঘৃনা করে .
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মরা গরু নিয়ে বিপাকে নরেন্দ্র মোদী
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ