Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

টিভির টকশো এখন পাপেটশো!

প্রকাশের সময় : ২২ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:২২ পিএম, ২১ জুলাই, ২০১৬

স্টালিন সরকার : দেশের শিল্প-সংস্কৃতির কিংবদন্তী মুস্তফা মনোয়ার। কবি গোলাম মোস্তফার সুযোগ্য এই পুত্র সেই পাকিস্তান আমলে বিটিভি’র জন্মলগ্ন থেকেই শিশুদের বিনোদনের জন্য পাপেট-শো করেন। সেই ১৯৬৭ থেকে প্রায় ৫০ বছর ধরে বিটিভিতে রশি দিয়ে পুতুল নাচিয়ে শিশুদের শিক্ষা ও বিনোদন দিচ্ছেন। পাপেট নিয়ে বিটিভিতে তার শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান ‘মনের কথা’ শিশুদের প্রিয়। শিশুদের জন্য মুস্তফা মনোয়ারের শৈল্পিক সৃষ্টি ‘পাপেট’শো। বিটিভির ‘আজব দেশে’ অনুষ্ঠানে নিয়মিতভাবে ‘বাঘা’ ও ‘মেনি’ চরিত্র রচনা করে পাপেট-শোকে জনপ্রিয় করেছেন। শিশুদের কাছে পাপেট-শো এতো জনপ্রিয় যে চরিত্রগুলোর একজনের কথার পর অন্যজন কি বলবেন সেটা শিশুরা আগেই বুঝতে পারে। পাপেট-শো’র মানুষ-পশু-পাখিসহ নানা আকৃতির পুতুলগুলো সবজান্তা। লাটাই হাতে পরিচালক যে ভাবে নাচায়, যা বলায় প্রাণহীন পুতুলগুলো তাই করে। অবুঝ শিশু দর্শকরা সেটা দেখে-শুনে মজা পায়; হেসে গড়াগড়ি দেয়। স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর টক-শোগুলো এখন যেন সেই মুস্তফা মনোয়ারের পাপেট-শোতে রূপান্তর ঘটেছে। অথচ দু’তিন বছর আগেও দেশের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর টকশোগুলো ছিল জনপ্রিয়। দর্শকরা টকশো দেখার জন্য গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকতো।  
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে বহু বছর ধরে টকশো অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। বিবিসির হার্ডটক, সিএনএনে ওয়ান আওয়ার এবং আল-জাজিরার রিজ খান ও স্যার ডেভিড ফ্রস্টের টকশো সারাবিশ্বের দর্শকদের কাছে জনপ্রিয়। এসব অনুষ্ঠানে আমাদের দেশের নেতা ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময়ে অংশগ্রহণ করে থাকেন। আমাদের দেশে সম্ভবত চ্যানেল আইতে তৃতীয় মাত্রা নামের টকশো’র মাধ্যমে টিভি টকশো শুরু হয়। প্রচারের আগে ধারণ করে তৃতীয় মাত্রায় প্রচার করা হয়। এখনো সেটা অব্যাহত রয়েছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের প্রায় সব টিভি চ্যানেল বিভিন্ন নামের নানা আঙ্গিকে টক-শো চালু করে। এখন সে সব টকশোর অধিকাংশ সরাসরি প্রচার করা হয়।
অনেক টকশোতে দর্শকরা সরাসরি প্রশ্ন করে উত্তরও জানতে পারেন। চ্যানেলগুলোতে চিকিৎসা-স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের টকশো যেমন হচ্ছে; তেমনি রাজনীতি ও সমসাময়িক বিষয়াদি নিয়েও টকশো হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ রাজনীতি সচেতন হওয়ায় বেসরকারি চ্যানেলগুলোর টকশো অল্পদিনের মধ্যেই দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠে দর্শকদের কাছে। অবশ্য শুধু বাংলাদেশে নয়; বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে টকশো হচ্ছে জনমত গঠন, বিরোধীদের মত প্রকাশ, বিশেষজ্ঞদের জ্ঞান বিতরণ ও সরকারের গঠনমূলক সমালোচনার অন্যতম মাধ্যম। টিভির এসব টকশোতে সাধারণত দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ কার্যত তাদের অংশগ্রহণ করার কথা। এ অনুষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সাধারণ জনগণ অনেক অজানা বিষয় জানতে পারেন।
দেশের বিরোধপূর্ণ রাজনীতির কারণে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর টকশোতে অধিকাংশই সময় হতো তর্ক বিতর্ক। প্রথম দিকে দর্শক ধরে রাখার জন্য আয়োজকরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের মুখোমুখি করতেন। অতঃপর শুরু হয় বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিতর্ক। শিক্ষণীয় ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনার বদলে শুরু হয় কাদা ছোঁড়াছুড়ি। টিভির টকশোতে এমনও ঘটেছে বর্তমান মন্ত্রী বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিপক্ষ সাবেক মন্ত্রীর চোখ তুলে নেয়ার হুমকি দেন। এমনকি লাইভ টকশোতে আলোচকরা মুখযুদ্ধের এক পর্যায়ে একে অপরকে ঘায়েল করতে শারীরিকভাবে নাজেহাল করছেন। মূলত টকশোগুলো অল্প সময়ের মধ্যে দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারে নাটক-সিনেমা-বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের চেয়ে টকশোর দিকে বেশি আগ্রহী হন। টকশোতে কিছু বিধি নিষেধ থাকলেও আলোচনায় রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি তথা সমাজের প্রকৃত চিত্র উঠে আসতো; মানুষ জানতে পারতো। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী নির্বাচনের পর টকশোর প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে সরকারি মহল। টকশোতে যারা সরকারের সমালোচনা করেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং ভোট ও গণতন্ত্রের কথার প্রতি জোর দেন, তাদের প্রতি নাখোশ হন সরকারের নীতি নির্ধারকরা। সরকারের  দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা টকশোর আলোচকদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে নাম দেন টকারু। টকশোতে অংশ নেয়া কয়েকজন জনপ্রিয় আলোচকের ওপর অজ্ঞাত হামলা, হুমকি, মামলা এমনকি তাদের উপর বোমা নিক্ষেপ করা হয়। তাতেও কাজ না হওয়ায় অদৃশ্য শক্তি সমালোচকদের ওপর ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় দমন-পীড়ন শুরু করে। আর স্যাটেলাইট চ্যানেলের মালিকরাও ব্যবসায়িক ঝামেলা এড়াতে এবং সরকারকে খুশি রাখতে ‘সুবিধাবাদী’ কৌশল গ্রহণ করে। আবার কোনো কোনো চ্যানেলের টকশোতে বিভিন্ন ব্যক্তিকে (যারা সরকারের অনুগত) নেয়ার চাপও দেয়া হয়। অতঃপর চ্যানেলগুলোর টকশো কার্যত পাপেট-শোতে রূপান্তর ঘটে। দু’চারজন ব্যতিক্রম ছাড়া এমন সব মুখকে টিভির টকশোগুলোতে এখন দেখা যায় তাদের কাজই যেন সরকারকে তোষামোদ করা। সরকারকে খুশি করতে টিভি পর্দায় নানান থিউরি হাজির করেন ওই টকারুরা। গত এক বছর ধরে ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’ থিউরি জনগণকে গেলানোর চেষ্টা চলছে। দেশে কোথাও অঘটন ঘটলে তার জাস্টিফাই করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ঘটনার উদাহরণ টেনে দেশের অঘটনকে স্বাভাবিক হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করেন। এমন সব ব্যক্তিকে টকশোতে আনা হয় যার অধিকাংশকেই সাধারণ মানুষ চেনেন না। অথচ তারা সবজান্তা। হেন কোনো বিষয় নেই যে ওই বিষয় সম্পর্কে টকারুদের জ্ঞান নেই। ‘সবজান্তার’ মতো তারা জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দেন। ভূগোল কোনো দিন পড়েন নি, ইতিহাসেই বই স্পর্শ করেননি, মনোবিজ্ঞান খায় না মাথায় দেন সে ধারণাও রাখেন না; অথচ টকশোতে সে সব বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিচ্ছেন। টকশোর আলোচকদের সবাইকে দর্শকরা চেনেন না। অথচ কোন আলোচক কোন কথার পৃষ্ঠে অন্য আলোচক কি কথা বলবেন তা অনায়াসে দর্শকরা বলে দিতে পারেন। উচ্চ ডিগ্রীধারী এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত কিছু কিছু টকারু এমন সব কথাবার্তা বলেন যা শুনে রিক্সাওয়ালা দর্শকও লজ্জা পান। গ্রামের নিরক্ষর মানুষও হাসে। অথচ তোষামোদকারী টকারুদের কোনো লাজ লজ্জা নেই। ক্ষমতাসীনদের শীর্ষ ব্যক্তির মুখ ফসকে ‘পশ্চিমে সূর্য্য উঠেছে’ বললে ওই আলোচকরা সূর্য্য পশ্চিমে কি কারণে উঠলো তার নানান যুক্তি তুলে ধরতে ঘাম ঝরান। নিজস্ব বোধবুদ্ধি যেন তাদের নেই। বিবেক যেন বন্ধক রেখেছেন কিছু পাওয়ার আশায়। অবশ্য সরকারের তোষামোদীর পুরস্কার হিসেবে এদের কয়েক জনের মধ্যে কেউ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান, পিএসসির চেয়ারম্যান, সদস্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, দূতাবাসের পলিটিক্যাল সেক্রেটারী, ব্যাংক বিমা কোম্পানীর পরিচালক, বিভিন্ন বোর্ডের সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। রাজনীতির কাদা ছোঁড়াছুড়ির দৌড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেমন শিক্ষকতা এবং গবেষণার পরিবর্তে তোষামোদী চর্চায় রত; তেমনি বিভিন্ন পেশাজীবী ও সাংবাদিকদের মধ্যেও একই অবস্থা। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন আগেই দ্বিখ-িত হয়েছে। সংগঠনের নেতাদের কর্ম এবং তোষামোদী দেখে মনে হয় তাদের কাজ সংবাদ প্রকাশ প্রচারের জন্য নয়; তারা দলবাজীতে ব্যস্ত। সংগঠনগুলোকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে সেগুলোর নাম ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের পরিবর্তে ঢাকা সাংবাদিক লীগ ও ঢাকা সাংবাদিক দল রাখাই শ্রেয়। এরা টকশোতে গিয়ে যে ভাষা প্রয়োগ করেন এবং যে তোষামোদী করেন তা শুনে দর্শকদের মনে হয় না এরা রাষ্ট্রের চতুর্থস্তম্ভ মিডিয়া কর্মী। মনে হয় এরা কবি কাজী নজরুলের তোষামোদ কবিতার মূল চরিত্র।
স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর অধিকাংশ টকশো শুনে মনে হয় অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া ব্যক্তিরা কার্যত মুস্তফা মনোয়ারের পাপেট-শোর চরিত্র। লাটাই অন্যের হাতে থাকে তারা টিভির টকশোতে এসে পুতুলের মত নাচেন-কথাবার্তা বলে থাকেন। আর দু’চারজন ছাড়া টকশোর অধিকাংশ সঞ্চালক যেন ক্ষমতাসীনদের উচ্ছিষ্টভোগী। তারা এমন ভাবে আলোচনাকে সাজিয়ে তোলেন যে জনগণের ভোটের অধিকার নাই তাতে কি? সবকিছু ঠিক আছে আহা বেশ বেশ! তোষামোদকারী আলোচকরা যাতে নির্বিঘেœ তাদের যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, সে লক্ষ্যে প্রতিপক্ষের খেই হারিয়ে দিতে সদা প্রস্তুত থাকেন। এভাবেই চলছে দেশের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর টকশো। রংপুরে একটি আঞ্চলিক শব্দ রয়েছে ভকারু। যারা অতিরিক্ত কথা বলতে অভ্যস্ত তাদের রংপুরের মানুষ ভকারু খেতাব দেয়। যারা নিত্য রাতে তিন থেকে চারটি বেসরকারি চ্যানেলের টকশোতে অংশ নিয়ে সব জান্তার মতো জ্ঞান বিতরণ করছেন, প্রভাবশালীরা তাদের নাম টকারু দিলেও রংপুর অঞ্চলের মানুষ তোদের ভকারু বলে থাকে। প্রশ্ন হলো এক সময়ের জনপ্রিয় টকশো তাঁবেদার টকারু-ভকারুদের তোষামোদীতে পাপেট-শোতে পরিণত হওয়ায় দর্শকরা যে দূরে সরে যাচ্ছে অংশজনেরা কি সে খবর রাখেন? বিটিভিতে প্রচারিত ৮২ বছর বয়সী মুস্তফা মনোয়ারের পাপেটশো ৫০ বছর ধরে শিশুদের আনন্দ দিচ্ছে; অথচ স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোয় প্রচারিত টকশো ১০ বছর যেতে না যেতেই দর্শক হারালো কেন?



 

Show all comments
  • Md. Mohiuddin ২২ জুলাই, ২০১৬, ২:২৬ এএম says : 0
    Perfect example
    Total Reply(0) Reply
  • Biplob ২২ জুলাই, ২০১৬, ২:২৮ এএম says : 0
    akhon ata sobchaye biroktikor show
    Total Reply(0) Reply
  • সুফিয়ান ২২ জুলাই, ২০১৬, ২:২৯ এএম says : 0
    আপনার কথাগুলো তিক্ত হলেও সত্য। ধন্যবাদ এই কথাগুলো বলার জন্য।
    Total Reply(0) Reply
  • রেজবুল হক ২২ জুলাই, ২০১৬, ২:৩৩ এএম says : 0
    এখন আর এগুলো শুনি না। কেউ শুনছে দেখলেও মেজাজ গরম হয়ে যায়।
    Total Reply(0) Reply
  • Tania ২২ জুলাই, ২০১৬, ২:৩৫ এএম says : 0
    বিবেক যেন বন্ধক রেখেছেন কিছু পাওয়ার আশায়। ------------- it is a perfect sentence for them
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: টিভির টকশো এখন পাপেটশো!
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ