ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
আফতাব চৌধুরী
শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ। এই আপ্তবাক্যটি দেশ স্বাধীনতা লাভের পর বিভিন্ন নেতা, উপনেতা, পাতিনেতার মুখে বার বার উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু এই দেশের ভবিষ্যৎ শিশুদের নিয়ে কতটুকু ভাবনা চিন্তা হয়েছে এ প্রশ্ন এসে যাচ্ছে যখন কোনও এক সংবাদের শিরোনাম দেখছি শিশুর মৃত্যুর হার রোধ করতে ব্যর্থ সরকার। ওই সংবাদে ইউনেস্কোর সদ্য প্রকাশিত এক সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা সর্বজনীনকরণের পথে সবচেয়ে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে শিশুদের পুষ্টিহীনতা। এ দেশে পাঁচ বছরের অনূর্ধ্ব এক-তৃতীয়াংশ শিশুই ভুগছে পুষ্টিহীনতায়। আর এই অপুষ্টির শিকার হয়ে বছরে লক্ষ লক্ষ শিশুর জীবনের কলি ফুল হয়ে ফোটার আগেই ঝরে পড়ছে। ইউনেস্কোর ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশে অর্থনৈতিক বিকাশের হার এখন উন্নত কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় শিশু মৃত্যুর হার ও পুষ্টিহীনতার ক্ষেত্রে ভারত এবং নেপালেরও পেছনে পড়ে আছে এই দেশ। বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৯৯ শতাংশ শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করা সম্ভব হবে। কিন্তু শিশুদের পুষ্টিহীনতা দূর করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ যেভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে এগোচ্ছে তার পরিণতি শোচনীয় হতেই পারে।
আর তাই যদি হয় তবে দেশের ৯৯ শতাংশ শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করা সম্ভব হলেও অপুষ্টির শিকার এই কঙ্কালসার ছানাপোনারা কি দীর্ঘকাল বিদ্যালয় আলো করে বসে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে? তাই ওই সমীক্ষাতেই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে-উদ্ভূত এ ধরনের পরিস্থিতিতে কোটি কোটি শিশু প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। আর একই সময়ে পাকিস্তানে মাত্র ৩.৭ মিলিয়ন শিশুর প্রাথমিক শিক্ষালাভের পথ এই অপুষ্টিগত কারণে রুদ্ধ হবে।
কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতির ছোঁয়া বাংলাদেশেও এসে পৌঁছার পরও আমাদের সরকার তার সুযোগ নিয়ে শিশুদের এই ব্যাপক পুষ্টিহীনতা রোধ করতে পারছে না কেন? ইউরোপ, আমেরিকা, এমনকী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও আজ শিশুদের সুস্বাস্থ্য উজ্জ্বল চেহারা দেখে আমরা মুগ্ধ হচ্ছি। বলা বাহুল্য, চিকিৎসা বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক আবিষ্কারের সুযোগ-সুবিধাকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়েই শিশুদের অপুষ্টি দূর করে ঝলমল স্বাস্থ্যজ্জ্বল করে তোলা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত মন্ত্রণালয় শিশুদের স্বাস্থ্য নিয়ে যে মোটেই মাথা ঘামায়নি, স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও দেশের শিশুমৃত্যুর এই ভয়ঙ্কর হার তাই প্রমাণ করছে।
আমাদের দেশে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে শিশুদের অপুষ্টির এবং শিশুমৃত্যুর হার হতাশাব্যঞ্জক। ইউনিসেফ এ দেশের শিশুদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কর্মসূচিতে ব্যাপকভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া সত্ত্বেও শিশুমৃত্যুর হার উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। ২০০৭ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে জীবিত জন্মগ্রহণ করা ১০০০ শিশুর মধ্যে ৬৬টি শিশুই অকালে মারা যায়। ২০১৫ সালেও এই হার কমা তো দূরে থাকুক, বিশেষজ্ঞদের ধারণা-বেড়েছে। ভবিষ্যতের উজ্জ্বল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে আজকের এই অপুষ্টির ভোগা কঙ্কালসার শিশুদের স্বাস্থ্যে ঝলমল করার উদ্যোগে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিতে হবে। ইউনেস্কো সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই আরও অধিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। শিশুমৃত্যুর হার কমাবার লক্ষ্যে জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য অভিযানকে সহায়তা দিচ্ছে তারা। তাদের এই কর্মসূচিতে রয়েছে দেশের ক’টি বড় বড় হাসপাতালে সবজাত শিশুদের সেবাযতেœর জন্য বিশেষ ইউনিট স্থাপন। এর আগে দেশের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতে ইউনেস্কোর সহায়তায় এই বিশেষ নিউবর্ন চাইল্ড হেলথ কেয়ার ইউনিটগুলো কাজ করছিল। সেগুলোও চালু থাকবে।
ইউনেস্কোর সহায়তায় এই যে নবজাত শিশুদের জন্য বিশেষ কেয়ার ইউনিটের কাজ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতে এতদিন চলেছে-সে খবর দেশের অধিকাংশ মানুষই জানেন না। কারণ এ ব্যাপারে গণসচেতনতা গড়ে তোলার জন্য সরকারের যে বিশাল কর্মযজ্ঞের প্রয়োজন ছিল, তা করা হয়নি। ফলে হাসপাতালগুলোতে নবজাতকরা সেসব সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এখন দেশের আরও ক’টি বড় হাসপাতালে এই কার্যসূচি সম্প্রসারিত করা হচ্ছে। এখনও যদি সরকার এ ব্যাপারে গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষভাবে সচেষ্ট না হয় তবে দেশে শিশুদের অকাল মৃত্যুর হার আরও বাড়বে বই কমবে না।
পাশাপাশি এই বিশেষ নবজাতকদের স্বাস্থ্য ও যতœ সম্পর্কিত কর্মসূচি বাবদ যে শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ হয়, এ নিয়েও দুর্নীতি চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যে দেশে শিশুদের দুপুরের আহারের বরাদ্দ চালও কালোবাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়, সে দেশে হাসপাতালে শিশুদের যতেœর টাকা নিয়েও ব্যাপক নয়ছয় তো আরও সহজ-সরল ব্যাপার। এসব দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারকে কঠোর ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে অভিযুক্ত অফিসার ও কর্মীদের ব্যাপকহারে ছাঁটাই করেও সরকারকে অন্তত শিশুদের স্বাস্থ্যোজ্জ্বল হয়ে গড়ে ওঠার পথকে কণ্টকহীন করতেই হবে। অন্যথায় অপুষ্টিতে ভোগা কঙ্কালসার আজকের শিশুরাই যদি আগামীতে প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক হয়ে দেশের হাল ধরে তবে দেশ যে রসাতলে পৌঁছাবে-তা ভাবতেই আজ গায়ে কাঁটা দেয়।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।