Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ ও কিছু কথা

প্রকাশের সময় : ২৪ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল
জয়া সেন ভেবেছিলেন তার সংসারের সমস্ত অন্ধকার দূর করে আলোকিত করবেন। পৌষের ভরা ধানক্ষেতে যেভাবে নির্মল বাতাস খেলে যায়, তেমনি করে তার সংসারে সকল সময় শান্তির অমল ধবল বাতাস খেলে যাবে। কিন্তু কথায় বলে মানুষের চিন্তা সকল সময় বাস্তবায়িত হয় না। পারিপার্শ্বিক কঠিন বাস্তবতা মানুষের স্বপ্নকে ভেঙেচুরে চুরমার করে দিয়ে বলে, তুমি যা ভাববে তা যে তোমার হাতের মুঠোয় এসে যাবে, তা তুমি ভাবলে কেমন করে। জয়া সেনের সংসারের প্রতিটা কোণায় কোণায় যেন অশান্তির স্থায়ী বসবাস গড়ে উঠেছিল। তিনি তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই চেয়েছিলেন তার নিজের সংসারের বিপথগামী মানুষদের সুপথে আনয়ন করতে। তা তিনি পারেননি বলেই সংসারের সব প্রতিকূলতার কাছে আত্মসমর্পণ করে নিজে হেরে গেছেন। হেরে যাওয়া মানুষের দল কোথাও বাঁচার জন্য শক্ত খুঁটি খুঁজে পায় না। সে বাঁচতে চায়। কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি কেবল পরপারের অন্ধকারময় পথ দেখিয়ে দেয়। তখন বিপদগ্রস্ত মানুষ নিয়তির দেখানো পরপারের অন্ধকারময় পথ দিয়ে হাঁটতে চায়। ভাবে নিয়তির দেখানো অন্ধকারময় পথ দিয়ে হাঁটলেই বুঝি শান্তির ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যাবে। মানুষ তখন শান্তির প্রত্যাশায় পাপপুণ্যের কথা ভুলে যায়। ভাল-মন্দের ভেদাভেদ নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চায় না। অনেক সময় আত্মহত্যার পথটাকেই সঠিক পথ বলে বিবেচনা করে। মানুষ যখন নিজের মত করে সবকিছু সাজাতে পারে না, তখনইতো তার মধ্যে রাজ্যের তাবৎ বিভ্রান্তি দেখা দেয়। এই বিভ্রান্তির হাতছানিতেই মানুষ নিজেকে ধ্বংস করে দেয়। জয়া সেন নিজেও বিভ্রান্ত অভিমানে অতিমাত্রায় প্রভাবিত হয়ে নিজেকে ধ্বংস করে দিয়ে পরপারে অর্থাৎ না ফেরার দেশে চলে গেছেন।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছে নিজের মেয়ের হুমকির পর আত্মহত্যা করেছেন জয়া সেন। এ বয়সে এত আদরের মেয়েটা আত্মহত্যার হুমকি দেবে এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি মা। এটা সইতে না পেরে নিজেই আত্মহননের পথ বেছে নেন জয়া সেন। তবে পুলিশ বলেছে, মূলত শ্বাশুড়ির নির্যাতন, স্বামীর মদ্যপান ও মেয়ের আত্মহত্যার হুমকি সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। এমন অভিযোগ প্রতিবেশীরাও করেছেন। জয়া সেনের আত্মহত্যার খবরটা আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ সংসারের কাছে কতটা গুরুত্বপূণ তা রাষ্ট্রের কর্ণধাররাই বলতে পারবেন। এমন আত্মহত্যার সংবাদ আমরা আমাদের প্রতিদিনের সংবাদপত্রে প্রায়ই দেখে থাকি। কেউ তা পাঠ করেন। কেউ করেন না। আবার এসব সংবাদ অনেক সময় দেশের সংবাদপত্রগুলো গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশও করে না। আমার কাছে কেন জানি মনে হয়, একটা মানুষের আত্মহত্যা করাটা আমাদের এই সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার চরম অসুস্থতার কথাই বলে যায়। বলে যায় আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থার অসংগতি ও নিরাপত্তাহীনতার কথা। কোন মানুষ যখন সময়ের ভার সইতে পারে না, তার ভেতর আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়। চলমান সময়কে কঠিন করে ফেলে আমাদের সমাজের একাংশ মানুষের অতিলোভ- লালসা কিংবা কিছু মানুষের অতি আধুনিক হওয়ার নিষ্ফল মানসিকতা। আমরাতো এটাও জানি, কোন কিছু বেশি করাটা ভাল নয়। শেষে তা বিপদ ডেকে আনে। মানুষ অবশ্যই আধুনিক হবে। আধুনিকতা মানেই হলো সুন্দর স্বপ্নের দিকে ছুটে যাওয়া। মানুষ যদি আধুনিক চিন্তা ভাবনা না করত তাহলে আজকের পৃথিবী এতটা সুন্দর হত না। একথাতো ঠিক, আপনাকে যতই সুস্বাদু খাবার দেয়া হোক না কেন, সে খাবার যদি নিরাপদ না হয় অর্থাৎ তার মধ্যে যদি ফর্মালিন কিংবা বিষ মিশানো থাকে, তাহলে কি সেই সুস্বাদু খাদ্য আপনার জন্য নিরাপদ হবে? আমারতো মনে হয় এমন বিষ মিশানো খাদ্য ভোজন করলে যে কারো মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠবে। ঠিক তেমনি আধুনিকতার মাঝে যদি অসভ্যতা কিংবা সময়ের অসামঞ্জস্যতার প্রশ্রয় থাকে, তাহলে কেউ সেই অশোভন আধুনিকতায় ডুব দিয়ে সফলতাটুকু ঘরে তুলতে পারবে না। জয়া সেন তার সন্তানদের নিয়ে সবসময় দুঃচিন্তাগ্রস্ত থাকতেন। তিনি চাইতেন তার সন্তানরা লেখাপড়ার বয়সে লেখাপড়া নিয়েই থাকুক। অন্য কোন অপ্রাসঙ্গিক চিন্তা কিংবা কর্মে নিমগ্ন না হোক। ঐ সংবাদে ভাষ্যে বলা হয়েছে জয়া সেনের এক সন্তান অর্থাৎ মেয়ে নবম শ্রেণির ছাত্রী এক ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। যা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। তিনি তার মেয়েকে ঐ ছেলের সাথে সম্পর্ক রাখা থেকে বিরত থাকতে বললে, মেয়ে আত্মহত্যার হুমকি দেয়। যে হুমকি পেয়ে হয়তোবা জয়া সেন রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে-অপমানে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। জয়া সেন জানতেন মেয়ে এখনো নাবালিকা। এখনো তার ভাল মন্দ বুঝার বয়স হয়নি। পরিপক্ব বয়সে মানুষ যা করে তা বুঝে শুনেই করে। আর আবেগের বশে মানুষ ভুল করে বসে। তাই জয়া সেন চাইতেন মেয়ে এই অপরিপক্ব বয়সে যাতে কোন ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে না পড়ে। তিনি এটাও চাইতেন মেয়ে কোনো ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যাতে নিজের কিংবা পরিবারের জন্য কোন ধরনের বিপদ ডেকে না আনে। আজকের দিনের নাবালক-নাবালিকা ছেলে-মেয়েরা পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার রঙ্গীন স্বপ্নে বিভোর থাকে। তারা ভাল মন্দের হিসাবই করতে পারে না। তার মধ্যে আবার চলমান উগ্র ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণা নিজেকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলে। তাই জয়া সেনের মেয়ে হুমকি দেয়, তার পথে কেউ কাঁটা হয়ে দাঁড়ালে আত্মহত্যা করতে যাবে। আমরা এমন এক সমাজ ব্যবস্থায় বসবাস করছি, যেখানে রঙ্গিন স্বপ্ন আছে। কিন্তু সেই স্বপ্নের শুভ কোন ফল নেই। পুঁজিবাদ আমাদেরকে এমন এক ঘোরের মধ্যে রাখে, যে ঘোরের উদ্দীপনায় আমরা ভাবি আমরা খুব ভাল আছি। মনে হয় আমরা আমাদের হাতের কাছে সবকিছু পেয়ে যাচ্ছি। আধুনিক ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে একদল মানুষ সন্তানদের এমন এক অন্তঃসার শূন্য স্বপ্নের ভেলায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যেখান থেকে সন্তানরা সুস্থ মন মানসিকতা নিয়ে সামাজিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করতে যেন আজ বাঁধাগ্রস্ত কিংবা দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছে। আজ আমাদের আগামী প্রজন্মের হাতে সহজেই এসে যাচ্ছে মাদকসহ সকল নিষিদ্ধ সামগ্রী। সীমান্ত হয়ে আমাদের ছেলেদের হাতে এসব নিষিদ্ধ মাদক সামগ্রী কিভাবে আসে! তা কেউ চিন্তা-ভাবনা করে দেখেন না। যারা চিন্তা করবেন তারা চলেন অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের আড়াল করে। তাইতো আমরা দেখি, বিক্রয়ের জন্য নয় এমন সরকারি ওষুধ সামগ্রী খোলা বাজারে রাষ্ট্রের সকল আইন-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করে বিক্রি হতে। এই ওষুধ পাচারকারীদের জেল জরিমানা করেও রাষ্ট্র থামাতে পারছে না। একবার ভাবুনতো দেখি, যে সময়টা আমরা পার হয়ে এসেছি এই বিশ্বায়নের সময়ের আগের কথা বলছি, আমাদের কালের সেই সময়ে কি কোন সন্তান সাহস করত তার মাকে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকা না থাকা নিয়ে আত্মহত্যার হুমকি দিতে চলমান সময়ে সন্তানরা তার পিতা-মাতাকে আত্মহত্যার হুমকি কেন, যে কোন বিপদজ্জনক বিষয়ে হুমকি দিতে পারে। এখন হুমকি দিতে পারে এই জন্য যে, পুঁজিবাদী অর্থনীতি আমাদের চিন্তাকে এতটাই কা-জ্ঞানহীন করে তুলেছে যে, যেখানে সবাই ভাবছে আমার ব্যক্তিত্বের উপর আর কে আছে? আমাদের সন্তানরাও ভাবে, তারা নিজেদের মধ্যে যেসব স্বপ্ন লালন-পালন করে তার বাস্তবায়নে অভিভাবকের বাঁধা দিবার কোন অধিকার নেই। মূল কথা হচ্ছে জয়া সেনের আত্মহত্যার জন্য তার সন্তানকে দায়ী করা ঠিক হবে না। দায়ী যদি করতে হয়, তাহলে করতে হবে এই বিশ্বয়ানের যুগের পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থাকে। যে অর্থব্যবস্থা মানুষকে সৃজনশীল হতে বাঁধাগ্রস্ত করে। যে অর্থব্যবস্থা সন্তানকে তার পিতা-মাতার প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলে। যে অর্থব্যবস্থা রাজ্যের প্রজাদেরকে সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশের প্রজাদের মত জড়বুদ্ধি সম্পন্ন করে তুলতে চায়। জয়া সেনের আত্মহত্যার জন্য আমরা শুধু চারিদিকের সমাজ ব্যবস্থার চালচিত্র দেখে বিচার-বিবেচনা করে হতাশ হতে পারি। এর বাইরে আর কিছুই নয়। কেননা, চলমান সময়ের মিথ্যে আষ্ফালনকে কিংবা রঙ্গিন স্বপ্নকে আমাদের সন্তানরা কিছুতেই না বলতে পারছে না। তাই এখানে যে কথা বলতে চাই, তা হলো, আমরা যদি আমাদের সন্তানদের সুন্দরের দিকে কিংবা বাস্তব স্বপ্নের দিকে নিয়ে যেতে চাই, তাহলে যে কাজটি প্রথমে করতে হবে, তা হলো এই পুজিঁবাদী সমাজ ব্যবস্থার আলো ঝলমল রঙ্গিন হাতছানি থেকে তাদের ফেরাতে হবে। তবেই তারা রক্ষা পাবে এই সমাজের অন্ধকার ও মিথ্যা আশ্বাস থেকে। আমাদের সন্তানদের বুঝাতে হবে আমরা একটি অস্থির সময় পার করছি। যে অস্থির সময়ের ভুল ব্যাখ্যা আমাদের সবকিছুকে তছনছ করে দি”েচ্ছ। আমাদের সন্তানদের সাথে আমাদের সম্পর্ক হতে হবে বন্ধুর মত। খোলামেলাভাবে তাদের বুঝাতে হবে তারা কোথায় ভুল করছে কিংবা কোথায় শুদ্ধ করছে। তাদের বলতে হবে, আমরাও তোমাদের বয়স পার হয়ে এসেছি। তখন আমরাও তোমাদের মত বুঝিনি কোথায় ভুল করেছি, কোথায় শুদ্ধ করেছি। এখন এই বয়সে এসে বুঝতে পারছি, কোথায় আমাদের ভুল ছিল। তাই আমরা চাই না আমরা যে ভুল করছি আমাদের সন্তানরাও সেই ভুল করুক। আমরা যদি আমাদের সন্তানদের সাথে এমনভাবে খোলামেলা আলোচনা করে বন্ধুর মত চলতে পারি, তবেই দেখা যাবে জয়া সেনের মত কোন মা সন্তানের আত্মহত্যার হুমকিতে ভেঙে পড়ছেন না এবং আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন না।
লেখক : কবি, গল্পকার, আইনজীবী
কালীবাড়ী রোড, হবিগঞ্জ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ ও কিছু কথা
আরও পড়ুন