Inqilab Logo

বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

পুলিশের চেইন অব কমান্ড সঙ্কট!

প্রকাশের সময় : ২০ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৪৩ পিএম, ১৯ জুলাই, ২০১৬

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য গোপন করছে একশ্রেণীর অসাধু পুলিশ সদস্য
তল্লাশি ও জঙ্গি দমনের অভিযানের নামে সাধারণ মানুষকে হয়রানি ও টু-পাইস কামানোর অভিযোগ
ভয়াবহ দুঃসময় অতিক্রম করছে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা


উমর ফারুক আলহাদী : ভয়াবহ দুঃসময় অতিক্রম করছে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জঙ্গি হামলার পর থেকে র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দাদের ঘুম হারাম। পরিস্থিতি সামাল দিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি ও র‌্যাবের ডিজিসহ সকল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দেশের সার্বিক নিরাপত্তা নিয়ে দিনরাত কাজ করছেন। জঙ্গিবিরোধী অভিযান ও তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে গোয়েন্দারাও ব্যাপক তৎপর রয়েছেন। কিন্তু এই কঠিন দুঃসময়ের মধ্যেও মধ্যস্তরের একশ্রেণীর অসাধু ও সুবিধাবাদী পুলিশ সদস্য নিরাপত্তা তল্লাশির নামে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করছে বলে প্রচুর অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থার সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষুণœ হচ্ছে পুলিশের ভাবমর্যাদা। পাশাপাশি এসব অসাধু পুলিশ সদস্যের জন্য পুলিশের চেইন অব কমান্ডে সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেক সৎ ও পরিশ্রমী পুলিশ কর্মকর্তা। অনেক সময় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের না জানিয়ে নিরাপত্তা টহল ও অভিযানের নাম করে যখন তখন রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হানা দিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। তারা বলছেন, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে মিথ্যা তথ্য দিয়ে এবং অনেক সময় সঠিক তথ্য গোপন রেখে বিভিন্ন থানার ওসি, এসআই ও এএসআই পর্যায়ের পুলিশ সদস্য টু-পাইস কামাতে ব্যস্ত। তারা বলছেন, কোনো অপরাধী থাকলে গোয়েন্দা তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের গ্রেফতার করতে পারে। কিন্ত বারবার একই বাসায় গিয়ে ভয়ভীতি সৃষ্টি করলে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। এ অভিযোগ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া বিভিন্ন শিক্ষার্থীর অভিভাবক ও সাধারণ মানুষের।
এদিকে তথ্য সংগ্রহের নামে উত্তরায় বিভিন্ন সেক্টরে বাসাবাড়িতে পুলিশি হানার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই এলাকায় যেসব বাড়িতে বিদেশীরা বসবাস করেন সেসব বাসায় গিয়ে প্রতিদিনই হয়রানি করা হচ্ছে। উত্তরায় বসবাসরত কয়েকজন চাইনিজ নাগরিকের বাসায় গত এক সপ্তাহ ধরে দিনে-রাতে প্রতিদিনই পুলিশ হানা দিচ্ছে বলে বাসার মালিক অভিযোগ করেছেন। উত্তরা, বাড্ডা, খিলক্ষেত এবং বসুন্ধরা এলাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাসার মালিকরা বলছেন, এতে করে বিদেশী নাগরিকেরা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে চলে যেতে পারেন। এমনকি তারা এ দেশে বিনিয়োগ করাও বন্ধ করে দিতে পারেন। এর বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে দেশের অর্থনৈতিক খাতে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বিনা কারণে কাউকে হয়রানি করলে এবং তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, জঙ্গি দমন অভিযানের নামে বিনা কারণে কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না। এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, জঙ্গি দমন অভিযানে সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। র‌্যাব-পুলিশের পাশাপাশি জনগণকেও এ ব্যাপারে সতর্কতার সাথে সহযোগিতা করতে হবে।
তিনি বলেন, পুলিশের চেইন অব কমান্ডে কোনো ধরনের সংকট নেই। এ ধরনের অভিযোগ আমার কাছে নেই। দুটি ঘটনা ঘটেছে, আমরা তা অত্যন্ত সফলতার সাথে মোকাবিলা করেছি এবং জঙ্গিদমনে আমরা অনেকটা সফল।
মিরপুর থানা এলাকার একজন ব্যবসায়ী গতকাল অভিযোগ করেছেন, সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে ৯টার দিকে মিরপুর সনি সিনেমা হলের সামনে থেকে তার কলেজপড়–য়া ১৯ বছরের ছেলে তানভীর ও তার বন্ধু মামুনকে পুলিশের টহল দল আটক করে। পরে খবর পেয়ে ওই ব্যবসায়ী ঘটনাস্থলে যান এবং পুলিশকে ১০ হাজার টাকা দেয়ার পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। ওই ব্যবসায়ী আরো জানান, বিনা কারণে তাদের আটক করা হয়। ফলে এলাকার সরকারদলীয় দুইজন নেতা থানায় যোগাযোগ করলে থানার ওসি এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানান।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে, পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (মিডিয়া) এ কে এম শহীদুর রহমান গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, সারা দেশে প্রায় ১ লাখ ৫৯ হাজার পুলিশ সদস্য দেশের ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছেন। তারা জঙ্গি দমন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন। ডিআইজি শহীদুর রহমান আরো বলেন, এত বড় বাহিনীর মধ্যে কিছু খারাপ লোক থাকতেই পারে। তবে কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে আইন অনুয়ায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, সকল পুলিশ সদস্যকে নির্দেশনা দেয়া আছে, যাতে কোনো নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি করা না হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশের চেইন অব কমান্ডের সংকট সৃষ্টি হয়েছে, এ অভিযোগ সঠিক নয়। কেউ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশ না মানলে এবং এ ধরনের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে, কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে অভিযোগ পাওয়া গেছে, রাস্তাঘাটে রাতের বেলায় ভয়ে দৌড়ে পালানো অনেকেই পুলিশের হাতে গ্রেফতার এবং গুলিতে আহত হয়েছেন। এছাড়া নিরাপত্তা তল্লাশির নামে সাধারণ মানুষকে হেনস্তার অভিযোগ উঠছে একের পর এক। গ্রেফতার ও পেন্ডিং মামলায় ঢুকিয়ে দেয়ার নামে অর্থ নেয়ার অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে রাজধানীসহ বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে মেস ও বাসাবাড়িতে বসবাসকারীরা আতঙ্কে রয়েছেন। কারণ প্রতিদিনই সেখানে পুলিশ হানা দিচ্ছে। জঙ্গি দমনের নামে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
গত ১২ জুলাই রাতে মিরপুর-২ নম্বর সেকশনের একটি মেস থেকে কয়েকজন ছাত্রকে আটক করে মিরপুর থানা পুলিশ। পরে অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে তাদের ছেড়ে দেয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
সোমবার দুপুরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফেরার পথে আরিফ হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে পুলিশ আটক করে। ওই ব্যক্তির ভাই জানালেন, তার ভাই কোন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। থানায় কোনো মামলা নেই। তাকে কেন আটক করা হলো? আটক হওয়ার পর থেকে তার দোকানটি বন্ধ আছে। ওই দোকানের আয় দিয়েই তাদের সংসার চলত।
তোহুর আলী নামে এক ব্যক্তি জানান, তার ছোট ছেলের নাম আবদুল আজিজ। তাদের গ্রামের বাড়ি ঢাকার ধামরাই থানার কেলিয়া এলাকায়। গত ৩ মাস আগে পাশের গ্রামের রহমত আলী নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তার জমি নিয়ে বিরোধ হয়। এ নিয়ে মামলাও হয়। উভয় পক্ষের আদালতে চলছে মামলা। কিন্তু, রহমত তার ছেলেকে যুবদলের কর্মী সাজিয়ে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়। তার কোনো অপরাধ নেই। সে রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত নয়।
আলমগীর হোসেন নামে এক ব্যক্তি জানান, গত বুধবার রাতে শ্যামলী এলাকা থেকে ডিবি পরিচয় দিয়ে তার ভাই সেরাজুলকে একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে সংশ্লিষ্ট থানায় যোগাযোগ করেন তারা। কিন্তু, থানা পুলিশ তাকে আটক করেনি বলে তার স্বজনদের জানিয়েছে। এতে পরিবারের লোকজন উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েন।
ঢাকার মিরপুর পল্লবীর বাসিন্দা সাকিব নামে এক বেসরকারি চাকরিজীবী জানান, অফিস শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১০টা বেজে যায়। বাসায় ফেরার পথে আতঙ্কে থাকি। কারণ মোড়ে মোড়ে পুলিশ তল্লাশির নামে হয়রানি করে। এভাবে তো শান্তিতে থাকা যায় না।
ষাটোর্ধ্ব তৌহিদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি জানান, গত রোববার রাতে উত্তরার আবদুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে তার ছেলে হাসানকে ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়ে একদল ব্যক্তি তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তার কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। সংশ্লিষ্ট থানা ও ডিবি পুলিশের অফিসে গিয়ে খোঁজ নিলে ডিবির তাকে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করেন। হাসান বেসরকারি পিপলস ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। তৌহিদুল ইসলাম ছেলের সন্ধানে বিভিন্ন সংস্থার কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, পুলিশ আইনের মধ্যে থেকে সন্দেহভাজন লোকজনকে তল্লাশি করছে। তল্লাশির সময় সাধারণ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হয় এ বিষয়ে কড়া নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। আর গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ রকম সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

Show all comments
  • তারেক মাহমুদ ২০ জুলাই, ২০১৬, ১:১৯ পিএম says : 2
    অসাধু পুলিশ সদস্যদের কারণেই আজকে দেশের এই অবস্থা
    Total Reply(0) Reply
  • লোকমান ২০ জুলাই, ২০১৬, ১:২০ পিএম says : 0
    তল্লাশি ও জঙ্গি দমনের নামে সাধারণ মানুষকে হয়রানি ও টু-পাইস কামানো বন্ধ করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • শুভ্র ২০ জুলাই, ২০১৬, ১:২৫ পিএম says : 0
    কিছু অসাধু সদস্যদের কারণে পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থার সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষুন্ন হচ্ছে পুলিশের ভাবমর্যাদা। এ ব্যাপারে পুলিশকে সজাগ থাকতে হবে
    Total Reply(0) Reply
  • romez raza ২০ জুলাই, ২০১৬, ৬:৫২ পিএম says : 0
    আল্লাহতালাই ভাল-জানেন দেশে হচ্ছে টা কি,তিনি যেন আমাদেরকে এই অবস্তা থেকে মুক্তি দেন আমিন....
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পুলিশের চেইন অব কমান্ড সঙ্কট!
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ