Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ইউরোপের নিরাপত্তা ব্যয় বৃদ্ধি করেছে

প্রকাশের সময় : ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : সাম্প্রতিক এক বিকেলের দৃশ্য। প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের নিচে বুলেট প্রুফ পোশাক পরে মেশিনগান হাতে দাঁড়িয়ে আছে একদল ফরাসি সৈন্য। জনতার ভিড়ের মধ্যে সম্ভাব্য সন্ত্রাসীদের খুঁজে ফিরছিল তারা। শুধু এখানেই নয়, সারা ফ্রান্সেই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, স্টোর ও সরকারি ভবনের চারপাশের রাস্তায় ১০ হাজারেরও বেশি সশস্ত্র সৈন্য টহল দিচ্ছে।
ইউরোপের সরকারগুলো পর্যটনকে স্থায়ী ঝুঁকি বলে ঘোষণা করেছে। ফলে ইউরোপের সামরিক ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। নিরাপত্তা জোরদার করার এ দিনগুলোতে ফ্রান্স দৈনিক ১০ লাখ ইউরো ব্যয় করছে। ২০১৫ সালে প্যারিসে ইসলামী উগ্রপন্থীদের দু’দফা ভয়াবহ হামলার পর সন্ত্রাস বিরোধী লড়াইয়ে ইউরোপের বর্তমান পদক্ষেপ ২০১০ সালের ঋণ সংকটের পর এ অঞ্চলে কৃচ্ছ্রতা অবলম্বনের অবস্থান থেকে সরে আসার কথাই প্রকাশ করছে। বস্তুত দেশগুলো একদিকে তাদের আর্থিক শৃঙ্খলা পরিত্যাগ করতে চাইছেনা, অন্যদিকে তাদের নেতারা নমনীয় নীতিকে উৎসাহিত করছেন যাতে ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি মোকাবেলায় তাদের আর্থিক শক্তির সমস্যা না হয়।
ফ্রান্স সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রয়েছে ঘোষণা করে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোয়াঁ ওলাদেঁ সম্প্রতি বলেন, সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করা, তাদের নেটওয়ার্ক ধ্বংস, অর্থায়ন বন্ধ করা এবং প্রচারণা ও উগ্রপন্থা ছড়ানোর অবসান ঘটানো আমাদের প্রয়োজন। তিনি সদস্য দেশগুলোর ঘাটতি কমিয়ে আনতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনের কথা উল্লেখ করে বলেন, স্থিতিশীলতা চুক্তির চেয়ে নিরাপত্তা চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
ইউরোপের অর্থনৈতিক অসুস্থতার আরোগ্য পন্থা হিসেবে কৃচ্ছ্রতা যদিও পছন্দ হারাচ্ছে, গত বছর গ্রিসে নতুন করে আর্থিক সংকট কোমর-আঁটো করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। গ্রিস যদি বাজেট কর্তন ও নতুন করে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সংস্কারের ব্যাপারে দৃঢ় না থাকে তাহলে ইউরোপীয় নেতারা অর্থনৈতিক জোট থেকে তার বহিষ্কারের হুমকি দিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা ঘাটতি হ্রাসের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ব্যর্থতার জন্য ফ্রান্স ও অন্যান্য দেশকে সতর্ক করে দিয়েছেন।
এখন ইউরোপীয় নেতারা নিরাপত্তা ব্যয়কে অগ্রাধিকার বলে স্বীকার করেছেন। নভেম্বরে প্যারিসে আইএসের হামলায় ১৩০ জন নিহত হওয়ার পর ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জাঁ ক্লদ জাংকার নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরদারের জন্য বাজেট ঘাটতি আইনের আওতায় ফ্রান্সের বিশেষ সুবিধা লাভ অনুমোদন করেন।
তিনি বলেন, আমরা মারাত্মক সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সম্মুখীন। অন্য দেশের মত ফ্রান্সের হাতেও অতিরিক্ত ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে।
কৃচ্ছ্রতা বলবৎ হওয়ার পর থেকে ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেন ও প্রতিবেশী দেশগুলো সামরিক ব্যয় বিপুলভাবে হ্রাস করে। ২০০৭ সাল থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক ব্যয় ১৩ শতাংশেরও বেশি হ্রাস পায়। গত বছর ন্যাটোর মাত্র ৪টি ইউরোপীয় সদস্য বাধ্যতা মূলক জিডিপি’র ২ শতাংশ সামরিক ব্যয় করেছে।
কিন্তু নিরাপত্তা উদ্বেগ বৃদ্ধির সাথে সাথে এ রীতি পাল্টে গেছে।
জার্মানি আরো পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিয়োগ করছে এবং প্রতিক্ষামন্ত্রী জানুয়ারিতে ১৪১ বিলিয়ন ডলার সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন। সরকার দেশে উদ্বাস্তু স্রোত ব্যবস্থাপনার জন্য ১২.১ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত অর্থের অংশ ব্যয় করতে পারে। ফ্রান্স তার সামরিক সরঞ্জাম ভা-ার, সৈন্য ও পুলিশের সম্প্রসারণ করছে, পাশাপাশি মুসলিম তরুণদের মধ্যে উগ্রপন্থা মোকাবেলা করতে নজরদারি বৃদ্ধি ও নতুন কর্মসূচি গ্রহণে কোটি কোটি ইউরো ব্যয় করছে।
সিরিয়া থেকে প্রশিক্ষণ লাভের পর বেলজিয়াম থেকে সন্ত্রাসীরা প্যারিস হামলার পরিকল্পনা করে। সেখানে সিরিয়া থেকে ফেরা জিহাদিদের জেলে রাখা, সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার ও রাস্তায় শত শত সৈন্য মোতায়েন বাবদ প্রায় ৫০ কোটি ইউরো ব্যয় হবে। ব্রিটেন সম্প্রতি বোয়িং পি-৮ সমুদ্র টহল বিমান, জঙ্গি বিমান স্কোয়াড্রনের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি ও নতুন স্ট্রাইক ব্রিগেড সৃষ্টির জন্য ১২ বিলিয়ন ডলার অনুমোদন করেছে।
ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী মিশেল সাপিন বলেন, আমরা নতুন হামলার আশংকা বাদ দিচ্ছি না, কেউই তা দিতে পারে না। এখানে বা অন্য কোথাও তা হতে পারে। আমাদের এ অস্থিতিশীলতার মূলের বিরুদ্ধে লড়াই করা প্রয়োজন।
রন্ডনে আই এইচ এস জেনস ডিফেন্স বাজেটের এক বিশ্লেষক ফেনেলা ম্যাকগ্রেটি বলেন, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও জার্মানির অতিরিক্ত সামরিক ব্যয় ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৫০ বিলিয়ন ইউরো থেকে ২১৫ বিলিয়ন ইউরোতে দাঁড়াবে। তা সত্ত্বেও ইউরোপের নিরাপত্তা ব্যয় যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় এখনো কম।
তা সত্ত্বেও এ পরিরবর্তন নিরাপত্তা, সামরিক ও অস্ত্র নির্মাতাদের জন্য প্রচুর মুনাফার সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
কৃচ্ছ্রতার মনোভাবের কারণে ইউরোপের বৃহৎ সামরিক সররবরাহকারীরা দ্রুত একটি ধাক্কার সম্মুখীন হয়। সরকারী সংগ্রহ সংস্থাগুলোর সাথে চুক্তির আলোচনা স্থগিত হয় বা অর্ডারগুলোর পরিমাণ কমে যায়।
এয়ারবাস গ্রুপের মত কিছু কোম্পানি তাদের সামরিক ব্যবসা কমিয়ে দেয়। ২০১৩ সালে তারা সামরিক ও মহাকাশ বিভাগ থেকে ৫ হাজার ৮শ’ চাকুরি ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা করে। সে সাথে তারা বাণিজ্যিক জেট ব্যবসার দিকে মনোযোগ দেয়।
এখন ইউরোপীয় সেনাবাহিনী বাড়ছে। পরিকল্পিত ব্যয় হ্রাসের বদলে ফ্রান্স ২০১৯ সাল নাগাদ সেনাবাহিনীতে ২৩ হাজার লোক নিয়োগের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ফ্রান্স ও ব্রিটেনসহ একটি জোট শীঘ্রই ইরাক ও সিরিয়ায় লড়াই জোরদার করবে যার জন্য ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন, জঙ্গি বিমান ও নজরদারির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যয় হবে।
এয়ারবাস কোম্পানি ইউরোপীয় সামরিক বাহিনীগুলোকে এনএইচ৯০ হেলিকপ্টার , এ৪০০এম কার্গো ও সৈন্য পরিবহন এবংএ৩৩০ বহুমুখী রিফুয়েলিং ট্যাংকারসহ বিভিন্ন ধরনের বিমান সরবরাহ করে থাকে। এয়ারবাসের উচ্চ প্রযুক্তির উপগ্রহ নজরদারি সরঞ্জামসহ সমন্বিত সীমান্ত ও উপকূলীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাও রয়েছে যা উদ্বাস্তু সংকট বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে ইউরোপের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এয়ারবাসের প্রধান নির্বাহী টমাস এন্ডারস সম্প্রতি ইউরোপে অভ্যন্তরীণ সীমান্তে চলাচলকারী সম্ভাব্য জিহাদিদের সন্ধান ও মনিটর করার ক্ষেত্রে কিছু সরকারের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে সাংবাদিকদের বলেন, পররাষ্ট্র নীতি , প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা নীতিতে আমাদের আরো সহযোগিতা ও একীকরণ প্রয়োজন। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অবশ্যই তা হবে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা।
নয়া সরঞ্জামের সাথে বর্ধিত ব্যয়ের বেশির ভাগই যাবে গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা ঘাটতি পূরণে যার সুযোগ নিয়ে আইএস ইউরোপে ভ্রমণ ও হামলার পরিকল্পনা করছে।
প্যারিস হামলার পর ইউরোপের শীর্ষ নিরাপত্তা এজেন্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিকিউরিটাস ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, জাদুঘর ও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাছ থেকে হাজার হাজার প্রহরী ও নিরাপত্তা জোরদারের অনুরোধ পেয়েছে ও পাচ্ছে। ফ্রান্সে সিকিউরিটাসের ১৬ হাজার কর্মী রায়েছে এবং তারা আর ৮শ’ মাত্র সরবরাহ করতে সক্ষম। তারা এ চাহিদা পূরণের জন্য লোক ভাড়া করছে।
ফরাসি মেটাল ডিটেক্টর নির্মাতা ভিসিয়ম-এ অর্ডার ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ ভাবে অর্ডার বেড়েছে স্টেডিয়াম, কনসার্ট হল ও বড় স্টোরগুলোর কাছ থেকে।
ফ্রান্সের অন্যতম বৃহৎ নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান এন টুট সিকিউরিটির পরিচালক প্যাট্রিক হাস বলেন, ফরাসি কোম্পানিগুলো এজেন্টদের জন্য এ বছ ৫০ কোটি ইউরো ব্যয় করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্যদিকে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ও পুলিশ বিভাগ বুলেটপ্রুফ ভেস্ট থেকে ড্রোন পর্যন্ত সব কিছু অর্ডার বাড়াবে।
তিনি বলেন, প্যারিস হামলার পর যা পরিবর্তন হয়েছে তা হল কর্তৃপক্ষ এখন উপলব্ধি করছে যে হুমকি স্থায়ী। আমরা মৌলিক পরিবর্তনের সম্মুখীন। সূত্র নিউইয়র্ক টাইমস।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ইউরোপের নিরাপত্তা ব্যয় বৃদ্ধি করেছে
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ