Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

থেমে নেই মানবপাচার

সুবিধাভোগী ও মদতদাতারা আড়ালে : সক্রিয় ৪ শতাধিক সদস্য

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৫ জুলাই, ২০২০, ১২:০০ এএম


পাচারকারী ও দালাল চক্রের তালিকা হালনাগাদ হচ্ছে
মানবপাচারকারীদের পাল্লায় পড়ে একটু স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের আশায় অনেকটা জেনেশুনেই অনেক যুবক ঝাঁপ দিচ্ছেন নিশ্চিত মৃত্যুকূপে। মরুভূমির উত্তপ্ত বালুরাশি, পাহাড়-পর্বত আর বিপৎসংকুল গভীর বনজঙ্গল হেঁটে পাড়ি দিচ্ছেন তারা। পদে পদে মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই ১০-১২টি দেশ পেরিয়ে পৌঁছেছেন স্বপ্নের ইউরোপ বা আমেরিকার কোনো দেশে।

প্রথমে দালাল চক্রের মাধ্যমে তাদের দেশ থেকে পার করা হয়। পরে নির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে তাদের ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। কান্নার শব্দ শুনিয়ে স্বজনদের কাছ থেকে আদায় করা হয় লাখ লাখ টাকা। মানুষ মাছের মতো বিক্রি হয়ে এক হাত থেকে আরেক হাতে যেত। বড় ধরনের কোন ঘটনার পর মানবপাচারকারীরা ধরা পড়লেও সুবিধাভোগী ও মদদ দাতাসহ মূলহোতারা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে সব সময়। একটি দায়িত্বশীল সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, সম্প্রতি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠানো একটি সংস্থার প্রতিবেদনে প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের বরাত দিয়ে পাচারকারীদের অত্যাচার ও নির্যাতনের নির্মম চিত্র তুলে ধরা হয়। কীভাবে ফুসলিয়ে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে কিংবা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে সমুদ্রপথে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় তার তথ্য পাওয়া গেছে। সমুদ্রে গিয়ে পাচারকারীদের হাতে কীভাবে বারবার বিক্রি হয়েছে তাও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে মুক্তিপণও।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই তাদের বেচাকেনা করা হয়েছে। একজন পাচারকারীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানুষ মাছের মতো বিক্রি হয়ে এক হাত থেকে আরেক হাতে গেছে। এ কারণে দাম (মুক্তিপণ) বেড়েছে। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চক্রের সদস্যরা অভিবাসন প্রত্যাশীদের নৌকায় তোলার পরই জিম্মি করে ফেলত। তাদের জন্য তখন তিনটি পথ খোলা ছিল। এক. টাকা দিয়ে মুক্তি পাওয়া। দুই. আরেক চক্রের কাছে বিক্রি হওয়া। তিন. বন্দি অবস্থায় মারা যাওয়া।

সূত্র জানায়, একটি গোয়েন্দা সংস্থা দেশের ১৮টি জেলাকে মানবপাচারের জোন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এসব জেলায় সক্রিয় মানবপাচারকারী ও দালাল চক্রের ৪ শতাধিক সদস্য। মানবপাচারের গ্রুপগুলো দেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, নরসিংদী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, নড়াইল, বরগুনা ও ঢাকায় বেশি সক্রিয়। সম্প্রতি লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশিকে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যাকান্ডের পর কোন জেলায় কে বা কারা মানবপাচার ও দালাল চক্রের সদস্য হিসেবে কাজ করছে ইতোমধ্যে গোয়েন্দা সংস্থা তা চিহ্নিত করেছে।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, লিবিয়ার ঘটনার পর আইজিপি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেন। তিনি র‌্যাব, রেঞ্জ ডিআইজি, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপারদের বিশেষ নির্দেশনা দেন। তাছাড়া পুলিশ সদর দফতর মানবপাচারকারীদের তালিকার কাজ শুরু করে। এসব পাচারের সাথে ২০টি ট্রাভেল এজেন্সি জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব বিষয় নিয়ে কাজ করছে পুলিশ।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, লিবিয়ার ঘটনার পর ২৬টি মামলায় প্রায় ৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। সিআইডি ছাড়াও মানবপাচারকারীদের গ্রেফতার অভিযান চালাচ্ছে থানা-পুলিশ, র‌্যাব ও ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। এ পর্যন্ত ৬০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে দু’একজন ছাড়া বাকি সবাই দেশিয় দালাল চক্রের সদস্য। মুক্তিপণ আদায়কারীদের মদদদাতা বা নেপথ্যে থেকে মানবপাচারকারীদের যারা সাহায্য করছে তারা সবসময়ই থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।

র‌্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, মানবপাচারকারীদের গ্রেফতারে কাজ করছে র‌্যাব। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে হাজী কামাল নামে একজন মূলহোতা রয়েছে। এর সাথে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে র‌্যাব কাজ করছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ডিআইজি (অর্গানাইজড ক্রাইম) মো. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেছেন, সিআইডি মানবপাচারকারী চক্রকে ধরতে তদন্তের পাশাপাশি অভিযান পরিচালনা করছে। চক্রের সক্রিয় প্রত্যেকের অর্থ-সম্পদের খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলার প্রস্তুতিও নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, দেশে বসবাসকারী চক্রের সকল সদস্যকে ধরতে অভিযান অব্যাহত থাকবে। আর বিদেশ থাকা পলাতক সকল মানবপাচারকারীদের ধরতে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির প্রস্তুতি চলছে।

লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যার ঘটনায় মানবপাচারকারী ও দালাল চক্রের অন্যতম হোতা কামাল হোসেন ওরফে হাজী কামালকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাবে বলে দাবি স্বজনদের। তবে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন ও অনুসন্ধানে যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে তাতে বলা হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদে রাজধানী ঢাকার মানবপাচারকারী বেশ কিছু ট্রাভেল এজেন্ট নামধারী আদম ব্যবসায়ী রয়েছে যারা মানবপাচার ও দালাল চক্রের সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছে। সরকারের একটি দায়িত্বশীল গোয়েন্দা সংস্থা সম্প্রতি মানবপাচার সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। পাচারে জড়িত বাহকরা ধরা পড়লেও রাঘববোয়ালদের টিকি এখনও স্পর্শ করা যাচ্ছে না। এমন তথ্যের ইঙ্গিত করা হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দালাল-চক্র

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ