Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আইন-আদালত কি তাদের কাছে তুচ্ছ বিষয়-আশয়!

প্রকাশের সময় : ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল : সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে চিকিৎসকরা তাদের কর্মবিরতি এক সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেছেন। প্রকাশিত সংবাদে একথাও বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের সিটি মেয়রের সাথে বিএমএ’র নেতাদের ফলপ্রসূ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসকরা লাগাতার কর্মসূচি থেকে ফিরে আসেন। তাদের বক্তব্যমতে সম্মানজনক সমাধানের আশ্বাসে ডাক্তাররা তাদের কর্মসূচি স্থগিত করেছেন। অবশেষে ডাক্তাররা প্রাইভেট প্র্যাকটিসে ও বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে ফিরে যাওয়ায় এতদিনের অচলাবস্থার অবসান ঘটেছে। এক সংবাদ ভাষ্যে বলা হয়, গত ৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন এক প্রসূতি মাতা। সিজারের মাধ্যমে সস্তান প্রসবের পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। চিকিৎসকের অবহেলায় এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করেন মৃতের পরিবারের লোকজন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের আসামি করে ২টি মামলা দায়ের করা হয়। তারমধ্যে আবার একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে রোগীর পেটে ব্যান্ডেজ রেখে দেয়ার। এই মামলা দায়েরের পর চিকিৎসকরা রোগীদের জিম্মি করে অমানবিক কর্মবিরতি পালন করতে থাকেন। এখন প্রশ্ন হলো, এ দেশের ডাক্তাররা কি আইনের ঊর্ধ্বে? আইন আদালত কি তাদের কাছে তুচ্ছ বিষয়। একজন ডাক্তার যদি পেশাগত ব্যাপারে অবহেলা দেখান এবং তাতে যদি কোন মানুষ মারা যায় কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে কি ক্ষতিগ্রস্তপক্ষ সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন না? আমরা জানি আমরা কোন মগের রাজ্যে বসবাস করি না। আমরা একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে বসবাস করি। সেখানে আইনের আশ্রয় নেয়ার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে এবং রাষ্ট্রই তাকে সেই অধিকার দিয়েছে। বলা হচ্ছে আইনজীবী কিংবা পুলিশ ডাক্তারের অবহেলা বুঝবে কি করে। গালে মশা বসলে কাউকে যেমন বলে দিতে হয় না হাত দিয়ে মশা তাড়াতে হয় কিংবা মারতে হয়, তেমনি করে কোন অপারেশনের রোগীর পেটের ভিতর ব্যান্ডেজ রেখে সেলাই করে রোগীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার জন্য যে ডাক্তারের অবহেলাই দায়ী, তাহার জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হতে হয় না। মানুষ সহজে বুঝে নেয় এটা ডাক্তারের অবহেলাজনিত কর্মকা-। হঠাৎ করে রোগীদের জিম্মি করে ডাক্তারদের এমন কর্ম বিরতিতে যাওয়া মানবিক মনোবৃত্তি সম্পন্ন কাজ কিনা, একজন হৃদয়বান ডাক্তারই তা ভালো বলতে পারবেন। ডাক্তারি পেশা মহান পেশা। ছোট বেলা থেকেই জানতাম ডাক্তারদের মানুষ দেবতার মতো সম্মান করে। একশ্রেণীর ডাক্তারের কর্মকা-ের জন্য ডাক্তারদের সেই সম্মানের জায়গাটা এখনো আগের সেই শক্ত অবস্থানে আছে কিনা, তা ডাক্তাররাই ভালো বলতে পারবেন। এখানে আরেকটি কথা বলা যায়, এক শ্রেণীর ডাক্তারে অনৈতিক কর্মকা-ের জন্য ভুক্তভোগী মানুষ যদি বলে যে ডাক্তাররাই এখন অনৈতিক ক্ষমতার চর্চা কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকেন, তাহলে কি মানুষকে দোষ দেয়া যাবে। বলা হচ্ছে, ডাক্তারদের অবহেলা আইনজীবী কিংবা পুলিশ ধরতে পারবে না। কথাটা নিশ্চয়ই পুরোপুরি সত্য নয়। আমরা অসহায় দেশবাসী এ কথাকে সম্পূর্ণ সত্য বলে ধরে নিতে পারি না। যেকোন ব্যাপারে অবহেলার চালচিত্র চোখের সামনে ফুটে উঠলে মানুষ ঠিকই তা ধরতে পারে। আবার এমন কথাও বলা হচ্ছে একজন বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের চিকিৎসক দিয়ে তদন্ত করিয়ে যদি চিকিৎসায় ভুল প্রমাণিত হয়, তখন আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে তাদের অর্থাৎ ডাক্তারদের আপত্তি থাকবে না। এখন প্রশ্ন হলো মানুষ যদি মনে করে প্রসূতির মৃত্যুর ব্যাপারে একজন ডাক্তার আরেকজন ডাক্তারের ভুল এবং অবহেলার চিত্র পেয়েও সত্য কথা চেপে যেতে পারেন, তাহলে কি মানুষের সেই মনে করাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখা যাবে। আবার এমন কথাও বলা যায় একজন ডাক্তার যে আরেকজন ডাক্তারের অবহেলা পেয়েও সত্য রিপোর্ট দেবেন তার গ্যারান্টি কে দেবে? আমরা একশ্রেণীর ডাক্তার বিরুদ্ধে এমন সব অভিযোগ পত্রপত্রিকায় দেখে থাকি, যা বলতেও লজ্জাবোধ হয়। এখানে আরেকটি কথা জানতে ইচ্ছা করে, আর তা হলো, সম্মানজনক সমাধান বলতে এখানে কি বুঝানো হচ্ছে। আমরা জ্ঞান বুদ্ধিহীন মানুষ এটাই মনে করে থাকি যে, সম্মানজনক সমাধান বলতে এখানে এটাই বুঝানো হচ্ছে যে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের যদি অবহেলা থেকেও থাকে তারপরও মৃতের পরিবারের লোকজনদের মামলা তুলে নিতে হবে। কি চমৎকার কথা!
নিকট অতীতে সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছিল যে, পিরোজপুরে এক প্রসূতির পেট থেকে দ্বিতীয় বার অপারেশন করে বের করা হয়েছে ডাক্তারের মব, গজ ও ব্যান্ডেজ। সংবাদে বলা হয় যে, শিউলি সাহা নামের এই প্রসূতিকে ডেলিভারী করার জন্য পিরোজপুর সার্জি কেয়ার ক্লিনিকে ভর্তি করে সিজার করা হয়। সিজারের মাধ্যমে শিউলি সাহা এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। সিজার করার পর থেকে রোগীর পেটে অর্থাৎ শিউলি সাহার পেটে ব্যথা, পেট ফাঁফা, বমি চলতে থাকায় দু’দিন পর তাকে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ খুলনা পাঠায়। অবস্থার মারাত্মক অবনতি হলে খুলনা সার্জিক্যাল অ্যান্ড মেডিকেল হাসপাতালে শিউলি সাহাকে ভর্তি করা হয়। ওই ক্লিনিকের ডাক্তার আল্ট্রাসনো করে দেখেন রোগীর পেটের মধ্যে রক্ত মাখা মব, গজ, ব্যান্ডেজ ও পুঁজ রয়েছে। শেষে শিউলি সাহাকে দ্বিতীয়বার অপারেশন করে তার পেট থেকে রক্তমাখা মব, গজ, ব্যান্ডেজ ও এক লিটার পুঁজ বের করা হয়। দ্বিতীয়বার অপারেশনের ফলে রোগীর অবস্থার আরও অবনতি হলে রোগীকে ওই হাসপাতালে লাইফ সাপোর্ট আইসিইউতে রাখা হয়। ঊনিশ দিন ওই ক্লিনিকে রেখে রোগীকে চিকিৎসা করা হয় প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ করে। এ ব্যাপারে পিরোজপুরের সার্জি কেয়ার ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ যেমন রোগীকে পরবর্তীতে কোন সহযোগিতা করেননি তেমনি করে পিরোজপুর বিএমএ ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের নেতারাও এ বিষয়ে কোন দায়িত্ব নেননি। শিউলি সাহা তখনও শঙ্কামুক্ত ছিলেন না। উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজনে তারপক্ষে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করাও সম্ভব নয়। ডাক্তারের ভুলের কারণে একটা রোগীর মরণাপন্ন অবস্থা হবে তা কোন মতেই মেনে নেয়া যায় না। এমন অভিযোগ অনেক আছে। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তারের অবহেলায় এক প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা বিক্ষুব্ধ হয়ে হাসপাতাল ভাঙচুর করে। তাই বলছিলাম আমাদের সর্বত্র নৈরাজ্যবাদীরা রয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যার উল্লেখিত ঘটনাবলি থেকে।
এখন কথা হল আমরা কোন পথে যাব তা দায়িত্বশীল নেতাদেরকেই নির্ধারণ করতে হবে। নেতারা যদি শুভ পথ নির্ধারণ করতে না পারেন দেখা যাবে, এক শ্রেণীর ডাক্তার নিজেদের অপরাধ কিংবা অবহেলা ঢাকার জন্য রোগীদের জিম্মি করে অনৈতিক কর্মবিরতিতে চলে যাচ্ছেন। যা শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ ডাক্তারি পেশায় রত ব্যক্তিদের কাছ থেকে আশা করে না।
লেখক : কবি, গল্পকার ও আইনজীবী।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আইন-আদালত কি তাদের কাছে তুচ্ছ বিষয়-আশয়!
আরও পড়ুন