Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শত সঙ্কটেও আশা জাগাচ্ছে রেমিট্যান্স

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৯ মে, ২০২০, ১২:০১ এএম

বরিশালের মনির হোসেন সাগর দীর্ঘ ১০ বছরের বেশি সময় ধরে সউদী আরব থাকেন। ছোট ব্যবসা করেন। গড়ে প্রতিমাসে ৩০-৩৫ হাজার টাকা দেশে পাঠান। করোনায় সউদী আরবে লকডাউনসহ নানা সমস্যায় এপ্রিলে টাকা পাঠাতে না পারলেও মে মাসের শুরুর তিনি ২৫ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন বলে জানালেন তার স্ত্রী মনিরা বেগম। মূলত এই টাকাতেই এখন তাদের সংসার চলে। সামনে ঈদ তাই আয় না থাকলেও পরিবারের জন্য পাঠাতে হয়েছে।

কুমিল্লার জাহাঙ্গির হোসেন থাকেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে। সেখানে তার একটি ছোট্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। তিনি জানালেন, দেশের সংকটের কথা ভেবে পরিবার ও স্বজনদের জন্য এপ্রিলে ১ লাখ টাকা পাঠিয়েছেন দেশে। তবে এই টাকা আগের। এখন কাজ নেই। সামনে ঈদ আরও কিছু টাকা পাঠাবেন। তবে কতো টাকা পাঠাতে পারবেন জানেন না।

মনির বা জাহাঙ্গিরের মতো ১ কোটিরও বেশি বাংলাদেশি এখন বিদেশে কাজ করছেন। যার মধ্যে ৭৫ শতাংশেই আছেন মধ্যপ্রাচ্যে। গতবছর এই প্রবাসী বাংলাদেশিরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় পাঠিয়েছেন। কিন্তু করোনার এই সংকটকালীন সময়ে তারাও নানা সংকটে আছেন। অনেকের বেতন কমে গেছে। অনেকের কাজ নেই। অনেক দেশে লকডাউন। রেমিট্যান্স হাউস বন্ধ। অনেককে দেশে ফিরতে হচ্ছে। সবমিলিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। তবে এরপরেও প্রবাসীরা দেশে পরিবারের জন্য টাকা পাঠানো পুরোপুরি বন্ধ করে দেননি। বরং ধারদেনা করে হলেও এখনো চেষ্টা করছেন টাকা পাঠাতে। আর সামনে ঈদের কারণে মে মাসে প্রবাসী আয় বাড়তির দিকে।

আর তাই করোনার সংকটময় সময়ে অর্থনীতিতে স্বস্তি জোগাচ্ছে প্রবাসীদের কষ্টের অর্থ রেমিট্যান্স। শত সংকটেও ঈদ সামনে রেখে দেশে টাকা পাঠানোর প্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রবাসীরা। চলতি মে মাসের প্রথম ১৪ দিনে মহামারির মধ্যেও প্রবাসী বাংলাদেশিরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা)। যা গত বছরের একই সময়ের প্রায় সমান। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেমিট্যান্স আহরণের প্রধান দেশগুলোয় করোনার প্রাদুর্ভাবে গত তিনমাস ধরে অচলাবস্থা। কাজ নেই, অনেকে ঘর থেকেও বের হতে পারছেন না। বেশিরভাগ দেশে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রবাসীরা চাইলেও দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারেননি। যার কারণে গত দুইমাস রেমিট্যান্সের প্রভাব কমেছে। তবে আস্তে আস্তে এখন বিশ্ব পরিস্থিতি উন্নত হচ্ছে। অচলাবস্থা অনেক দেশে স্বাভাবিক হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য চালু হতে শুরু করেছে। তাই ঈদের সামনে আবারও রেমিট্যান্স পাঠানো শুরু করেছেন প্রবাসীরা।

প্রতিবছরই ঈদের আগে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ে। গত বছরে ঈদের আগে মে মাসে ১৭৪ কোটি ৮২ লাখ ডলারের রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ওই সময়ে মে’র প্রথম ১৪ দিনে পাঠিয়েছিলেন ৮৭১ মিলিয়ন ডলার বা ৮৭ কোটি ১০ লাখ ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, করোনার প্রাদুর্ভাবের সময়ে আগের মাস এপ্রিলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ১০৮ কোটি ১০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন। যা গত ৩০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৮৫ কোটি ৬৮ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।

এদিকে চলতি বছরের এপ্রিলে পাঠানো রেমিট্যান্স আগের বছরের এপ্রিল মাসের চেয়ে ৩৫ কোটি ডলার বা ২৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ কম। গতবছর একই সময়ে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৪৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। এপ্রিলের আগের মাস মার্চে ১২৮ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল, যা গত বছরের মার্চ মাসের চেয়ে ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম।

এদিকে চলতি বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের যুগান্তকারী পদক্ষেপ রেমিট্যান্সে দুই শতাংশ প্রণোদনা প্রবাসীরা সহজে যেন পান সেজন্য বেশকিছু শর্ত শিথিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতদিন দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত রেমিট্যান্সের প্রণোদনায় কোনো ধরনের কাগজপত্র লাগত না। এর আওতা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১ জুলাই থেকে প্রবাসীদের পাঠানো পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার বা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত রেমিট্যান্সে বিনাশর্তে কোনো ধরনের কাগজপত্র ছাড়াই প্রণোদনার অর্থ প্রদান করা হবে। পাশাপাশি পাঁচ লাখ টাকার ওপরে কাগজপত্র জমা দেয়ার সময় বাড়ানো হয়েছে। এতদিন প্রণোদনা পেতে হলে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রাপক উত্তোলনের ১৫ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হত। এখন তা বাড়িয়ে দুই মাস করা হয়েছে।

জানা গেছে, এতদিন দেড় লাখ টাকার নিচে পাঠানো অর্থের বিপরীতে রেমিট্যান্সের নগদ প্রণোদনা পাওয়ার জন্য কোনো কাগজপত্র লাগত না। তবে দেড় লাখ টাকার বেশি রেমিট্যান্সের নগদ প্রণোদনা পাওয়ার জন্য রেমিট্যান্স প্রদানকারী ব্যাংকের শাখায় পাসপোর্টের কপি এবং বিদেশি নিয়োগদাতার দেয়া নিয়োগপত্রের কপি জমা দিতে হতো। এছাড়া রেমিট্যান্স প্রেরণকারী ব্যক্তি ব্যবসায় নিয়োজিত হলে তাকে ব্যবসার লাইসেন্সের ফটোকপি দিতে হতো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স আহরণে রেকর্ড হয়। ওই সময়ে প্রবাসীরা এক হাজার ৬৪২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। যা অর্থবছরের হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ।

এদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়া ও বিভিন্ন সংস্থার ঋণের কারণে রফতানি মন্দার মধ্যেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে। গত রোববার পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩৩ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার।

বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, যেসব দেশ থেকে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠাতেন, সেসব দেশে এখনও লকডাউন চলছে। অনেক প্রবাসী করোনায় আক্রান্ত। অনেকের হাতে কাজ নেই। অনেক প্রবাসী দেশে চলে আসছেন। মে মাসে ঈদের কারণে কিছুটা হয়তো প্রবাসী আয় বাড়তে পারে। তবে সার্বিকভাবে এ বছর আয় কমবে।

সংকট সমাধানে করণীয় কী হতে পারে জানতে চাইলে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, প্রবাসীদের যেন চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরতে না হয় কূটনৈতিকভাবে সেই চেষ্টা করা যেতে পারে। প্রবাসীরা যেখানে আছেন সেই দেশগুলোকে বোঝাতে হবে সামনে তাদের কর্মী প্রয়োজন হবে।



 

Show all comments
  • Md Yasin Khan ১৯ মে, ২০২০, ১:২৬ এএম says : 0
    এ জন্যই তো প্রতিদিন মা বোন তুলে গালাগালি করে দেশ প্রেমিরা দেশে বসে
    Total Reply(0) Reply
  • মোহাম্মদ কাজী নুর আলম ১৯ মে, ২০২০, ১:২৭ এএম says : 0
    হুম, সত্যিই একটা আশা জাগানির প্রতিবেদন।
    Total Reply(0) Reply
  • সাইফুল ইসলাম চঞ্চল ১৯ মে, ২০২০, ১:২৭ এএম says : 0
    বিশ্বের সব দেশের তো আর এক রকম অবস্থা না। গড়ে আশা করা যায় রেমিটেন্সই বাংলাদেশের জন্য েএকটি আশির্বাদ হয়ে থাকবে।
    Total Reply(0) Reply
  • নাসিম ১৯ মে, ২০২০, ১:২৮ এএম says : 0
    রেমিটেন্সযোদ্ধাদের ধন্যবাদ জানাই।
    Total Reply(0) Reply
  • করণীয় কী হতে পারে জানতে চাই. ১৯ মে, ২০২০, ৪:৪৬ এএম says : 0
    ইউরোপ, কানাডা ও আমেরিকা বাংলাদেশের মানুষের রক্ত পান করে সব টাকা ইউরোপ এবং আমেরিকায় নিয়ে যায়. তারা এই জাতিকে ভেঙ্গে দিয়েছে, এই রাষ্টকে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বানিয়ে মুসলমানিত্ব ধংস করে আজকে নামাযীদেরকে খুন করে নামাজ বন্ধ করে.
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammed Azizul Hoque ১৯ মে, ২০২০, ৮:৪০ এএম says : 0
    Never insult remittance fighter
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রেমিট্যান্স

২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ