Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিশ্বজুড়ে জরুরি অবস্থা

প্রকাশের সময় : ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৩৫ পিএম, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

ইনকিলাব রিপোর্ট : জিকা ভাইরাস নিয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা রেড অ্যালার্ট জারি করলেও বাংলাদেশ এখনো কম ঝুঁকিতে রয়েছে বলে দাবি করেছেন দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা। তারা জানান, এটা একেবারেই অচেনা রোগ। উপসর্গও খুব অস্পষ্ট। ফলে এ রোগে আক্রান্ত হলে নির্ণয় করাও সহজ নয়। নিঃশব্দে মস্তিষ্ক শেষ করে দেয় জিকা ভাইরাস, যা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। নেই কোনো প্রতিষেধকও। জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মাঝারি মাত্রার জ্বর, চোখে প্রদাহ ও মাথাব্যথা হয়। গর্ভবতী নারী জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে গর্ভের সন্তানের মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এডিস মশা জিকা ভাইরাস বিস্তারের জন্য দায়ী। আমাদের দেশে এডিস মশা থাকলেও দেশে বা পাশের দেশগুলোতেও এখনো এ ধরনের কোনো জীবাণুর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার মাধ্যমেই জিকা ভাইরাস সংক্রমণ ঘটে। তাই দেশে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে চলমান কর্মসূচি আরও জোরদার করার মাধ্যমে জিকা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিমুক্ত থাকা সম্ভব।
জিকা ভাইরাস দ্রুত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটি বলেছে, মশাবাহিত এই ভাইরাসটি সংক্রমণ ঠেকাতে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এই সিদ্ধান্ত নেয়ার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে সংস্থার মহাপরিচালক মার্গারেট চ্যান জেনেভায় সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের আর অপেক্ষা করার সুযোগ নেই। জিকা ভাইরাস দুই আমেরিকার ২৪টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে বলে দি প্যান আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশন জানিয়েছে। এতে আক্রান্তের সংখ্যা ৪০ লাখ। শুধু ব্রাজিলেই এই ভাইরাসের কারণে ৪০ হাজার শিশু বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নিয়েছে। জিকা ভাইরাস মোকাবেলায় করণীয় নিয়ে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে গত সোমবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জরুরি বৈঠক শেষে এই ঘোষণা দেন মার্গারেট চ্যান। এদিকে দক্ষিণের ২৪টি দেশ ও বিশ্বব্যাপী এই ভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও বাংলাদেশ এখনও ঝুঁকিমুক্ত। একই সঙ্গে আতঙ্কিত হওয়ারও কিছু নেই বলে জানিয়েছেন দেশের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। তবে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার মাধ্যমেই জিকা ভাইরাস সংক্রমণ ঘটে। তাই দেশে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে চলমান কর্মসূচি আরও জোরদার করার মাধ্যমে জিকা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিমুক্ত থাকা সম্ভব বলে মনে করেন তারা। তারা জানান, রোগটির বাহক এডিস মশা। যদিও আমাদের দেশে এডিস মশা রয়েছে। তারপরও দেশে বা পাশের দেশগুলোতেও এ ধরনের কোনো জীবাণুর অস্তিত্ব এখনও পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করেন তারা।
জিকা ভাইরাস নিয়ে বিজ্ঞানীরা বলছেন, গর্ভবতী মা জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার অনাগত শিশুর মাথা স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট হতে পারে, মস্তিষ্কের গঠন থাকতে পারে অপূর্ণ। এ রোগকে বলে মাইক্রোসেফালি। এ ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক বা ওষুধ নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিশ্রাম ও বেশি করে তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনকারীরা আফ্রিকা থেকে মশার এই জাতকে সমুদ্র পার করে আমেরিকায় নিয়ে আসেন বলে গবেষকদের ধারণা।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক প্রফেসর ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, বিশ্বব্যাপী এই ভাইরাস ছড়ালেও আমাদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এখনো দেশে এ ধরনের কোনো লক্ষণ পাওয়া যায়নি। আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে প্রাথমিক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দেশের কোথাও এ ধরনের রোগের অস্তিত্ব পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন পয়েন্টে আগে থেকেই থার্মাল স্ক্যানার বসানো আছে। বিদেশ থেকেও কেউ আসলে তা সাথে সাথে সনাক্ত হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, আমেরিকা মহাদেশের যে অঞ্চলে রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে অর্থাৎ ব্রাজিল ও আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক সীমিত। এ ছাড়া ওসব দেশে আমাদের দেশ থেকে শ্রমিক বা পর্যটকের তেমন আসা-যাওয়া নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ইন্টারন্যাশনাল হেলথ রেগুলেশন (আইএইচআর) কমিটির এই সদস্য বলেন, জ্বর ও গায়ে লালচে রেশ ওঠা জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ। শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে রোগী ওষুধপত্র ছাড়াই সুস্থ হয়ে যায়। তবে গর্ভবতী মায়েদের জিকাবাহী এডিস মশা কামড়ালে তাদের সন্তানদের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা সত্যিই উদ্বেগজনক। ব্রাজিলে একই সঙ্গে এ ধরনের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশুর জন্মগ্রহণের পর গোটা বিশ্বে এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় বলে তিনি জানান।
ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশন কিংবা পৌরসভায় যে স্প্রে কার্যক্রম পরিচালিত হয় তা বাড়ানোর জন্য সভা ডাকা হয়েছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তিনি বলেন, এডিস মশা ঘরের ভেতর ও আঙ্গিনায় জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে জন্মায়। ফলে ডেঙ্গু বা জিকা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ ও সংক্রমণমুক্ত থাকার বিষয়টি জনগণের সচেতনতার ওপর অধিক নির্ভরশীল বলে উল্লেখ করেন তিনি।
যদিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা. শাহিনা তাবাসসুম বলেন, জিকা একটি নতুন ভাইরাস। তবে ভাইরাস এমন একটি অণুজীব যা খুব দ্রুত পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে বংশ বিস্তার ঘটাতে সক্ষম। তাছাড়া ভাইরাসের কোনো সীমা নেই। তাই আমাদের একেবারে নিশ্চিন্তে থাকা উচিত হবে না। তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশে অতীতে ইবোলা বা মার্স ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে যে ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল জিকার জন্যও সে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
অবশ্য আমেরিকার আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইউরিয়েল কির্টন জিকার প্রাদুর্ভাবের জন্য নগরায়নের ধরনকেও দায়ী করেছেন। তার মতে, গত সাত দশকে ব্রাজিলে নগরায়নের হার ২০ থেকে বেড়ে ৮০ শতাংশ হওয়াও এডিস এজিপ্টির বিস্তার বাড়ার অন্যতম কারণ। বংশ বৃদ্ধির জন্য এ মশার পরিষ্কার পানি দরকার হয় না। ফুলের টবের মতো ছোট ও বদ্ধ পাত্রে সহজেই ডিম পাড়তে পারে। আর সঙ্গে আছে প্রচুর খাবার, মানে মানুষের রক্ত। নগরের ঘিঞ্জি পরিবেশও এই মশা বিস্তারের সহায়ক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বজুড়ে মশাবাহিত নতুন আতংক জিকা। একেবারেই অচেনা রোগ, উপসর্গও খুব অস্পষ্ট। ফলে এ রোগে আক্রান্ত হলে নির্ণয় করাও সহজ নয়। নিঃশব্দে মস্তিষ্ক শেষ করে দেয় জিকা ভাইরাস, যা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। নেই কোনো প্রতিষেধকও। জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মাঝারি মাত্রার জ্বর, চোখে প্রদাহ ও মাথাব্যথা হয়। গর্ভবতী নারী জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার গর্ভের সন্তানের মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এডিস মশা জিকা ভাইরাস বিস্তারের জন্য দায়ী। তবে এই ভাইরাসে সচরাচর মৃত্যুর ঘটনা দেখা যায় না।
জিকা ভাইরাসের কারণে নবজাতক শিশুর মধ্যে গুরুতর জন্মগত ত্রুটির কারণেই বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বেশি। আমেরিকায় ডব্লিউএইচওর আঞ্চলিক কার্যালয়ের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ মার্কোস এসপাইনাল এ ভাইরাসজনিত প্রায় ৪০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হওয়ার আশংকা প্রকাশ করে বলেন, জিকা ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক বা টিকা এখনও নেই। এ ভাইরাস আক্রান্তদের বেশিরভাগেরই কোনো লক্ষণ প্রকাশ না পাওয়ায় রোগ শনাক্ত করাও কঠিন।
গত বছর মে মাস থেকে ব্রাজিলে জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। এরপর থেকে দেশটিতে অপরিণত বা ছোট মস্তিষ্কের শিশু জন্ম নেয়ার হার আশংকাজনকভাবে বেড়ে যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় শিশুদের এ অবস্থাকে বলা হয় ‘মাইক্রোসেফালি’। এতে আক্রান্ত শিশুর মস্তিষ্কের গঠন সম্পূর্ণরূপে হয় না। ফলে ওই শিশু বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হতে পারে, শারীরিক বৃদ্ধি বিলম্বি^ত হতে পারে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্তও হতে পারে। গত বছরে বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে ইবোলা ভাইরাস। প্রায় ১০ হাজার মানুষ ইবোলায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তাই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা জিকা ভাইরাস নিয়ে আগে থেকেই সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব ইবোলোর মতো জিকা ভাইরাস মোকাবেলাকেও সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। পরিস্থিতি মোকাবেলায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেও ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রয়োজন এখনও হয়নি বলে মনে করেন মার্গারেট চ্যান। জিকা ভাইরাসে যেহেতু গর্ভবতী নারীদের ক্ষতির মাত্রাই বেশি, সেজন্য আক্রান্ত এলাকায় তাদের ভ্রমণ না করার পরামর্শ দিয়েছেন চ্যান। তিনি ভাইরাস আক্রান্ত এলাকায় গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসকের নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকার পরামর্শও দেন। চ্যান বলেন, এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে গর্ভবতী নারী ও তাদের শিশুদের রক্ষায় এবং মশা নিয়ন্ত্রণে।
পূর্ব আফ্রিকার দেশ উগান্ডার অতি পরিচিত জিকা (স্থানীয় ভাষায় বাড়ন্ত) বনাঞ্চলে ১৯৪৭ সালে প্রথম এ ভাইরাসের সন্ধান মেলে। এ কারণে এর নাম দেয়া হয় ওই বনেরই নামে। তবে তা কখনোই মহামারী আকারে ছড়ায়নি। এবার নতুন করে দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলে গত বছরের মে মাসে এ ভাইরাস শনাক্ত হয়। এডিস মশার কারণে ছড়ানো এ ভাইরাস ইতিমধ্যে ব্রাজিল ও এর আশপাশের ২৪টি দেশে ছড়িয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিশ্বজুড়ে জরুরি অবস্থা

৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ