Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশায় সয়লাব ঢাকা

প্রকাশের সময় : ৩০ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বিশেষ সংবাদদাতা : নিষিদ্ধ তবুও চলছে। রাজধানীতে প্রতিদিনই বাড়ছে ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা। বাড়তে বাড়তে কোনো কোনো এলাকায় এমন অবস্থা হয়েছে যে রাস্তার চেয়ে এসব রিকশা জোড়া দিলে বেশি লম্বা হবে। অর্থাৎ রাস্তায় হাঁটা বা চলাচলের কোনো জায়গা খালি নেই। মধ্যরাতের আগে খালি থাকে না কখনো। এ অবস্থায় পায়ে হেঁটে চলা সবচেয়ে বেশি কঠিন। নগরীর প্রতিটি এলাকার অলিগলি এখন ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশায় সয়লাব। এসব ইজিবাইক ও রিকশা চালছে থানা ও ট্রাফিক পুলিশকে ম্যানেজ করে। নেপথ্যে আছে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। নতুন গাড়ি নামলে বা চাকা ঘুরলেই যাকে নির্দিষ্ট অঙ্কের মাসোহারা দিতে হয়। কোনো কোনো এলাকায় আবার পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম ভাঙিয়ে রাস্তা দখল করে নিচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। কদমতলী থানার দনিয়া এলাকায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার ভাইয়ের নাম ভাঙিয়ে নামানো হয়েছে সাড়ে ৫শ’ ব্যাটারিচালিত রিকশা। সাথে শতাধিক ইজিবাইক তো আছেই। শুধু ঢাকা শহরেই লক্ষাধিক ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে চোরাই বিদ্যুৎ দিয়ে। এতে করে বিদ্যুৎ বিভাগের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তারা লাভবান হচ্ছে। সারাদেশে পাঁচ লাখেরও বেশি ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জের জন্য জাতীয় গ্রিড থেকে প্রতিদিন অন্তত ৪০০ থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের অন্যতম প্রধান কারণ এসব ব্যাটারিচালিত যান। দুর্ঘটনা কমাতে সারাদেশের মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত এসব যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করেছিল সরকার। গত বছর এই আদেশ জারি হওয়ার পর কিছুদিন এসব চলাচল বন্ধ ছিল। এরপর আবার আগের মতোই চলাচল শুরু হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বহুবার এসব অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন। মন্ত্রীর নির্দেশের পর কিছুটা সক্রিয় হয় বিআরটিএ। চলে অভিযান, ধরপাকড়। কিন্তু সেটি আর স্থায়ী হয় না রহস্যজনক কারণে। রাজধানীর বিভিন্ন থানা এলাকার মধ্যে, সবুজবাগ, খিলগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা, উত্তরখান, দক্ষিণখান, তুরাগ, হাজারীবাগ, মিরপুর, কাফরুল, পল্লবী, দারুস সালাম, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী ও শ্যামপুর থানা এলাকায় ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশার দাপট আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন ইজি বাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা নামছে রাস্তায়। এর বাইরে ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-মাওয়া, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে চলাচল তো আছেই। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর কদমতলী থানা এলাকাতেই আছে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশা। স্থানীয় সরকারদলীয় প্রভাবশালী নেতা ও থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে চলছে এসব নিষিদ্ধ যান। কদমতলীর দনিয়া এলাকায় গত কয়েক মাসে সাড়ে ৫শ’ ব্যাটারিচালিত রিকশা নামিয়েছে একটি চোরাই সিন্ডিকেট। ভাগ্নে বাবুল, ফারুক ও বাদশা এই সিন্ডিকেটের নেতা। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এই সিন্ডিকেটের প্রধান কাজ রিকশা চুরি করা। নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশের এলাকা থেকে রিকশা চুরি করে এনে এরা দনিয়া এলাকার বিভিন্ন রিকশার গ্যারেজে রাখে। এরপর সেসব রিকশার রঙ পাল্টিয়ে তাতে ব্যাটারি ও মোটর লাগিয়ে রাস্তায় নামানো হয়। স্থানীয়রা জানান, গত কয়েক মাসে এরা সাড়ে ৫শ মোটরচালিত রিকশা রাস্তায় নামিয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগই শনিরআখড়া-দনিয়া হয়ে ধোলাইপাড়, জুরাইন, শ্যামপুর, রায়েরবাগ লাইনে চলাচল করে। জানা গেছে, রিকশাচোর সিন্ডিকেটের এই তিন নেতা প্রশাসনকে থোরাই কেয়ার করে। এরা পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার নাম ভাঙায়। পুলিশ সেই নাম শুনলেই নাকি তাদের রিকশা ছেড়ে দেয়। থানা পুলিশও সবকিছু জেনেও নীরব। জানতে চাইলে কদমতলী থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী বলেন, পুলিশের নাম ভাঙিয়ে কাউকে অবৈধ ব্যবসা করতে দেয়া হবে না। ভাগ্নে বাবুল, ফারুক ও বাদশা সিন্ডিকেটের কথা জানার পর তিনি বলেন, আমি এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। দনিয়া এলাকার রাস্তাগুলো এখন ব্যাটারিচালিত রিকশায় সয়লাব। স্থানীয় বাসিন্দা এ্যডভোকেট মিজানুর রহমান বলেন, গত বছর এই এলাকার প্রধান রাস্তাগুলো পাকা হয়েছে। কিন্তু তাতে আমাদের লাভ হয়নি। এখন রিকশা ও অটোবাইকের ভিড়ে রাস্তায় হাঁটা যায় না। সকালে বাচ্চাকে স্কুলে দিতে গিয়ে ভীষণ অসুবিধায় পড়তে হয়। আরেক ভুক্তভোগী নজরুল ইসলাম বলেন, যে হারে ইজিবাইক ও রিকশা বেড়েছে তাতে মনে হচ্ছে মানুষ আর বাস করতে পারবে না। এগুলো তো নিষিদ্ধ। তাহলে এভাবে বাড়ল কীভাবে? প্রশাসন কি এগুলো চোখে দেখে না? নূরপুর এলাকার গৃহবধূ রেশমি আক্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কয়েক মাস আগে যুথী নামে এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে ইজিবাইকের নিচে পড়ে। অন্তত ওই ইস্যুতে এই এলাকায় ইজিবাইক নিষিদ্ধ করা উচিত ছিল। কিন্তু তা না হয়ে হচ্ছে উল্টোটা। দিন দিন বাড়ছেই। এখন এমন বাড়া বেড়েছে যে মানুষ হাঁটারও আর জায়গা নেই। এসবের সাথে রিকশা ও ইজিবাইকের ‘চিউ চিউ’ শব্দে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ। শনিরআখড়া বাজারের এক ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে দনিয়া এলাকার রাস্তা দিয়ে এখন হাঁটাই যায় না। প্রতিদিনই কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটে। এমনকি এসব যানবাহনের ভিড়ে শনিরআখড়া বাজারেও প্রবেশ করা যায় না। এ কারণে বাজারের অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত বলে জানান সেখানকার ব্যবসায়ীরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কদমতলী থানা এলাকায় ইজিবাইকের বেশ কয়েকটি রুট চালু আছে। এর মধ্যে রায়েরবাগ ও মোহাম্মদবাগ রুটে চলাচল করে কমপক্ষে দুই হাজার ইজিবাইক ও রিকশা। রায়েরবাগের এই রুট নিয়ন্ত্রণ করে ডিউক ও সেলিম এবং মোহাম্মদবাগে নিয়ন্ত্রণ করে লিটন ও তার দুই ভাই। প্রতিদিন এখানে ইজিবাইক প্রতি ৩০ টাকা রিকশা প্রতি ২০ টাকা হারে চাঁদা তোলা হয়। এলাকাবাসীর হিসাব মতে, শুধু এই দুই রুট থেকেই মাসে তিন লাখ টাকার বেশি চাঁদা ওঠে। এছাড়া বড়ইতলা থেকে বিক্রমপুর প্লাজা, পোস্তগোলা থেকে পাগলা, ধোলাইরপাড় থেকে শনিরআখড়া, জুরাইন মেইন রাস্তা থেকে মুরাদপুর হয়ে কোদারবাজার পর্যন্ত আছে একটি করে রুট। জানা গেছে, মুরাদপুর মাদ্রাসা রোডের এই রুট নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতার বডিগার্ড মাসুম। প্রতিটি ইজিবাইক থেকে প্রতিদিন দেড়শ’ টাকা করে চাঁদা তোলে মাসুম। জেহাদ নামে এক ইজিবাইক চালক বলেন, পুলিশের নাম করে এই চাঁদা তোলা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যাটারির চার্জ দেয়ার জন্য মুরাদপুর এলাকাতেই আছে কয়েকটি গ্যারেজ। যেগুলোতে অবৈধ বিদ্যুতের সংযোগ নেয়া আছে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে। এর মধ্যে মুরাদপুর মাদ্রাসা রোডের আবুল গ্যারেজ, কোদারবাজারের কালামের গ্যারেজ এবং মাদ্রাসা রোডের মাথায় রাস্তার দুই পাশের কয়েকটি দোকানেও রয়েছে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ। সেখানেও চার্জ দেয়া হয়। অন্যদিকে, দক্ষিণখান আদর্শ ইউনিয়ন এলাকাতে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে সয়লাব। একটি ইউনিয়নে রয়েছে সহস্যাধিক ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা। এর মধ্যে কাউলার রেলগেট রয়েছে একশ’ হাজী ক্যাম্পের সামনে এবং পাশ থেকে দক্ষিণখান ও নদ্দাপাড়া, হলান যাওয়ার পথে রয়েছে তিন শতাধিক, কসাইবাড়ী থেকে দক্ষিণখান যাওয়ার রাস্তায় রয়েছে আরও একশ। আজমপুর কাঁচাবাজার থেকে চলাচল করে প্রায় তিনশ, জয়নাল মার্কেট থেকে চলে আরও তিনশ’। এছাড়া আব্দুল্লাহপুর বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে চলাচল করে ৫ শতাধিক ইজিবাইক। প্রতিটি ইজিবাইক স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এরা মাসে চাঁদাবাজি করে লাখ লাখ টাকা। ঢাকার মিরপুর, সবুজবাগ, রামপুরা, তুরাগ, খিলক্ষেত, উত্তরখান, বাড্ডা এলাকার চিত্র প্রায় একই রকম। তবে অনেকের মতে, কদমতলীর মতো এতোটা বিশৃঙ্খল অবস্থা ডিএমপির অন্য কোনো থানায় নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রিকশা ও ইজিবাইকগুলো যে শুধু বিদ্যুতের অপচয় করছে তা নয়, এগুলো পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত একটি ইজিবাইকের জন্য চার থেকে পাঁচটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি প্রয়োজন। আর প্রতি সেট ব্যাটারি চার্জের জন্য গড়ে ৮০০ থেকে ১১০০ ওয়াট হিসেবে পাঁচ থেকে ছয় ইউনিট (দিনে বা রাতে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা) বিদ্যুৎ খরচ হয়। সে হিসেবে দেশের পাঁচ লাখের বেশি ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জের জন্য জাতীয় গ্রিড থেকে প্রতিদিন অন্তত ৪০০ থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। আর চুরি করে ও লুকিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে তা রিচার্জ করায় সরকার মোটা অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন করে ইজিবাইক আমদানি বন্ধ ও পুরনোগুলো পর্যায়ক্রমে তুলে নেওয়ার কথা থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। এমনকি মহাসড়কগুলোতে এই যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশায় সয়লাব ঢাকা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ