ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মোহাম্মদ আবু নোমান
মানুষকে খুন করে, বোমাতঙ্ক সৃষ্টি করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার মনগড়া ব্যাখ্যার সঙ্গে ইসলামের দূরতম সম্পর্ক নেই। বরং আদর্শিক মহানুভবতা, ক্ষমা, উদারতা ও সুনৈতিকতার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ইসলাম ব্যাপক প্রচার ও প্রসার লাভ করেছে। তাই আংশিক বা খ-িত ইসলাম এবং ইসলামের অপব্যাখ্যা থেকে মুসলমানদের সজাগ ও সচেতন থাকা দরকার। রাসূল (সা.) ও সাহাবায়েকেরাম যুদ্ধবন্দী ইসলামের দুশমন কাফেরদের হত্যা বা নির্যাতন করেননি। বরং ইসলামের শান্তির বাণী, মুসলমানদের সুন্দর আচরণ, মহানুভবতা, উত্তম ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে অমুসলিমরা স্বেচ্ছায় পবিত্র কালিমা পাঠ করে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে নিজেদের ধন্য মনে করেছে। সমাজের প্রতিটি ধর্মানুরাগী মানুষের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করাই ইসলাম ও মুসলমানদের শিক্ষা। সাময়িক উত্তেজনা বা সস্তা আবেগের বশবর্তী হয়ে চরমপন্থা গ্রহণ, অতি বাড়াবাড়ির কোন অবকাশ ইসলামে নেই। ইসলাম মানুষকে ভালোবাসতে বলে, হত্যা করতে নয়। সুন্দর, প্রগতিশীল, বিজ্ঞানসম্মত ও শান্তির ধর্ম ইসলাম মানবজাতিকে বিভক্ত করতে আসেনি, ঐক্যবদ্ধ করতে এসেছে। অধিকার হরণ করতে আসেনি, অধিকার দিতে এসেছে।
প্রকৃত মুসলমানদের আদর্শ হলো, স্নেহপ্রবণতা, কোমলতা, সারল্য, ধর্মপ্রাণতা ও ধর্মভীরুতা এবং কখনোই ধর্মান্ধগ নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে প্রয়োজনে অমুসলিমদের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাদের ইজ্জত-আব্রু ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তার জন্য প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতে হবে। কারণ, অমুসলিম জনগোষ্ঠীও মানুষ, তারাও আল্লাহর বান্দা। ইসলাম সম্পর্কে যাদের সামান্য জ্ঞানও আছে তারা সকলেই জানেন, ঐতিহাসিকভাবে যা সর্বজনবিদিত, জাতি, ধর্ম, বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে সমাজের সকল মানুষের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠা ইসলামী ধর্মবিশ্বাসের অন্যতম প্রেরণা।
বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর অব্যাহত জুলুম ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ মানবতা যখন ইসলামের শান্তিময় আদর্শের দিকে ছুটে আসছে তখন ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম হিসেবে প্রমাণ করার জন্য তারা তাদেরই লালিত পেইড এজেন্টের মাধ্যমে কুরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যা করে চরমপন্থী দর্শন প্রচার করছে। তরুণদের একাংশকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সন্ত্রাসী তৎপরতায় লাগাচ্ছে। আর তাকেই জঙ্গিবাদ হিসাবে প্রচার চালিয়ে ইসলামকে সন্ত্রাসবাদী ধর্ম বলে বদনাম করেছে। অতঃপর সন্ত্রাস দমনের নামে বিশ্বব্যাপী নিরীহ মুসলমানদের রক্ত ঝরানো হচ্ছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কোনো গোত্রীয়, জাতীয় ও ধর্মীয় পরিচয় নেই। কোনো সন্ত্রাসী কর্মকা-ের জন্য কোনো জাতি বা কোনো ধর্মকে সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করা সমর্থনীয় নয়।
গুলশান ও শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলা ইসলামের নামে করা হলেও প্রকৃতপক্ষে ইসলামের সঙ্গে এসব জঙ্গি ও তাদের কর্মকা-ের কোন সম্পর্ক নেই। ইসলাম যে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যে ধর্মের নামে রয়েছে শান্তির সুবাস, যে ধর্মের নবীকে প্রেরণ করা হয়েছে জগতবাসীর জন্য শান্তি ও রহমত স্বরূপ, সে ধর্মের নামে এমন অপকাজ নিষিদ্ধ ও অমানবিক।
কথিত জঙ্গিদের কোন কাজই ইসলামসম্মত নয়। তাদের কর্মকা-ের বেনিফিসিয়ারি কারা? মদের বোতলে ‘ইসলামি’ লেবেল এঁটে দিলেই হারাম মদ কী হালাল হয়ে যায়? কোনো মদ্যপ ‘আল্লাহু আকবার’ বলে মদ পান করলে সেটাকে যেমন কেউ ইসলামি মদ বলবে না, তেমনি কোনো সন্ত্রাসী ইসলামের নামে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে মানুষ হত্যার মতো কাজ করলে, সেটাকে ‘জিহাদ’ ভাবার অবকাশ নেই। সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, বিনা কারণে হত্যা ও সমাজে ভীতি তৈরির নাম কখনোই জিহাদ নয়; বরং ইসলামের জিহাদ হচ্ছে অন্যায় আগ্রাসন ও সন্ত্রাস-নৈরাজ্য দমনের জন্য। জিহাদ মানে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ নয়। জিহাদ নিপীড়িত, অত্যাচারিত জাতিকে মুক্তির জন্য। অন্যায় প্রতিরোধের জন্য। ইসলামে সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকার পরও মুসলিম নামধারী অনেকে ইসলামের মহান আদর্শকে উপেক্ষা করে, আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে সন্ত্রাস ও আগ্রাসনের পথ বেছে নেয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের প্রাণ হরণ কিংবা জীবন নাশের চেয়ে বড় অপরাধ আর হয় না। আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না’ (নিসা ৪/২৯)। আত্মহত্যা করা মহাপাপ। জিহাদের ময়দানে আহত হয়ে তীব্র যন্ত্রণায় কাতর জনৈক সৈনিক আত্মহত্যা করলে রাসূল (সা.) তাকে ‘জাহান্নামি’ বলে আখ্যায়িত করেন। কেননা তার শেষ আমলটি ছিল জাহান্নামিদের আমল। অতঃপর রাসূল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই ফাসেক-ফাজেরদের মাধ্যমে এই দ্বীনকে সাহায্য করে থাকেন’ (বুখারি)। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে আমার বান্দা, আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও একে হারাম, সহজেই করেছি। অতএব তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম করো না।’ জুলুম অত্যাচার আল্লাহর জন্যও হারাম। অতএব যারা নিরাপরাধ মানুষের ওপর জুলুম অত্যাচার করে তাদের কর্মকা-ও কতটা হারাম অনুমেয়। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করা কিংবা যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করা ছাড়া যে কাউকে হত্যা করল, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল। আর যে তাকে বাঁচাল, সে যেন সব মানুষকে বাঁচাল’ (মায়িদা-৩২)। মানুষের প্রাণহানী ঘটানোকে যেখানে বলা হয়েছে পুরো মানবজাতিকে হত্যার সমতুল্য, সেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকে গণ্য করা হয়েছে হত্যার চেয়েও জঘন্য অপরাধ হিসেবে। ‘আর ফিতনা হত্যার চেয়ে কঠিনতর’ (বাকারা)।
গুলশান-শোলাকিয়া আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, শুধুমাত্র দারিদ্র্য বিমোচন ও মাদ্রাসা শিক্ষা কমানোর ঢাকঢোল বাজালেই জঙ্গি সমস্যার সমাধান হবে না। আধুনিক শিক্ষিত উচ্চবিত্তরাও জঙ্গি হতে পারে। এবার আমাদের সন্দেহের তীর নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে এক লাফে উচ্চবিত্ত পরিবারের দিকে ধাবিত। গুলশান ট্র্যাজেডিতে ইসলাম বিদ্বেষীদের চিন্তার স্রোতধারা পরিবর্তন হবে নিশ্চয়। ভুলে গেলে চলবে না, জঙ্গিবাদ একটি আদর্শের নাম, তা যত মন্দই হোক। সমাজের বিভিন্ন স্তরে জঙ্গিবাদের প্রচার আদর্শিকভাবেই হচ্ছে, কেবল প্রলোভনের মাধ্যমে নয়। কাজেই জঙ্গিবাদের মোকাবেলা করতে হবে আদর্শিকভাবে। ওদের আদর্শের অসারতা প্রমাণ করে সঠিক আদর্শ তুলে ধরতে হবে তরুণ প্রজন্মের সামনে, যাতে তারা বিভ্রান্ত না হয়। ধর্মীয় শিক্ষা সঙ্কুুচিত না করে সঠিক ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে, যাতে ধর্মের নামে কেউ কোনো ধরনের বিভ্রান্ত ছড়াতে না পারে।
উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা ভাত-কাপড়ের জন্য নয়, ধর্মের অপব্যাখ্যা ও মগজধোলাইয়ের কারণে বিপথগামী হচ্ছে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদেরই জঙ্গিবাদে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা বেশি। সাধারণ ও মধ্যবিত্ত ছাড়িয়ে উচ্চবিত্তের ঘরে হানা দিয়েছে মূল্যবোধের অবক্ষয়। আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষা বা আধুনিক শিক্ষায় মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়া হয় না। বাণিজ্যিক বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়, সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা গুরুত্বহীন। শুধু কারিকুলাম ও সিলেবাস অনুযায়ী পড়ানো হয়। বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রথম এক বছর নির্দিষ্ট বিষয় ছাড়া শিক্ষার্থীদের মানবিক, সামাজিক, নৈতিকতা বিষয়েই পড়ানো হয়।
ইসলামের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্রের কারণেই আজ নব্য জঙ্গিবাদের উত্থান। তারা ইসলামকে কলঙ্কিত করতে, সত্যিকার ইসলামপন্থি, ইসলাম প্রচারক ও ইসলামী আন্দোলনকারীদের বিতর্কিত করতে জঙ্গিবাদকে ব্যবহার করছে। তারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কিছু বিভ্রান্ত মুসলিমকে বেছে নিয়ে বিভিন্ন কর্মকা- ঘটাচ্ছে। এরা বুঝে হোক না বুঝে হোক তাদের ফাঁদে পা দিচ্ছে। অথচ এদের অনুধাবন করা উচিত ছিল ইসলাম কখনো বোমাবাজি, হত্যা, গুপ্তহত্যা, আত্মঘাতী হামলাসহ কোন ধরনের অরাজকতা সমর্থন করে না।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।