Inqilab Logo

বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ১৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

‘হামারতো পেটে ভাত নাই স্কুলে যেয়া কি করমু’

প্রকাশের সময় : ১৮ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শফিকুল ইসলাম বেবু, কুড়িগ্রাম থেকে : সাত বছর আগে ভারতীয় গরু আনতে বিএসএফ’র গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল বাবা আনোয়ার হোসেনের। আর একই কাজ করতে গিয়ে বিএসএফ’র হাতে ধরা পড়েছে আশরাফুল।
এদিকে ৫ সদস্যের সংসারে একমাত্র উপার্জনকারীকে হারিয়ে সবাই দিশেহারা। বাধ্য হয়ে সংসারের হাল ধরেছে তার ছোট ভাই শিশু আল আমিন। সেও সীমান্তে গরু আনার রাখালের কাজ নিয়েছে। কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার শিলখুড়ি ইউনিয়নের দক্ষিণ ধলডাঙ্গা গ্রামের মৃত আনোয়ার হোসেনের ছেলে আশরাফুল (২০)। বিয়ে করেছে তিন মাস আগে। অভাবী সংসারের হাল ধরতে একটি বেসরকারী সংস্থা ঠেঙ্গামারা থেকে ঋণ নিয়ে অটোরিক্সা কিনে চালাচ্ছিল। এরমধ্যে তার বিদ্যুতের বিল বাকী পড়েছে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার টাকা। অফিসের লোকজন চাপ দিচ্ছিল এ টাকা শোধ না করলে তার সংযোগ কেটে দেয়া হবে। এদিকে অটোরিক্সাসহ সপ্তাহে ৫টি কিস্তি শোধ করতে হয় প্রায় ৭ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে দিশেহারা আশরাফুল গত ২৪ ডিসেম্বর রাতে ভারত থেকে গরু আনতে যায়। দক্ষিণ বাঁশজানি সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় ভারতের দীঘলটারী বিএসএফ ক্যাম্পের সদস্যরা তাকে আটক করে। এ সময় তাকে নির্যাতন করে বিএসএফ। পরে আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে তারা। গত শুক্রবার তার পরিবারের লোকজন জানতে পারে বিএসএফ তাকে কোর্টে তুললে ৫ বছরের জেল দেয় ভারতীয় আদালত। এ খবরে পরিবারের সদস্যদের আহাজারীতে ভারী হয়ে এসেছে এলাকার পরিবেশ।
শনিবার আশরাফুলের বাড়িতে গেলে কান্নার রোল পড়ে যায়। আশরাফুলের মা আমেনা বেগম বলেন, বাবার বাড়ি সূত্রে পাওয়া ৩ শতক জমিতে তিনটি ঘর তুলে চলছে মানবেতর জীবন। ছোট দুই ছেলে আল আমিন (১০) ও সুমন (৭)। সুমন স্কুলে যায়। আর আল আমিন এখন সংসারের হাল ধরেছে। তিনি কান্নায় ভেঙ্গেপড়ে বলেন- ‘পোলাডা টাকার চাপে গেছে সীমান্তের মধ্যে, এ্যালা কি হয়া গেইল। এ্যাহন কী করে এই ছোট বাচ্ছাদের পালমু।’
আশরাফুলের স্ত্রী সাথী বেগম জানায়, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে অটো চালায়া আইয়া কইলো ভাত দে। আমি ভাত বাউড়া রাখলাম। হেয় কইলো দোকান থেকে আহি। আর আহে নাই। ভাতো খায় নাই। কী হইবো আমার। স্বামীরে বাঁচানোর ব্যবস্থা কইরা দেন।’
বড় ভাই ভারতের জেলে তাই সংসারে হাল ধরেছে আল আমিন। ভারত থেকে পাচার হওয়া গরু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভূরুঙ্গামারী হাটে নিয়ে যাচ্ছে। একটি গরু নিয়ে গেলে আড়াইশ টাকা পাওয়া যায়। এ টাকায় কোন রকমে চলছে তাদের সংসার।
ছোট ভাই আল আমিন (১০) বলেন, ‘স্কুলে যেয়া কি করমু। হামারতো পেটে ভাত নাই। মা, নানী, ছোট ভাই আর ভাবী কী খাইবো। এজন্য গরু নিয়্যা আহি।’
আশরাফুলের নানী জোহরা বেওয়া বলেন, ‘সাত বছর আগে জামাইটাকে (আনোয়ার হোসেন) বিএসএফ মাইরা ফ্যালাইলো। তিনদিন পর লাশ পাইছি দুধকুমার নদীত। এ্যাহন নাতীন ডারে জেলে দিছে। কী হইবো আমগো এই সংসারটার।
প্রতিবেশী হযরত আলী বলেন, ছেলেটা অটোরিক্সা চালাতো। আয় কম তাই এনজিও’র কিস্তির চাপে গেছে বাড়তি আয় করতে। গিয়ে আটকে গেছে। সে ছাড়া না পেলে বাড়ির লোকজন না খেয়ে মরবে।
আনোয়ারা বলেন, এ্যাহনতো খাইয়া, না খাইয়া দিন যাচ্ছে। কিস্তিগুলো দিবে ক্যামন কইরা? হেই চিন্তায় করতাছি।
স্থানীয় জিয়ারুল হক বলেন, সবাই চায় সীমান্তে না যাইতে। কিন্তু এখানে একদিনে ৩/৪ হাজার টাকা কে দিবে। বাংলাদেশে এমন কোন কাজ নেই একদিনে এত টাকা আয় হবে। এজন্য ভাগ্য বদলের আশায় অনেকে যায়। কাজ থাকলে যাইত না।
শিলখুড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আসাদ আলী বলেন, এখানকার সবাই অভাবী। নদী ভাঙ্গন আর চরাঞ্চল এলাকা। হাতে কাজ নেই। সংসার চালাতে তারা গরু আনতে যায়। যদি এখানে সরকারীভাবে গরু পালনের ব্যবস্থা করা যেত। সহজ শর্তে ঋণে যুবকদের স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ গ্রহণ করা গেলে এ ঘটনাগুলো ঘটতো না।
বিজিবির ধলডাঙ্গা বিওপির কমান্ডার হাবিলদার আলমগীর হোসেন বলেন, আশরাফুল নামের কাউকে বিএসএফ ধরেছে এমন খবর আমরা পাইনি। তবে এখন যেহেতু জানা গেল, তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হবে।
কুড়িগ্রাম ৪৫ বিজিবির অধিনায়ক লেঃ কর্নেল জাকির হোসেন বলেন, সীমান্তবাসীদের নিয়ে গত ছয় মাসে অর্ধশতাধিক সচেতনতামূলক সভা করেছি। এরপরও মানুষ লোভে পরে বিজিবি’র চোখ ফাঁকি দিয়ে গরু নিয়ে আসে। ভারতে আশরাফুলের আটকের ঘটনাটি আমাদের জানা ছিল না। এব্যাপরে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ‘হামারতো পেটে ভাত নাই স্কুলে যেয়া কি করমু’
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ