Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আড়ালেই রিজার্ভ চুরির হোতারা

প্রকাশের সময় : ১৮ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এ সপ্তাহে প্রকাশ হচ্ছে প্রতিবেদন
সাইবার চোর ‘নিলাভান্নানের’ বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশ নিয়ে প্রশ্ন
হাসান সোহেল : বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন এ সপ্তাহেই প্রকাশ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত রিপোর্ট প্রকাশের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রতিবেদনে রিজার্ভ চুরিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের ৬ কর্মকর্তার দায়িত্বহীনতা, জেনে না জেনে অপরাধীদের সহায়তা এবং অসাবধানতাবশত নিজেদের পাসওয়ার্ডের গোপন তথ্য সাইবার অপরাধীদের হাতে তুলে দেয়ায় শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া বিদেশী এক সাইবার অপরাধী জড়িত থাকার বিষয় উঠে এসেছে, যে সুইফটের মূল্যবান পাসওয়ার্ড হ্যাক করেন। যদিও ওই সাইবার অপরাধী বাংলাদেশ ব্যাংকে কার মাধ্যমে প্রবেশে করে তা উঠে আসেনি বলে জানা গেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তারা ফেঁসে যেতে পারেন বলে সূত্র জানিয়েছে। আর তাই এ বিষয়টি আড়ালেই থাকছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বিদেশী সাইবার অপরাধী হিসেবে উঠে আসা সুইফটের প্রতিনিধির নাম ‘নিলাভান্নান’। প্রতিবেদনে যাকে ‘ভুয়া’ বললেও সে সময়ে ওই ব্যক্তি কার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে এসেছিলেন সে বিষয়ে কোনো ক্লু বের করতে পারেনি তদন্ত কমিটি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ‘নিলাভান্নান’ কিভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকে আসেন, কার সাথে যোগাযোগ করে এসেছেন তা খতিয়ে দেখা উচিত। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের অতি গুরুত্বপূর্ণ ‘অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টে’ তার প্রবেশের ক্ষেত্রে তখন সবকিছু কেন যাচাই-বাছাই করা হয়নি। আর কেনই বা এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা, গাফিলতিÑএ রকম শব্দ দিয়ে দায় চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। তারা প্রশ্ন রাখেন বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশে যে কর্মকর্তাদের সাথে ‘নিলাভান্নান’ যোগাযোগ করেছিল তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক। কর্মকর্তারা জানান, কার নির্দেশে নিলাভান্নান বাংলাদেশ ব্যাংকে আসেন, এগুলো উঠে এলেই রিজার্ভ চুরির আসল তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে মনে করেন তারা।
এদিকে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, সুইফটের ‘ভুয়া’ প্রতিনিধি সেজে বাংলাদেশে এসেছিলেন ‘নিলাভান্নান’ নামের একজন ব্যক্তি। গতবছর নভেম্বরে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে আসেন। ওই সময় তার হাতে চলে যায় সুইফটের মূল্যবান পাসওয়ার্ড। আর তাই রিজার্ভ চুরির ঘটনায় নিলাভান্নানকে প্রধানতম অপরাধী বলে চিহ্নিত করেছে ফরাস উদ্দিনের তদন্ত কমিটি।
প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ফেডারেল রিজার্ভ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৮শ› কোটি টাকা চুরি হয়েছে মাত্র ৫ ঘণ্টায়। গেল ৪ঠা ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টা থেকে রাত ৩টা, মাত্র ৫ ঘণ্টার মধ্যে চুরি হয় রিজার্ভের ৮০০ কোটি টাকা। আর এই চুরিতে হ্যাকারদের পর্যবেক্ষণ ছিল দীর্ঘদিনের। কম্পিউটারের নানা তথ্য পর্যালোচনায় জানা গেছে জানুয়ারি থেকে শুরু করে চুরির দিন পর্যন্ত অনলাইনে অর্থ লেনেদনের প্রতিষ্ঠান সুইফটের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটারে পাঠানো হয় বিভিন্ন ধরণের সিগন্যাল। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা হয় এসব সিগন্যাল বোঝেননি, না হয় গোপন করেছেন। এসব তথ্য দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে তাদের শাস্তির। ৪ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কম্পিউটার লগ শিটের তথ্য চাওয়া হলেও, সুইফট তা দেয়নি বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
এছাড়া তদন্ত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির খবর উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে গোপন করার বিষয়টিকে গর্হিত অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে কমিটি। এজন্য তৎকালীন গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদেরকে দায়ী করা হয়েছে। যদিও এর দায়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন ওই সময়ে দায়িত্বে থাকা গভর্নর ড. আতিউর রহমান। একই সঙ্গে দুই ডেপুটি গভর্নর আবুল কাশেম ও নাজনীন সুলতানাকে অব্যহতি দেয়া হয়। যদিও আরেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর এখনো স্বপদে বহাল রয়েছেন।
এদিকে রিজার্ভ চুরির পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে সব কর্মকর্তাদের অবহেলা বা দায়িত্বহীনতার কথা বলা হচ্ছে এখনো তাদেরকে দিয়েই একই বিভাগে কাজ করানো হচ্ছে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সামনে হাজির হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এসব কর্মকর্তাদের দিয়ে কাজ করানোয় আরও বড় ঝুঁকিতে পড়তে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
গত ৩০ মে অর্থমন্ত্রীর কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর তদন্ত কমিটির প্রধান ফরাসউদ্দিন বলেছিলেন, রিজার্ভ চুরিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কারও সম্পৃক্ততা নেই বলে আগে তারা ধারণা করলেও চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ওই অবস্থান থেকে তারা ‘সামান্য’ সরে এসেছেন। তিনি আরও বলেন, সুইফটেরও দায় দায়িত্ব আছে, সম্পূর্ণ দায় বা মূল দায় তাদের কি না- সেই বিশ্লেষণও প্রতিবেদনে আছে। সুফইট কখনও দায় এড়াতে পারে না। তবে সুইফটের সাহায্য নিয়েই আমাদের ভবিষ্যতের সমস্যা সমাধান করতে হবে। চুরি যাওয়া টাকা আদায়ের বিষয়েও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফরাসউদ্দিন।
রিজার্ভ চুরি ঘটনার তদন্তে সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গত ১৫ মার্চ ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্ব ৩ সদস্যের ওই কমিটি প্রথমে একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন জমা দেয় গত ২০ এপ্রিল। পরে সেটি চূড়ান্ত হওয়ার আগে নিয়োগ দেয়া হয় আরও ৩ জন আইটি বিশেষজ্ঞকে। যাদের উদ্ঘাটিত তথ্যেই বেরিয়ে আসে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্পৃক্ততার তথ্য। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেনÑবুয়েটের কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর মোহাম্মদ কায়কোবাদ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব গকুল চাঁদ দাস।
উল্লেখ্য, গত ৪ ফেব্রুয়ারি সুইফট মেসেজিং সিস্টেমের মাধ্যমে ৩৫টি ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিলিয়ন ডলার সরিয়ে ফেলার চেষ্টা হয়। এর মধ্যে পাঁচটি বার্তায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গোপন সুইফট কোড ব্যবহার করে ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তুলে নেয় দুর্বৃত্তরা। ওই চুরির ঘটনার প্রায় এক মাস পর ফিলিপাইনের একটি পত্রিকার মাধ্যমে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সাইবার চুরির এই ঘটনা জানতে পারে বাংলাদেশের মানুষ। এরপর রিজার্ভ চুরির ঘটনায় মামলা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিষয়টি চেপে রাখায় সমালোচনার মুখে গভর্নরের পদ ছাড়তে বাধ্য হন আতিউর রহমান। একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে বড় ধরনের রদবদল হয়। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আড়ালেই রিজার্ভ চুরির হোতারা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ