Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইবাদতের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ চলে না

প্রকাশের সময় : ২২ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রাজনৈতিক ভাষ্যকার : গুলশান ও শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে মিডিয়ায় নানা তথ্য প্রতিদিনই আসছে। বহু লোক এসব নিয়ে নিজ নিজ মতামত দিচ্ছেন। জনগণ ভাবনায় পড়েছে, সাধারণ মানুষ উদ্বেগ ও আতঙ্কে থাকছে, দায়িত্বশীলেরা বিভিন্ন মন্তব্য করছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মা-বাবারা সন্তানের খোঁজ-খবর নিন, তাদের সাথে কথাবার্তা বলুন, গল্প করুন। সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষা দিন, সব ধর্মই শান্তির কথা বলে। সরকারপ্রধানের এ প্রজ্ঞাপূর্ণ মন্তব্যের সাথে তার অধীনস্থ কিছু কর্মচারীর কথাবার্তা ও উদ্যোগ যে কত বেশি সাংঘর্ষিক তা কি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আছে? আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি, পরিস্থিতি অহেতুক ঘোলাটে করতে এসব অবিমৃশ্যকারীর ভূমিকা সব সময়ই ছিল বিরক্তিকর ও বিপজ্জনক, যার দায় নিতে হয়েছে সরকারকে অথচ উদ্যোগটি সরকারের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে নেয়া হয়নি। কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চ পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, দু-একজন বেয়াড়া আমলা ও কর্মচারীর লাগাম কেউই টেনে ধরতে পারছে না। বারবার তাদের বিশৃঙ্খল কাজের ক্ষতিকারিতার ব্যাপারে ওপর মহলকে জানানো হলেও ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও কথিত আনুগত্যের দোহাই দিয়ে তারা পার পেয়ে যাচ্ছে।
গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে গোটা জাতি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। দেশের এমন কোনো শ্রেণী, সমাজ, দল ও সংগঠন নেই যারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়নি। বিগত সময় অনেক মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা তাদের কথায়, লেখায় ও টকশোর বক্তৃতায় মাদরাসা পড়–য়াদের সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার কথা বলার চেষ্টা করেছেন। যদিও সংঘটিত কোনো সন্ত্রাসেই মাদরাসাছাত্রদের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়নি। জেএমবি বা এবিটির কর্মকা-েও আধুনিক শিক্ষিতদের সম্পৃক্ততাই দেখা যাচ্ছে। সর্বশেষ গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনায় আধুনিক শিক্ষিত তো বটেই উচ্চবিত্ত ও ব্যাপক সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত তরুণদের অংশগ্রহণ প্রমাণিত হওয়ায় পূর্বোক্ত প্রচারণা স্তিমিত হয়ে যায়। যারা কেবল মাদরাসা শিক্ষা, দারিদ্র্য ও সুবিধাবঞ্চিত হওয়াকেই সন্ত্রাসী হওয়ার কারণ হিসেবে সাব্যস্ত করতে চাইতেন তারা এবং তাদের অনুসারীরা যেন গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনায় বজ্রাহত হন। বিশেষ করে গত প্রায় ২০০ বছর ধরে অনুষ্ঠিত শোলাকিয়ার ঈদ জামাতে কোনো দিন সন্ত্রাসী হামলা হয়নি। মাদরাসার ছাত্র, গরিব ছাত্র, সুবিধাবঞ্চিত লোকেরা তো এ মাঠের স্থপতি, ইমাম, মুসল্লি, ব্যবস্থাপক, খাদেম, স্বেচ্ছাসেবক ইত্যাদি হিসেবে ২০০ বছর ধরেই ছিলেন, আছেন। এ বছর কেন এ মাঠে হামলা হলো? কেন বিশ্বব্যাপী ইসলামবিরোধী এ হত্যা-সন্ত্রাসকে আইএস স্বীকৃতি দিচ্ছে? সারা বিশ্বে আইএস যোদ্ধারা কি মাদরাসা শিক্ষিত? তাদের প্রোফাইল তো অনেক উন্নত। বিত্তবান, অত্যাধুনিক জীবনমান সম্পন্ন, শিক্ষিত তরুণরাই কেন আসছে আইএসে? বাংলাদেশের হামলাকারীরা কেউই আইএস নয়, এদের সবাই জেএমবির সাথে যুক্ত। এরপর ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে করা হয় এক নতুন নাটক। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণার কাজে দেশের ৩০ লাখ মসজিদকে ব্যবহার করার এক অভিনব ধারণা এই সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার উর্বর মস্তিষ্কে জন্ম নেয়। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ভেতর ও বাইরের কিছু আলেমকে সম্পৃক্ত করে একটি খুতবা সংকলন তৈরির প্রকল্প গ্রহণ করেন। প্রথম বিস্ফোরণটি ঘটান সন্ত্রাসবিরোধী খুতবা প্রেরণের মাধ্যমে। দেশের কোনো বিবেকবান মানুষই এ উদ্যোগটিকে সেদিন সহজভাবে নেননি। অসুস্থ মানসিকতার কিছু বিবেকপ্রতিবন্ধী ছাড়া দেশের কোটি কোটি মুসল্লির কেউই এ কাজটিকে ইতিবাচক গণ্য করেননি। রাজনীতিক আবদুল কাদের সিদ্দিকী মন্তব্য করেছেন, যদি আর ১০টি জুমায় এভাবে সরকারি খুতবা মসজিদে পাঠ করা হয় তাহলে বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি প্রশ্ন করেছেন, অন্য কোনো ধর্মের লোকেরা কি সন্ত্রাস করে না? সন্ত্রাস মানেই কি মুসলমানের কাজ? সরকার কেন প্রচার করতে চাইছে যে, বাংলাদেশের মসজিদগুলোই সন্ত্রাস তৈরির উৎস। এখানে খুতবা নিয়ন্ত্রণ করলেই সন্ত্রাস বন্ধ হবে। একজন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও কলামিস্ট লিখেছেন, শত শত বছর ধরে যে খুতবা লাখো মসজিদে দেয়া হয়েছে তাতেই কি সন্ত্রাসবাদের সৃষ্টি? যদি তা হয় তাহলে সরকারকে বলতে হবে খুতবার কোন জায়গায় সন্ত্রাসের শিক্ষা রয়েছে? যদি আগের খুতবায় সন্ত্রাসবিরোধী কথাই থেকে থাকে তাহলে নতুন করে খুতবা রচনার মাধ্যমে তারা দুনিয়াতে কী বোঝাতে চেয়েছেন? দেশ-বিদেশের মানুষ উদ্দেশ্যমূলক এই খুতবা নাটকের মাধ্যমে কী বার্তা পেল? নিবন্ধে তিনি আরো বলেছেন, ১৫ জুলাই শুক্রবার সারাদেশের মসজিদগুলোতে যে শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয় তা ছিল একটি মনস্তাত্ত্বিক হামলা। ধর্মীয় শ্রেণীর ওপর একটি রাষ্ট্রীয় সাইকো সন্ত্রাস। যেন মনে হয় গুলশান ও শোলাকিয়াসহ দেশের সকল সন্ত্রাসী কার্যক্রমের উৎসস্থল এই জুমা ও খুতবা (নাউজুবিল্লাহ)। সবচেয়ে পবিত্র ও নিরাপদ জায়গা মসজিদে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নজরদারি। পুলিশ ও গোয়েন্দাদের নজরদারি। তরুণ নামাজিদের মনস্তত্ত্বে নামাজ সম্পর্কে নেতিবাচক উপলব্ধির জন্ম দেয়ার প্রচ্ছন্ন চেষ্টা। মসজিদে প্রবেশের পথে তল্লাশি। ইমাম ও খতিবদের স্বাভাবিক আলোচনা বাধাগ্রস্ত করে সরকারি আলেমদের তৈরি ভুলেভরা খুতবা ও বয়ান পড়ার প্রস্তাব। ইবাদত-বন্দেগীতে সরকারের হস্তক্ষেপ। কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে মানবজাতির সমাধান বর্ণনায় নিবেদিত খুতবা ও বয়ান নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা। এসবের মধ্যে কোনো মঙ্গল নেই। ইসলামকে নিয়ন্ত্রণ ও সংকোচনের প্রয়াস কোনো দিন সফল হবে না। বিশেষ করে সেক্যুলার সংবিধান অনুসরণ করে চলা সরকারি প্রতিষ্ঠানের কোনো অধিকার নেই আল্লাহ ও রাসূলের বিধানে পরিচালিত জুমা, খুতবা, নামাজ, বয়ান তথা ইবাদত বন্দেগী নিয়ন্ত্রণের কিংবা নির্দেশনার।
দেশের অন্তত দু’হাজার ইমাম-খতিব গত সপ্তাহে যোগাযোগ করেছেন দেশের অন্যতম ধর্মীয় নেতা ও চিন্তাবিদের সাথে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফী সরকার নিয়ন্ত্রিত খুতবা প্রত্যাখ্যানে দেশবাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে, যদিও তার ঘোষণার বহু আগেই দেশের শতভাগ ইমাম ও খতিব এই খুতবা-নিয়ন্ত্রণকে প্রত্যাখ্যান করেন। সরকারের কোনো অধিকার নেই ইসলামের এ গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতকে নিয়ন্ত্রণ বা দিকনির্দেশনা দিয়ে পরিচালনা করার। একমাত্র ইসলামী খিলাফত বা বিশেষায়িত ইসলামী সরকারই পারে খুতবার বিষয়ে নির্দেশনা দিতে। সেক্যুলার, সমাজতন্ত্রী ও সাধারণ পদ্ধতির সরকার তা পারে না। জনগণ যেমন মসজিদে দোয়ার আবেদন করেন, সরকারও তেমনি কোনো আবেদন করতে পারে। জবরদস্তি কিছু চাপিয়ে দিতে কখনোই পারে না, কারণ মসজিদ আল্লাহর নির্দেশে চলে, রাসুলের নিয়মে চলে। এখানে কোনো দলীয় আধিপত্য চলে না। ইফা ডিজির বরাত দিয়ে একটি অনলাইন মিডিয়া বলেছে, ভবিষ্যতে তার খুতবাই অনুসরণ করতে হবে। যারা তার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন, সেসব আলেমের ভবিষ্যৎ ভালো নয়। এমন হুমকিমূলক কথাবার্তায় দেশের ইমাম, খতিব ও আলেমরা বিব্রত। কর্মকর্তাদের  এমন কর্তৃত্ববাদী ও হুমকি-ধমকিপূর্ণ কথাবার্তায় অহেতুক প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের ক্ষতি হচ্ছে কিনা, আলেমসমাজের সাথে এবং তাদের অনুসারী ধর্মপ্রাণ কোটি কোটি মানুষের সাথে সরকারের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থারও কর্তব্য ইফা ডিজির হঠকারিতার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে নীতিনির্ধারকদের অবহিত করা। সন্ত্রাসদমনে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় ঐক্যের আহ্বানের সাথে সংহতি প্রকাশকারী শান্তিপ্রিয় আলেম সমাজকে মুক্তমনে তাদের চিরায়ত ভূমিকা পালনের পথ সুগম করে দেয়ার মাধ্যমে আস্থায় রাখা সরকারের জন্য যেমন ভালো, দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রের পক্ষেও এতেই মঙ্গল। সন্ত্রাসদমনে জাতীয় ঐক্যের যেমন বিকল্প নেই, তেমনি যুগে যুগে শান্তিময় বাংলাদেশের প্রধান রূপকার আলেম-উলামা-ইমাম-খতিব ও পীর মাশায়েখকে যথাযথ সম্মান ও স্বীকৃতি প্রদানও জরুরি।
যে কথাটি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে এসেছে, সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষা দান করুন, তাদের সময় দিন, তাদের নিয়ে গল্প করুন, তাদের খোঁজ-খবর রাখুন- এখানে ভাবার বিষয় একটিই যে, গোটা জাতিকে ধর্মীয় শিক্ষাদানে, শান্তি ও সম্প্রীতির বাণী শিক্ষাদানে মসজিদের চেয়ে বড় ভূমিকা আর কার হতে পারে? ইমাম-খতিব, পীর-মাশায়েখ, আলেম-উলামার চেয়ে বেশি শান্তির চর্চা এ দেশে কে কখন কোথায় করেছে? তাহলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এসব উদ্ভট উদ্যোগ আর একশ্রেণীর উগ্র মিডিয়ার প্রচারণা কেন বিশ্বকে এ বার্তা দিচ্ছে যে, সন্ত্রাস দমনের জন্য মসজিদ ও মসজিদসংশ্লিষ্ট মানুষকে নিয়ন্ত্রণ-নির্দেশনা এমনকি নজরদারিতে রাখতে হবে? সন্ত্রাস দমনের বা মূল থেকে নির্মূলের যে সামগ্রিক পরিকল্পনা নিতে হবে, যে ব্যাপক তৎপরতা চালাতে হবে, তাতে হাত না দিয়ে কেন নানা কায়দায় শান্তির দূত ধর্মপ্রাণ মানুষ, নামাজি যুবা-তরুণ ও মসজিদগামী কোটি জনতাকে দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে?




 

Show all comments
  • Fahad ২২ জুলাই, ২০১৬, ২:২৩ এএম says : 0
    সন্ত্রাসদমনে জাতীয় ঐক্যের যেমন বিকল্প নেই
    Total Reply(0) Reply
  • Jesmin ২২ জুলাই, ২০১৬, ২:৩৮ এএম says : 0
    যুগে যুগে শান্তিময় বাংলাদেশের প্রধান রূপকার আলেম-উলামা-ইমাম-খতিব ও পীর মাশায়েখকে যথাযথ সম্মান ও স্বীকৃতি প্রদান জরুরি।
    Total Reply(0) Reply
  • ফারজানা শারমিন ২২ জুলাই, ২০১৬, ২:৩৯ এএম says : 0
    হে আল্লাহ তুমি সকলকে তুমি সঠিক বুঝ দান করো।
    Total Reply(0) Reply
  • Rofiq ২২ জুলাই, ২০১৬, ২:৪১ এএম says : 0
    জবরদস্তি কিছু চাপিয়ে দিতে কখনোই পারে না, কারণ মসজিদ আল্লাহর নির্দেশে চলে, রাসুলের নিয়মে চলে। এখানে কোনো দলীয় আধিপত্য চলে না।
    Total Reply(0) Reply
  • Rakibul Islam ২২ জুলাই, ২০১৬, ৮:৫৯ এএম says : 0
    Right
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইবাদতের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ চলে না
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ