Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তুরস্কে জনগণের অভ্যুত্থান

সামরিক শক্তির ক্ষমতা দখলের চেষ্টা নস্যাৎ

প্রকাশের সময় : ১৭ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:০০ এএম, ১৭ জুলাই, ২০১৬

সংঘর্ষে সেনা-পুলিশ-জনতাসহ নিহত ২৬৫, আহত ২ সহ¯্রাধিক
সেনাবাহিনীর একটি অংশ জড়িত, ৩ সহ¯্রাধিক সেনা ও কর্মকর্তা গ্রেফতার
রাজপথ-পার্লামেন্ট-পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স-টিভি স্টেশন-বিমানবন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সরকারের পুনঃনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত
ষড়যন্ত্রকারীরা রাষ্ট্রদ্রোহী, তাদের চূড়ান্ত মাশুল দিতে হবে : এরদোগান
ইনকিলাব ডেস্ক : এ এক অকল্পনীয় দৃশ্য! গগনবিদারী আওয়াজে ছুটে চলা ট্যাংকের সামনে দৌড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে যুবকেরা। কেউ শুয়ে পড়ছে চিৎ হয়ে। শত শত মানুষের ঘেরাওয়ে পড়ে থেমে যেতে বাধ্য হচ্ছে সর্বাধুনিক কামান, মেশিনগান ও প্রযুক্তিসজ্জিত ট্যাংকগুলো। চালকের আসনে থাকা বিশ্বের অন্যতম দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনীটির সশস্ত্র সদস্যরা ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছেন। কী করবেন তারা? গুলি চালাবেন? কেউ কেউ ফাঁকা গুলি ছোঁড়া শুরু করেছেনও, কিন্তু তাতে কিছুই হচ্ছে না। মানুষের ঢল তাদের দিকে এগিয়ে আসছেই। মুহূর্তের মধ্যেই ক্ষুব্ধ অগ্নিশর্মা জনতা ট্যাংকের ওপরে লাফিয়ে উঠে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে আসছে সৈন্যদের! রাজপথে নিরস্ত্র মানুষের হাতে অসহায়ভাবে মার খাচ্ছে সশস্ত্র সেনারা! এ এক নজিরবিহীন ঘটনা। কোথায় গুলি করবে, ক্ষুব্ধ জনতার গণপিটুনি থেকে রক্ষা পেতে অস্ত্র ফেলে, উর্দি খুলে পালানোর চেষ্টা করছেন তারা। এ দৃশ্যগুলো শুক্রবার দিবাগত গভীর রাতে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারা, গুরুত্বপূর্ণ শহর ইস্তাম্বুলসহ বিভিন্ন শহরের।
জনতার অভ্যুত্থানে ব্যর্থ সামরিক ক্যু
শুক্রবার রাতটিও অন্য আরো দশটির রাতের মতোই ছিল তুর্কিদের কাছে। কিন্তু মধ্যরাতে হঠাৎ করে যেমন তা ভিন্ন রকম হয়ে উঠতে থাকে। তুরস্কের সেনাবাহিনীর একটি অংশ অপ্রত্যাশিতভাবে বিদ্রোহ করে বসে দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে। শত শত ট্যাংক-সাঁজোয়া যান নিয়ে রাস্তায় নেমে দেশটির পার্লামেন্ট ভবন, রাষ্ট্রীয় টিভি স্টেশন, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ক্ষমতাসীন দল একেপির হেডকোয়ার্টার্স, ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টসহ গুরুত্বপূর্ণ সব বিমানবন্দর, এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগস্থল বসফরাস ব্রিজসহ যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় অল্পক্ষণের মধ্যে। রাজপথে যুদ্ধের আয়োজন দেখে মানুষজন তখনো বুঝে উঠতে পারেনি আসলে কী ঘটছে? তবে কিছুক্ষণের মধ্যে অনলাইন ও ইলেক্ট্রনিক সংবাদমাধ্যম মারফতে সামরিক ক্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সেনানিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় টিভি থেকে ঘোষণা দেয়া হয়, দেশে মার্শাল ল’ জারি হয়েছে। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। সবাইকে সহযোগিতার আহ্বান জানানো হয়।
দ্রুততার সাথে এমন ঘটনাগুলো যখন ঘটছে তখন প্রেসিডেন্ট এরদোগান ছুটি কাটাতে গিয়ে তুরস্কের মূল ভূখ- থেকে বহু দূরে ভূমধ্যসাগরের মারমারিসে একটি রিসোর্টে অবস্থান করছেন। দেশে ‘মহাপ্রলয়ের’ সংবাদ পেয়েই ছুটি বাতিল করে সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী আঙ্কারার উদ্দেশে রওয়ানা দেন তিনি নিজস্ব জেট বিমানে। কিন্তু ততক্ষণে মূল বিমানবন্দরগুলো সেনাদের নিয়ন্ত্রণে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সব ধরনের বিমানের ওঠানামা। এমন পরিস্থিতিতে অজ্ঞাত স্থানে অতবরণ করে অনলাইনে ‘ফেইসটাইম’ নামে একটি ভিডিও অ্যাপের মাধ্যমে তুরস্কের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। অতি সংক্ষিপ্ত ভাষণে তিনি দেশের জনগণকে দ্রুত রাজপথে নেমে এসে ক্যু নস্যাৎ করে দেয়ার আহ্বান জানান। একই সাথে ঘোষণা দেন ষড়যন্ত্রকারীদের চরম মূল্য দিতে হবে। এরদোগানের এই আহ্বান যেন ম্যাজিকের মতো কাজ করে। মুহূর্তেই মানুষ রাস্তায় নামতে শুরু করে এবং পরের দৃশ্যগুলো হয়ে ওঠে ঐতিহাসিক। গণতন্ত্রের পক্ষে থাকা জনতার ক্ষোভের আগুনের সামনে দাঁড়াতে না পেরে অস্ত্র-উর্দি-ট্যাংক ফেলে পালানোর পথ খুঁজতে থাকে বিদ্রোহী সেনারা। সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য গোপনে পরিকল্পনা করা রাতটি হয়ে যায় জনতার অভ্যুত্থানের রাত! প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম ১৫ জুলাইকে ঘোষণা করেছেন তুরস্কে ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ হিসেবে। বন্দুকের নল ও ট্যাংকের গোলাকে পরাজিত করে বিজয়ী হলো জনগণের ইচ্ছাশক্তি। ইলদিরিম সেনাদের একাংশের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাকে ‘ব্যর্থ’ করে দেওয়া হয়েছে বলে শনিবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছেন।
নিহত ২৬৫, আহত দুই সহ¯্রাধিক
অভ্যুত্থান চেষ্টা ও তা দমনে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৬৫ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন দুই সহ¯্রাধিক এবং গ্রেফতার হতে হয়েছে আরও তিন হাজার সেনা সদস্যকে। গ্রেফতারদের মধ্যে বেশ কয়েকজন উচ্চ ও মধ্যপদস্থ কর্মকর্তাও রয়েছেন।
তুরস্কের সংবাদ সংস্থা আনাদোলুর বরাত দিয়ে এএফপি জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ২৬৫ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে অভ্যুত্থানের চেষ্টাকারী ১০৪ জন, বাকিরা পুলিশ ও বেসামরিক লোকজন। এর আগে দেশটির প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছিলেন নিহতের সংখ্যা ১৬২ জন। তার আগে ভারপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান জানান, নিহতের সংখ্যা ১৯৪ জন। ভারপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান জানিয়েছেন, নিহদের মধ্যে ৪১ জন পুলিশ সদস্য, দুইজন সেনাসদস্য, ৪৭ জন বেসামরিক মানুষ রয়েছেন। নিহত বাকি ১০৪ জনকে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারী বলে জানান তিনি। নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে।
সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত
প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম জানিয়েছেন, দেশের সবক’টি ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণ পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি আরো জানান, অভ্যুত্থানের চেষ্টায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। সরকারের পক্ষ থেকে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেওয়ার দাবি করা হলেও এখনও পরিষ্কার নয় এর পেছনে কারা রয়েছেন। তবে প্রেসিডেন্ট এরদোগান যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত ও সমর্থিত ইসলামি সংস্কারক নেতা ফেতুল্লাহ গুলেনকে দায়ী করেছেন। তবে বিষয়টিও এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। এক বিবৃতিতে গুলেন এই ক্যু প্রচেষ্টার তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি এই ঘটনার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নন বলে দাবি করেছেন।
বিচ্ছিন্ন হামলা চলছে, চরম অস্থিরতা
সরকারের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও শনিবার দুপুর পর্যন্ত বিদ্রোহীদের হামলা চালিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আঙ্কারা, ইস্তানবুল এবং দেশটির আরও কিছু স্থানে রাতভর গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়। তবে শনিবার দুপুরের পরই ইস্তানবুলে বসফোরাস সেতুতে বেশ কিছু সেনা আত্মসমর্পণ করেছেন। শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া অভ্যুত্থান চেষ্টার একপর্যায়ে শনিবার তারা আত্মসমর্পণ করেন। এ সময় ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থকদের উল্লাস করতে দেখা যায়।
এর আগে শুক্রবার অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাকারীদের পাঠানো একটি বিবৃতির বরাত দিয়ে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, অভ্যুত্থানপন্থী সেনা অংশটি এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করেছে। ‘শান্তি পরিষদ’ নামের ওই অভ্যুত্থানপন্থী বাহিনী জনগণকে বাইরে বের না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো তখন জানায়, তুরস্কের বড় শহরগুলো এখনও গুলির শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, শুক্রবার রাতে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাকারীরা এখনও বেশ কিছু সামরিক হেলিকপ্টার দখল করে রেখেছে। সেনা অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টাকারীদের নিয়ন্ত্রণাধীন উড়ন্ত বিমানগুলোকে ভূপাতিত করার নির্দেশ দিয়েছে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের সামনে বিদ্রোহীদের দমনে বিমান হামলায় অংশ নিয়েছে এফ-১৬ বিমান। এতে একটি বিদ্রোহী হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম।
ষড়যন্ত্রকারীরা রাষ্ট্রদ্রোহী, তাদের চূড়ান্ত মাশুল দিতে হবে : এরদোগান
প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান গতকাল লাইভ টেলিভিশন ভাষণে বলেছেন, সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িতদের চরম মূল্য দিতে হবে। ইস্তানবুল থেকে দেয়া সরাসরি ভাষণে এ কথা বলেছেন তিনি। বিমানবন্দর থেকে দেয়া ভাষণে তিনি বলেন, যা ঘটেছে তা বিশ্বাসঘাতকতা এবং বিদ্রোহ। বিদ্রোহের জন্য তাদেরকে চড়া মূল্য দিতে হবে। তুরস্ককে কোনো দখলদারের কাছে দেওয়া হবে না। তিনি তুরস্কের মানুষদের ছেড়ে কোথাও যাবেন না বলেও এ সময় জানান। সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী এ অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা করেছে উল্লেখ করে এরদোগান বলেন, সামরিক বাহিনীতে শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে। এ সময় অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারীদের ব্যবহৃত বিমান গুলি করে ভূপাতিত করার নির্দেশ দেন এরদোগান।
সেনাবাহিনীর এক অংশ সরকারের পক্ষে
সেনাবাহিনীর শক্তিশালী একটি অংশ ক্যুর সাথে জড়িত থাকলেও আরেকটি অংশ এরদোগান সরকারের পক্ষে রয়েছে। মিডিয়ার কাছে পাঠানো বিবৃতিতে তুরস্কের সেনাবাহিনীর সরকারপন্থী অংশ দাবি করে, গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে তারা ‘পুরোপুরিভাবে দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে’। সেই গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলা যেখানে আইনের শাসন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় থাকবে।
সেনাপ্রধানকে অপহরণ, পরে উদ্ধার
অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সময় সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়া সেনাপ্রধান জেনারেল হুলুসি আকারকে অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বিশেষ বাহিনীর অভিযানে তাকে একটি বিমানঘাঁটি থেকে উদ্ধার করা হয়।
শুক্রবার রাতে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা শুরুর পরপরই বিদ্রোহী সেনাদের একটি গ্রুপ তাকে জিম্মি করে আনকারার একিনসিলার বিমানঘাঁটিতে নিয়ে যায়। পরে সেখানে অভিযান চালিয়ে তাকে উদ্ধার করে তুরস্কের সেনাবাহিনীর সদস্যরা। একিনসিলার বিমানঘাঁটি তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারা থেকে ৩৫ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত। এর আগে সেনাপ্রধান নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় তুরস্কের ভারপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল উমিত দুনদারকে নিয়োগ দিয়েছিল সরকার।

 

 



 

Show all comments
  • Aziz ১৭ জুলাই, ২০১৬, ৪:২৮ পিএম says : 0
    ai headline ta amar kase perfect mone hoyese
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: তুরস্কে জনগণের অভ্যুত্থান
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ