Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বন্যা পরিস্থিতির অবনতি পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষ

প্রকাশের সময় : ২৪ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৫৬ পিএম, ২৩ জুলাই, ২০১৬

বিশেষ সংবাদদাতা : দেশের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে নতুন এলাকা, তলিয়ে যাচ্ছে ফসলের খেত। কুড়িগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া, জামালপুর, ময়মনসিংহ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এসব এলাকার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় খাদ্য, পানি ও জ্বালানির সঙ্কটে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ।
বন্যার পানিতে ডুবে গেছে শত শত একর ফসলি জমি। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় অনেক এলাকা যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়ায় অনেক এলাকায় শ্রমিকদের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই এসব অতি দরিদ্র শ্রেণির মানুষের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছে। দুর্গত কয়েকটি এলাকায় সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য ত্রাণ বিতরণ শুরু হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই সামান্য।
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৯০টি পানি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে ৫৭টি স্থানে পানি বৃদ্ধি ও ২৯টি স্থানে পানি হ্রাস পেয়েছে। একটি স্থানে পানি অপরিবর্তিত রয়েছে এবং ৩টি স্থানের তথ্য পাওয়া যায়নি। ৮টি স্থানে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুড়িগ্রামে ধরলা বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার, চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্র বিপদসীমার ৫২ সেন্টিমিটার, বাহাদুরাবাদে যমুনা বিপদসীমার ২১ সেন্টিমিটার, সারিয়াকান্দিতে যমুনা বিপদসীমার ১৬ সেন্টিমিটার, এলাসিনে ধলেশ্বরী বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার, সুরেশ্বরে পদ্মা বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার, সুনামগঞ্জে সুরমা বিপদসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার এবং জারিয়াজঞ্জাইলে কংস বিপদসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদ-নদীসংলগ্ন কুড়িগ্রাম, জামালপুর ও বগুড়া জেলাসমূহের নি¤œাঞ্চলের কিছু অংশে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত থাকতে পারে। এছাড়া আগামী ২৪ ঘণ্টায় আত্রাই নদী বাঘাবাড়িতে ও পদ্মা নদী গোয়ালন্দে তাদের নিজ নিজ বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে।
যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় গত ২৪ ঘণ্টায় এই নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির ফলে সারিয়াকান্দি উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের প্রায় ৫০ হাজারেরও অধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট। প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় দুর্গত এলাকার বাসিন্দাদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে।
সারিয়াকান্দি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সারওয়ার আলম গতকাল (শনিবার) দুপুরে জানান, তাদের হিসাব অনুযায়ী উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯টি ইউনিয়নে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। বন্যাকবলিত ইউনিয়নগুলো হলো-চন্দনবাইশা, কুতুবপুর, হাটশেরপুর, সদর, কাজলা, কর্ণিবাড়ী, কামালপুর, চালুয়াবাড়ী ও বোহাইল।
এসব ইউনিয়নের প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গতকাল বন্যাদুর্গত এলাকার ২ হাজার ৫০০ পরিবারের মাঝে ২০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নান এসব চাল বিতরণ করেন। অবশিষ্ট এলাকার জন্য বরাদ্দ চেয়ে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।
কুড়িগগ্রামের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এলাকায় খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। রৌমারী উপজেলার বন্যাকবলিত পালের চরের দিনমজুর অছিম উদ্দিন (৩৫) তার কষ্ট ও অসহায়ত্বের কথা বলেন এভাবে, ‘তিন দিন থিকা ঘরে পানি। পোলাপান নিয়া মাচায় আছি। কামাই রোজগার নাই, একবেলা খাইয়া দিন পার করছি। মেম্বার চেয়ারম্যানরা কেউ দেখবার আইল না। আইজ এক পোয়া চিড়া, একটা মোমবাতি আর এক ম্যাচ দিয়া গেছে। এক পোয়া চিড়া আমগর তিন পোলাপানেরই অবো না। আমরা খাব কি?’
পালের চরে প্রায় দুই শতাধিক পরিবারের বসবাস। দু-একটা বাড়ি ছাড়া প্রায় সব বাড়ির ঘরে বন্যার পানি ঢুকেছে। গৃহবধূ কলিমন বেগম বলেন, ‘আমরা বানের পানিতে ভাইসা যাবার নাগছি, সরকারি লোকেরা কেউ দেখবার আইসে নাই।’
সুলতানা খাতুন নামে আরেক নারী বলেন, ‘এহন দুপুর বেলা, তাও আমার দুই অবুঝ বাচ্চাক কোনো খাবার দিতে পারিনি। ঘরে খাবারও নাই। তাই ওই গ্রাম থিকা দুই সের চাল কর্জ নিয়া আইলাম। তারা কইছে পানি কমলে চাল ফেরত দিতে হবে।’
সংশ্লিষ্ট এলাকার বন্দবেড় ইউপি চেয়ারম্যান কবীর হোসেন জানান, আমার এলাকার সবচেয়ে গরিব ও দরিদ্রপ্রবণ পালের চরের মানুষ। শতকরা ৯৫ ভাগ পরিবার দিনমজুর খেটে খাওয়া। আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে বন্যাদুর্গত এলাকার সচিত্র প্রতিবেদন দাখিল করেছি।
এ ব্যাপারে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) সাখাওয়াত হোসেন জানান, শুক্রবার প্রাথমিকভাবে শুকনো খাবার হিসেবে দুইশ প্যাকেট চিড়া, মোমবাতি ও দিয়াশলাই বিতরণ করা হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় ছিল খুবই কম। আরো পর্যাপ্ত ত্রাণ সরবরাহের জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন জানানো হয়েছে।
অপরদিকে, পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পদ্মায় তীব্র ¯্রােতের কারণে শিমুলিয়া-কাওরাকান্দি নৌরুটে পাঁচটি ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফেরিগুলো হলোÑরোরো, রুহুল আমিন, ডাম্প ফেরি রানীক্ষেত, রামশ্রী, রায়পুরা ও কর্ণফুলী। গত শুক্রবার রাত ১১টা থেকে এসব ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। আজ শনিবার বিকাল পর্যন্ত এ রুটে ওই ফেরিগুলোর চলাচল বন্ধ ছিল।
ফেরিগুলোর চলাচল বন্ধের তথ্য নিশ্চিত করেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) ব্যবস্থাপক আবদুল আলীম। তিনি জানান, শুক্রবার রাত ১১টার দিকে রো-রো ফেরি শাহ আলীর ইঞ্জিনে আগুন লেগে যায়। ¯্রােতে ভেসে আসা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে থাকা শিকড় ফেরিটির পাখায় জড়িয়ে গেলে ইঞ্জিনে আগুন লাগে। তাৎক্ষণিকভাবে ফেরি কর্তৃপক্ষ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় বড় ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এর পর থেকে ওই রুটে ওই ফেরিগুলো চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ফেরি চলাচল বিঘিœত হওয়ায় পারাপারের অপেক্ষায় শিমুলিয়া ও কাওরাকান্দির উভয় ঘাটে সহ¯্রাধিক যানবাহন আটকে পড়েছে।
কুড়িগ্রামে দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দী
শফিকুল ইসলাম বেবু, কুড়িগ্রাম থেকে জানান, বৃষ্টি এবং উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ছোট-বড় ১৬টি নদ-নদীর পানি বাড়তে থাকায় কুড়িগ্রামের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৫৫ সে.মি ও ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ৪৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে শনিবার প্রবাহিত হচ্ছিল। ফলে আরো নতুন নতুন গ্রামে পানি উঠেছে। প্লাবিত হওয়ার কারণে শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। পানিবন্দী প্রায় দেড় লাখ মানুষ।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজার রহমান জানান, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ও ধরলায় বিপদসীমার ৪৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। ৯ উপজেলার ৪৫টি ইউনিয়নে বন্যার পানি হানা দিয়েছে। গত দু’দিনে নদীভাঙনে আরো চার শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়েছে। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে একটি নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে আরো কয়েকটি স্কুল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২২ কি:মিটার বাঁধ।
কুড়িগ্রাম বন্যা কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জানান, সরকারি হিসাবে ৩৩টি ইউনিয়নের ৩২৫ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ৪১৫ বর্গকি:মি: এলাকা এখন বন্যার পানিতে ডুবে আছে। নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪ হাজার ৩৬২টি পরিবার। নদীভাঙনের এ সংখ্যা ৪৮ ঘণ্টায় বেড়েছে ৪৩২টি। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ৪০ হাজার ৬৩৪টি। এ হিসাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা এক লাখ ২৬ হাজার ২৫১ জন। যোগাযোগের রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৭৯ কি:মিটার। এর মধ্যে পাকা রাস্তা ১০ কি:মি: এবং কাঁচা রাস্তা ১৬৯ কি:মিটার। শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬৫টি। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান ১৩টি এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান ৫২টি। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২২ কি:মিটার এবং ব্রিজ ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১১টি। একই সময়ে ফসল নষ্ট হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৫ হাজার কৃষক।
সিভিল সার্জন ডা: জয়নাল আবেদীন জিল্লুর দাবি করেছেন, বন্যাদুর্গত এলাকায় ৮৫টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ওর স্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় সব ওষুধ পর্যাপ্ত রয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো খারাপ খবর নেই। গত ২৪ ঘণ্টায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ২৪ জন।
জেলা প্রশাসক খান মো: নুরুল আমিন জানান, বন্যা ও ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ১০ লাখ ৯৪ হাজার টাকা ও ১৯২ মে: টন চাল ববাদ্দ দেয়া হয়েছে। ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমও শুরু হয়েছে।
জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি
জামালপুর জেলা সংবাদদাতা জানান, জামালপুরে যমুনার পানি বিপদসীমার ২১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। ইতোমধ্যেই জামালপুর জেলার ১৬টি ইউনিয়নের ১১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেজপাঠক আব্দুল মান্নান জানান, বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বন্যার পানি যমুনা নদীতে পানি পরিমাপক স্কেলের ১৯.৭১ সেন্টিমিটার পয়েন্টে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হচ্ছে।
ইসলামপুরের চিনাডুলি ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম জানান, যমুনার প্রবল স্রোতে চিনাডুলি ইউনিয়নের দেওয়ানপাড়া থেকে শিংভাঙ্গা পর্যন্ত এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে কমপক্ষে ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। নোয়ারপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান মশিউর রহমান বাদল জানান, বন্যার পানির তীব্র ¯্রােতে শনিবার সকালে উলিয়া বাজারের পাশে যমুনার পূর্ব তীর সংরক্ষণ বাঁধ ভেঙে গেছে। ইতোমধ্যে নোয়াপাড়া ইউনিয়নের রাজনগর, করিরতাইর, তাড়তাপাড়া, মাইজবাড়ী, কাজলা, কাঠমা এবং ব্রহ্মত্তর এলাকার প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে এবং অধিকাংশ কৃষকের পাট ও ধানক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব পানিবন্দীর ঘরে খাদ্য সঙ্কট চলছে।
ইসলামপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নবী নেওয়াজ খান লোহানী বিপুল জানান, যমুনার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় ইসলামপুর উপজেলার নোয়ারপাড়া, সাপধরি, চিনাডুলি, বেলগাছা, পাথর্শী, কুলকান্দি ও ইসলামপুর সদর ইউনিয়নসমূহের কমপক্ষে ৬০টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে অন্তত ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ওই সব পানিবন্দী মানুষের মধ্যে রান্না করা খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট চলছে। তিনি বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
বগুড়ায় বন্যাদুর্গত ২০ হাজার পরিবার
মহসিন রাজু , বগুড়া থেকে জানান, শ্রাবণের বিরতিহীন বর্ষণ ও উজান থেকে আসা ভারতীয় পানির ঢলে ছোট-বড় সব নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বগুড়ায় বন্যা দেখা দিয়েছে আর দুর্ভোগের মুখোমুখি হয়েছে হাজারো মানুষ।
বগুড়ার নদ-নদীগুলোর মধ্যে কাহালু ও দুপচাঁচিয়া দিয়ে বয়ে যাওয়া নাগর, শিবগঞ্জের গাংনৈ, বগুড়া ও শেরপুর দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদীর পানি এখনো বিপদসীমার নিচে থাকলেও ধুনট ও সারিয়াকান্দি এবং সোনাতলা উপজেলা দিয়ে বয়ে যাওয়া বাঙ্গালী ও যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিশেষ করে যমুনার পানি শনিবার বিকেলে এ রিপোর্ট লেখার সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে তথ্য নিয়ে দেখা যায় যে, বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে যমুনার তীব্র ¯্রােতের কারণে ভাঙছে নদীর পাড়।
প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সোনাতলা, সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলার ৩০টি ইউনিয়নের নীচু এলাকায় কমপক্ষে ২০ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন।
বন্যাকবলিত এলাকায় সর্দিকাশি ও উদরাময়জনিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। গবাদি পশুর খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে।
সুন্দরগঞ্জে পানিবন্দী ২৫ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস হয় না
সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, সুন্দরগঞ্জে আগত বন্যা গত ৭ দিন ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে। চরাঞ্চলের ২৫ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস হচ্ছে না।
জানা গেছে, তিস্তা নদীর পানি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় সুন্দরগঞ্জ উপজেলার নদী বিধৌত ৬টি ইউনিয়নের ২০ চর প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। পানিবন্দী হওয়ার কারণে চরাঞ্চলের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ২৫ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অঘোষিত ক্লাস বন্ধ রয়েছে। উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, ১৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে চরাঞ্চলে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে ও তার আশপাশসহ রাস্তাঘাট পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় কোনো শিক্ষার্থী স্কুলে যেতে পারছে না। তবে ২-১ জন করে শিক্ষক ঝুঁকি নিয়ে প্রতিষ্ঠানে গেলেও তারা বসে থেকে সময় পার করে বাড়ি ফিরছেন।
মধুমতির অব্যাহত ভাঙনের শিকার শতাধিক পরিবার
নড়াইল জেলা সংবাদদাতা
নড়াইলের লোহাগড়ায় মধুমতির ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। পানি বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে ভাঙন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। উজান থেকে নেমে আসা ঢলে মধুমতির পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে ভাঙন শুরু হয়েছে উপজেলার শালনগর ইউনিয়নের শিয়েরবর, ম-লবাগ, ঝাউডাঙ্গা, লোহাগড়া ইউনিয়নের কামঠানা, মলি¬কপুর ইউনিয়নের মহিষাপাড়া, মঙ্গলহাটা, করফা, আতোষপাড়া, ইতনা ইউনিয়নের ডিগ্রিরচর ও কোটাকোল ইউনিয়নের ঘাঘা, ধলইতলা, কোটাকোলসহ প্রায় ১৪টি গ্রামজুড়ে। এসব এলাকার কয়েক হাজার মানুষের প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে ভাঙনের আতঙ্কে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, স্রোতের তোড়ে কোটাকোল ইউনিয়ন থেকে শালনগর পর্যন্ত প্রায় ৬০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনের কবলে পড়েছে ঐসব এলাকার হাট-বাজার, বাড়িঘর, দোকানপাট, মসজিদ, স্কুল, আবাদি জমি ও রাস্তাঘাট। ভাঙনকবলিত এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে মধুমতির নীরব ভাঙন চললেও তা রোধের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি সংশ্লি¬ষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফলে ভিটামাটি হারিয়েছেন কয়েকশ’ পরিবার। আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন নদী-তীরবর্তী হতদরিদ্র মানুষ। এদের মধ্যে অনেক পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন অন্যের জমিতে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
চরভদ্রাসনে পদ্মা নদীর তীব্র ভাঙন
ফরিদপুর জেলা সংবাদদাতা জানান, ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলায় গত ক’দিনের প্রবল বৃষ্টি ও বৈরী আবহাওয়ায় উত্তাল পদ্মা নদীর কোল ঘেঁষে ফসলি জমিতে তীব্র ভাঙনের খবর পাওয়া গেছে। এতে উপজেলার গাজীরটেক ইউনিয়ন চরঝাউকান্দা ও সদর ইউনিয়নের প্রায় ৫০ একর পাট ও ধঞ্চেক্ষেত পদ্মার গর্ভে চলে গেছে। গাজীরটেক ইউনিয়নের জয়দেব সরকারের ডাঙ্গি গ্রামের সীমানার পদ্মার তীর সংরক্ষণ সিসি ব্লক বাঁধের প্রায় ২শ’ মিটার এলাকায় ধস ও আলিয়াবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফাজেলখার ডাঙ্গি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হুকুম আলী চৌকদার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভাঙনকবলিত পদ্মার মুখে রয়েছে।
উপজেলার গাজীরটেক ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ড মেম্বার বাবুল প্রামাণিক জানান, জয়দবে সরকারের ডাঙ্গি গ্রামের পশ্চিম দিকের পাট ও ধঞ্চে ফসলি মাঠে গত ৩ দিন ধরে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন অন্তত ১০ একর করে গত তিন দিনে প্রায় ৩০ একর ফসলসহ জমি পদ্মার গর্ভে চলে গেছে। এতে আলিয়াবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আগ্রাসী পদ্মা নদীর মুখে রয়েছে।

ঝিনাইগাতীর নি¤œাঞ্চল প্লাবিত
ঝিনাইগাতী (শেরপুর) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, গত ক’দিনের থেমে থেমে বৃষ্টিতে উজান থেকে পাহাড়ি নদীপথে নেমে আসা ঢলের পানিতে ঝিনাইগাতীর নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। দাড়িয়ারপাড়, কুনাগাঁও, দুপুরিয়াসহ বেশ কটি গ্রামের শত শত মানুষ পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। অতিবৃষ্টিতে সবজি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি এবং পুকুরের মাছ বেরিয়ে গেছে। এ ব্যাপারে ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী অফিসার সেলিম রেজা নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে ক্ষয়ক্ষতির লিস্ট পেলে সহযোগিতা করা হবে বলে এ প্রতিনিধিকে জানান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বন্যা পরিস্থিতির অবনতি পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ