Inqilab Logo

রোববার, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

নগর পরিবহনে বিশৃঙ্খলা

প্রকাশের সময় : ১৭ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা ঢাকার নগর পরিবহনে। বিরতিহীন ও সিটিং সার্ভিসের নামে প্রতারণা, লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা বাস, ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত আসন, নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা না থাকাসহ ভাড়ার অনিয়ম তো আছেই। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে দেশের সব সেক্টরে উন্নতি হলেও নগর পরিবহনের ক্ষেত্রে উন্নতি স্বপ্নই থেকে গেছে। যাত্রীদের অভিযোগ শোনার মতো যেন কেউ নেই। খোদ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মাঝেমধ্যেই নিজের চোখে গণপরিবহনের অবস্থা দেখতে রাস্তায় নামেন। মন্ত্রীকে অনুসরণ করে এক দিনের জন্য রাস্তায় নেমে কেউই নজির সৃষ্টি করতে পারেননি। ভুক্তভোগীদের মতে, দায় যেন সব মন্ত্রীর, আর কারো নয়। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, যাত্রীদের সমস্যাগুলো দেখার দায়িত্ব নগর বা মেট্রো আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির (আরটিসি)। কিন্তু সেই কমিটি দখল করে রেখেছেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিক কমিটির নেতারা, যে কারণে যুগ যুগ ধরে যাত্রীরা ভোগান্তি পোহালেও এ নিয়ে কথা বলার কেউ নেই।
নগরীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের যাত্রীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ বাসই আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না। কমিটি দুই মাসে কমপক্ষে একটি সভা করার নিয়ম থাকলেও মালিক শ্রমিকের অনিচ্ছায় ৬ মাসেও কমিটি সভা হয় না। এতে করে সমস্যা দিন দিন বাড়লেও সমাধানের কোনো পথ খোঁজা হয় না। এতে করে যাত্রীদের স্বার্থ থাকে অবহেলিত। জানা গেছে, নগরীতে চলাচলকারী বাসগুলোতে ৩৭টি আসনের অনুমোদন দেয়া হয়। এর বেশি আসন থাকলে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়ার নিয়ম নেই। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী নিজে বহুবার বেশি আসনের বাস ধরেছেন। বিআরটিএ কে সতর্ক করেছেন। কিন্তু তারপরেও নগরীতে চলাচলকারী ৯৮ ভাগ বাসই ৪১ আসনের। পরিবহন মালিকরা জানান, মাঝে মধ্যে বিআরটিএ এ বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করে নিজেদের স্বার্থে। কড়াকড়ি করে ঘুষের পরিমাণ বাড়ায়। কিন্তু ৪১ আসনের বাসে ফিটনেস বন্ধ হয় না। ৩৭ এর স্থলে ৪১ আসনবিশিষ্ট বাসে যাত্রীরা আরাম করে বসতে পারেনা। কখনও কখনও সামনের আসনের সাথে পা লেগে যায়। তখন বাঁকা হয়ে বসতে হয়। অতিরিক্ত আসনের কারণে বেশিরভাগ বাসে উঠতে এবং নামতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয় যাত্রীদের। এছাড়া মহিলা যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত আসন রাখা বাধ্যতামূলক হলেও অধিকাংশ বাসেই তা নেই। এতে করে নারী যাত্রীদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বিশেষ করে স্কুল কলেজের ছাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক চৌধুরীর মতে, নগরীতে চলাচলকারী বেশিরভাগ বাসের ছাদ ফুটো। বৃষ্টি এলে যাত্রীদের মাথায় পানি পড়ে। জানালায় গ্লাস নেই। এ কারণে বৃষ্টি থেকে রেহাই মেলে না।
আলাপকালে যাত্রীরা জানান, নগরীতে শুধু বাসে চলাচল করার মতো নিশ্চয়তা কখনও থাকে না। সরকারি ছুটি ছাড়া অধিকাংশ কার্যদিবসে পিক আওয়ারে সময়মতো বাস পাওয়া যায় না। এটা নিত্যদিনের সমস্যা। অফিস ধরতে গিয়ে তখন বাধ্য হয়ে অটোরিকশা বা রিকমা ভাড়া করা ছাড়া উপায় থাকে না। এর কারণ রুটভিত্তিক গাড়ির সংখ্যা বিন্যাস ঠিক নেই। যে রুটে বেশি বাস দরকার সেই রুটে বাস কম। আবার যে রুটে যানজট কম বা লাভ বেশি সেই রুটে যাত্রীর তুলনায় বাস অনেক বেশি। পরিবহন মালিকদের অভিযোগ, তারা ইচ্ছা করলেই রুটভিত্তিক বাস নামাতে বা বাড়াতে পারেন না। এতে প্রধান বাধা মালিক সমিতি। মালিক সমিতির অনুমোদন ছাড়া কোনো রুটেই বাস নামানো যায় না। কয়েকজন মালিক অভিযোগ করে বলেন, মালিক সমিতির নেতারা লাভজনক রুটগুলো দখল করে আছেন। সে কারণে তাদের লোকসান গুনতে হয় না।
এসবের বাইরে ভাড়া নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি লেগেই আছে। চলতি বছর বাস ভাড়া পুনর্নির্ধারণ হওয়ার পর প্রথম দিকে ভাড়া নিয়ে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এখন তা না থাকলেও শুভঙ্করের ফাঁকি আছেই। অর্থাৎ বিরতিহীন, সিটিং সার্ভিসের নামে যাত্রীদের সাথে প্রতারণা চলছেই। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, বিগত ২৬ বছরে ৩ দফা জ্বালানী তেলের দাম কমার পর দেশের পরিবহন সেক্টরে ভাড়া কাগজে-কলমে কমানো হলেও বাস্তবে কমেনি। ২০০৮ সালের ২৫ অক্টোবর ৫৫ টাকার ডিজেল ৭ টাকা কমে ৪৮ টাকা হলে পরিবহন ভাড়া যাত্রী প্রতি কিলোমিটারে ০৭ পয়সা কমানো হয়। ২০০৯ সালের ১২ জানুয়ারী ৪৮ টাকার ডিজেলের মূল্য কমে ৪৪ টাকা নির্ধারণ করায় যাত্রী প্রতি বাস ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ০৪ পয়সা কমানো হয়। এরপর পরিবহন মালিকদের দাবির প্রেক্ষিতে পরিবহন সেক্টর শিল্প খাত ঘোষণা ও জ্বালানির মূল্য ৪৪ টাকা থেকে কমে ৪০ টাকা হলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাস ভাড়া যাত্রীপ্রতি কিলোমিটারে ০৫ পয়সা কমানোর ঘোষণা দেয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে কাগজে কলমে ভাড়া কমানো হলেও প্রকৃতপক্ষে কোন বাস-মিনিবাস ভাড়া কমেনি। সরকার জনস্বার্থে জ্বালানীর মূল্য কমালেও গুটি কয়েক পরিবহন মালিক এই সুবিধা ভোগ করছে। দেশের যাত্রী সাধারণসহ আপামর জনগণ এর সুফল থেকে বার বার বঞ্চিত হয়েছে। যাত্রীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবর থেকে মেট্রোতে বাস ভাড়া বাড়ানো হয়। বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৭০ পয়সা করা হয়। মিনি বাসের ভাড়াও ১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৬০ পয়সা করা হয়। ঢাকাসহ মেট্রো শহরে এই ভাড়া কার্যকরের কথা বলা হলেও বাস্তবতার সাথে এর আকাশ-পাতাল ফারাক এখনও বিদ্যমান। যেমন মোহাম্মদপুর থেকে শাহবাগ পর্যন্ত এলে মিনিবাসের ভাড়া রাখা হয় ১০ টাকা। কিন্তু শাহবাগের পর যে কোনো স্থানে নামলে এই ভাড়া ১৫ টাকা হয়। মোহাম্মদপুর থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত কোনো কোনো বাসের ভাড়া ১৫ টাকা। ওই বাসেই আবার মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া ২০ টাকা। কিলোমিটারের হিসাবে যা একেবারে বেমানান।
এসব অনিয়ম ছাড়াও রাজধানীর রাস্তার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মূলে হলো সিটি সার্ভিস বাসগুলো। রাজধানীর এমন কোনো স্থান নেই যেখানে বাস দাঁড়ানো থাকে না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাত্রাবাড়ী থেকে রায়েরবাগ, কমলাপুর থেকে শাজাহানপুর, মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে দিলকুশা, মহাখালী থেকে নাবিস্কো, কল্যাণপুর থেকে গাবতলী, মোহাম্মদপুর সাতরাস্তা থেকে ধানমন্ডি, আদাবর থেকে শ্যামলী, রামপুরা ব্রিজ থেকে বনশ্রী পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে দিন-রাতে সব সময় বাস ও মিনিবাস দাঁড় করানো থাকে। বাসের সারিতে রাস্তায় যান চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে। কিন্তু দেখার কেউ নেই। রাস্তায় চলাচলের সময় যেখানে ‘দাঁড়ানো যাবে না’ বলে সাইনবোর্ড দেয়া থাকে সেখানে বেশি বেশি দাঁড়ায় বাসগুলো। এতে করে পেছনে যানবাহন আটকা পড়ে সৃষ্টি হয় যানজটের। তাতেও ভুক্তভোগী ওই যাত্রীরাই।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নগর পরিবহনে বিশৃঙ্খলা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ