Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সুন্দরবনের দুই দস্যু বাহিনীর অস্ত্র সমর্পণ

প্রকাশের সময় : ১৬ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বাগেরহাট জেলা ও মংলা সংবাদদাতা : সুন্দরবনের বনদস্যু ‘মজনু ও ইলিয়াস’ বাহিনীর দুই প্রধানসহ তাদের অপর নয় সহযোগী আনুষ্ঠানিকভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। শুক্রবার দুপুরে মংলা বন্দরের বিএফডিসি জেটিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ তুলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন তারা। বনদস্যু মাস্টার বাহিনীর পর আত্মসমর্পণের এটি দ্বিতীয় ঘটনা।
এর আগে গত ৩১ মে সুন্দরবনের আরেক বনদস্যু ‘মাস্টার বাহিনী’র প্রধান মোস্তফা শেখ ওরফে কাদের মাস্টার ও তার দশ সহযোগী আত্মসমর্পণ করেন। ওই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মাস্টার বাহিনী ৫২টি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও পাঁচ হাজার রাউন্ড গুলি জমা দেয়। বনদস্যু মাস্টার বাহিনীর সদস্যরা বর্তমানে বাগেরহাট জেলা কারাগারে বন্দি রয়েছেন। জমা দেয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ১১টি বিদেশি একনলা বন্দুক, তিনটি দোনলা বন্দুক, দুটি এয়ার রাইফেল, তিনটি ওয়ান শুটারগান, পাঁচটি শার্টারগান, একটি রিভলবার ও বিভিন্ন ধরনের ১ হাজার ২০টি গুলি।
আত্মসমর্পণ করা দস্যুদের মধ্যে রয়েছেন খুলনা মহানগরীর দৌলতপুরের পাবলা সবুজ সংঘ এলাকার আমির আলী গাজীর ছেলে মজনু বাহিনীর প্রধান মজনু গাজী, তার দলের সদস্য বাবুল হাসান, মো. জাহাঙ্গীর হোসেন রহমত, মো. ইদ্রিস আলী, ইসমাঈল হোসেন, মজনু শেখ, মো. রবিউল ইসলাম, মো. আবুল কালাম আজাদ, মো. এনামুল হোসেন এবং খুলনার কয়রা উপজেলার মহেশ^রীপুর গ্রামের আবু বক্কর গাজীর ছেলে ইলিয়াস বাহিনীর প্রধান মো. ইলিয়াস গাজী ও তার সহযোগী মো. নাসির হোসেন। আত্মসমর্পণকারীদের বাড়ি খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন এলাকায়।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, এই দস্যুরা সুন্দরবনে ভয়ঙ্কররূপে বিচরণ করছিল। নিজেদের কৃতকর্মের ভুল বুঝতে পেরে তারা অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে। সরকার সমস্ত বাংলাদেশকে সন্ত্রাস ও দস্যুমুক্ত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমরা সন্ত্রাস দস্যুতা কোনটাই করতে দেব না। র‌্যাবসহ সমস্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। উদ্দেশ্যে একটাই দেশ থেকে সবধরনের সন্ত্রাস নির্মূল করা। শুক্রবার দুপুরে মংলা বন্দরের বিএফডিসি জেটিতে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একথা বলেন।
সুন্দরবনের গুরুত্বটা অনেক বেশি। সুন্দরবন বিশ^ ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ স্থান এখানে প্রতিনিয়ত দেশি-বিদেশী অসংখ্য পর্যটক ঘুরতে আসেন। সুন্দরবন মৎস্যজীবীদের জন্যও একটি আদর্শ জায়গা। এই সুন্দরবন বিপদমুক্ত, দস্যুমুক্ত করতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যারা দস্যুতা ছেড়ে ফিরে আসছেন তাদের আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। আর যারা এখনো ফিরে আসেননি তারা দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন। আর যদি না ফিরে বনে দস্যুতা চালিয়ে যান তাহলে পরিণতি কি হবে তা বলতে চাই না বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির এক নেতা এই প্রতিবেদককে বলেন, কয়েক বছর আগে বনদস্যু মজনু এবং ইলিয়াস বাহিনী তাদের নিজ নিজ নামে বাহিনী গঠন করে। তারা সুন্দরবনের পশ্চিম অঞ্চলের পেশাজীবী জেলে, বাওয়ালী ও মৌয়ালদের জন্য আতঙ্কের নাম। ওই দুই বাহিনী প্রধান তাদের সহযোগীদের নিয়ে সুন্দরবনের পশ্চিম বিভাগ এবং বঙ্গোপসাগর এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে আসছিল। দস্যু বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র নিয়ে জেলেদের নৌকা ও ট্রলারে হামলা চালিয়ে জাল মাছ লুট করে নেয়া এবং জেলেদের অপহরণের পর বনের গহীনে জিম্মি রেখে তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করে আসছিল। তাদের অত্যাচার নির্যাতনে সুন্দরবন অভ্যন্তরে এবং সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা অতিষ্ঠ ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে মজনু ও ইলিয়াস বাহিনী আত্মসমর্পণ করায় আমরা দারুণ খুশি হয়েছি। এদের মতো অন্য যে বনদস্যু বাহিনীগুলো (সাগর ও সুন্দরবন) রয়েছে তারা যদি সবাই দস্যুবৃত্তি ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে তাহলে সাগর ও সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল পেশাজীবীরা তাদের পেশায় নির্ভয়ে কাজ করতে পারবে বলে মত দেন তিনি।
র‌্যাব-৮ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. ফরিদুল আলম বলেন, সুন্দরবন ও সাগরের উপর নির্ভরশীল মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র‌্যাব-৮) দস্যু দমনে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে। পেশাজীবীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সুন্দরবনে র‌্যাবের বেশ কয়েকটি ক্যাম্প রয়েছে। আমাদের নিয়মিত অভিযানের কারণে বনের দস্যুরা অনেকটাই কোন ঠাসা হয়ে পড়েছে বলে দাবী তার। তাই দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সরকারের প্রতি আস্থা রেখেই দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে দুটি দস্যু বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে বলে দাবী করেন ওই র‌্যাব কর্মকর্তা।
তিনি আরও বলেন, সুন্দরবনে আরও কয়েকটি দস্যু বাহিনী রয়েছে তাদেরও স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে আমরা কাজ করছি।
আত্মসমর্পণ করা দস্যু বাহিনীর প্রধানরা বলেন, নানা প্রতিবন্ধকতার কারনে বাধ্য হয়ে দস্যু বাহিনীতে যোগ দেই। সুন্দরবনে দস্যু জীবন বেছে নেয়ার পর সব সময় এক ধরনের শঙ্কার মধ্যে থাকতাম। কখন বুঝি প্রতিপক্ষ দস্যু বাহিনী অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বুলেট আমাদের বুকে বিদ্ধ হয়। আমাদের প্রতিপক্ষ মাস্টার বাহিনী সম্প্রতি দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণ করে। মাস্টার বাহিনীকে দেখে আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে উদ্বুদ্ধ হই। আমরা গনমাধ্যম ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী উপর আস্থা রেখে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে এই উদ্যোগ নিয়েছি।
র‌্যাব জানিয়েছে গত পাঁচ বছরে তাদের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৬৭ জন নৌ ও বনদস্যু নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩৮ জন ছিল বাহিনী প্রধান। এসময়ে দস্যুদের ব্যবহৃত প্রায় ৪০০টি দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র এবং কয়েক হাজার রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। এছাড়া দস্যুদের ব্যবহৃত দেশীয় ধারালো অস্ত্র, বিপুল পরিমাণ খাদ্য সামগ্রীসহ বিভিন্ন ধরনের মালামাল উদ্ধার করে র‌্যাব।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের (র‌্যাব) মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ, র‌্যাব-৮-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. ফরিদুল আলম, পুলিশের খুলনা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজ) এম মনিরুজ্জামান, বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর আলমসহ স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সুন্দরবনের দুই দস্যু বাহিনীর অস্ত্র সমর্পণ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ