Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শঙ্কায় অর্থনীতি

প্রকাশের সময় : ১৫ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:০৩ পিএম, ১৪ জুলাই, ২০১৬

হাসান সোহেল : গুলশান ও শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলায় ১৭ বিদেশী নিহত হওয়ায় দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। নিহত জাপানীরা উন্নয়ন কর্মকা-ে জড়িত ছিলেন আর ইতালীয়রা গার্মেন্টসের সঙ্গে ছিলেন যুক্ত। এ বর্বরোচিত ঘটনার পর গার্মেন্ট পণ্যের ক্রেতারা অর্ডার দেয়া-নেয়া সংক্রান্ত আলোচনার জন্য ঢাকার বদলে বিদেশে বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হয়ে এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছে অংশীজনেরা। সরকারের কেউ কেউ ‘নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না’ দাবি করলেও দায়িত্বশীলদের অনেকেই এ শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাদের বক্তব্য এখনই পরিস্থিতি মোকাবেলাসহ বিশ্ববাজারে দেশের ভাবমর্যাদা অক্ষুণœœ রাখতে না পারলে যা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির মুখে ফেলবে। আর তাই সরকারকে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
গার্মেন্টস শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে কোনভাবেই বিদেশীদের আস্থার সঙ্কট হতে দেয়া যাবে না বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতি বিদেশী বিনিয়োগসহ রফতানির সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাকের ওপর প্রভাব ফেলেছে। পাশাপাশি বিদেশী পর্যটকদের সফর বাতিল ও দেশী পর্যটকদের ভ্রমণও কমায় বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের জন্য এটি একটি অশনি সংকেত। এছাড়া বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিদেশী বিনিয়োগেও দেখা দিতে পারে অনিশ্চয়তা। পাশাপাশি উন্নয়নের বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়েও সমস্যা দেখা দিতে পারে। কারণ অধিকাংশ প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ হচ্ছেন বিদেশী নাগরিক। সংশ্লিষ্টদের মতে, ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মানের দুটি সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিদেশী ব্যবসায়ীরা তাদের সফরগুলোও বাতিল করেছে। যে কারণে হোটেল ব্যবসায়ও মন্দা শুরু হয়েছে। নতুন করে তারা কোনো বুকিং পাচ্ছে না। তারা মনে করেন, সরকারকে এখন থেকেই বায়ার ও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলে তাদেরকে আশ্বস্ত করতে হবে। এজন্য সরকারের দক্ষতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে সরকারকে অস্বীকার করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে নিরাপত্তা খাত আরও শক্তিশালী করাসহ কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবাইকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। যদিও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স বলছে, কথিত ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর একাধিক হামলার ঘটনা ঘটলেও, তারা বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক কেনা অব্যাহত রাখবে। ইতোমধ্যে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ দাবী করেছেন, সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ব্যবসা বাণিজ্যে কোন প্রভাব পড়বে না। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, এ ঘটনা বিদেশী বিনিয়োগে সামান্যতম নেতিবাচক প্রভাবও পড়বে না। ‘তবে কিছুটা (এটা তো একটা শক্) ধাক্কা বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। আবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের ভাবমর্যাদা নষ্ট করতেই এই হামলা। যদি এটা রোধ করা না যায়, তাহলে অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে। যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ ঘটনায় দেশের উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করেছেন।
দেশের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করলেও ২০১৬-এর মাঝামাঝিতে দাঁড়িয়ে এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে প্রবৃদ্ধি ছুঁয়েছে সাত অংকের ঘর, বেড়েছে মাথাপিছু আয়। এছাড়া রপ্তানি বাণিজ্যসহ অর্থনীতির অন্যসব সূচকও সন্তোষজনক। আর এর অন্যতম মাধ্যম গার্মেন্ট রপ্তানি, যেটি দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। গত বছরও মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশই ছিল এ খাতের অবদান। পাশাপাশি এ খাতের হাজার হাজার কারখানায় কাজ করছেন প্রায় অর্ধ কোটি মানুষ।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনা আর হরতাল অবরোধ বহির্বিশ্বে সুনাম ক্ষুণœœ করলেও তা থেকে বেরিয়ে এসে দেশের অর্থনীতির চাকা যখন এমনই সচল তখন গুলশান ট্র্যাজেডি। যে সন্ত্রাসী হামলা কেড়ে নিয়েছে ১৭ বিদেশীর প্রাণ। নিহত হয়েছেন আরো কয়েকজন। এখানেই শেষ নয়; কয়েকদিন পরেই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতে আবার সন্ত্রাসী হামলা। এখানেও ৪ বাংলাদেশী মারা যান। দেশের ইতিহাসে ন্যক্কারজনক এসব হত্যাকা-ের প্রভাবকে অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক হিসেবেই দেখছেন ব্যবসায়ী মহল। এদিকে বিশ্বের অনেক দেশের পোশাক উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে। আর তাই ইতোমধ্যে ঢাকার পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও কূটনৈতিক মহল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলায় বাংলাদেশ তার ইমেজ সংকটে পড়বে। ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হবে। বায়াররা ও বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে নিরুৎসাহী হবে। যেহেতু বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশীদের টার্গেট করে এই ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- হচ্ছে। ফলে এ দেশে অবস্থানরত বিদেশীরা দেশ ত্যাগ করবে। যদি কেউ এখানে থেকে যায় তারা শঙ্কার মধ্যে জীবনযাপন করবে। শঙ্কায় থেকে তারা কখনো বিনিয়োগ করবে না। মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অতীতে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদাতে সঙ্কট এলেও সরকার সুন্দরভাবে কাটিয়ে উঠেছে। তবে গুলশা
এবং শোলাকিয়ার ঘটনা বাংলাদেশের জন্য একেবারে নতুন। এজন্য সরকারকে এখন থেকেই বায়ার ও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলে তাদেরকে আশ্বস্ত করতে হবে। যে এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এজন্য সরকার ও ব্যবসায়ীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। ব্যবসায়ী ও সরকারকে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে।
গুলশানে হামলার পর বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী নাগরিকদের সতর্ক ও নিরাপদে থাকার নির্দেশ দিয়েছে নিজ নিজ দেশগুলো। এ ঘটনায় পর বাংলাদেশে কাজ করে এমন গার্মেন্টস ও নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা তাদের সফর বাতিল করেছেন। জাপানি মালিকানার পোশাক ব্রান্ড ‘ইউনিকলো’ সূত্রে জানা যায়, তাদের সব কর্মকর্তার বাংলাদেশ সফর স্থগিত করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপদে থাকতে বলা হয়েছে। ‘বাংলাদেশে ইউনিকলো’র ১০ জন জাপানি কর্মকর্তা কাজ করছেন। মার্কস, স্পেন্সার ও গ্রাপ-এর মতো বড় কোম্পানিতে তৈরি পোশাক সরবরাহ করে স্প্যারো গ্রুপ। কোম্পানিটির প্রধান শোভন ইসলাম জানান, গত বছর জাপানি ও ইতালি নাগরিক জঙ্গিদের হাতে খুন হন। ওই ঘটনার পরেই আমাদের অর্ডার পেতে বেশ বেগ পেতে হয়। অনেক বিদেশী বায়ার বাংলাদেশে তাদের মিটিং বাতিল করে। পরে সেই মিটিং ব্যাংকক, দিল্লি ও হংকং গিয়ে করতে হয়েছে। গুলশানের স্প্যানিশ রেস্তোরা ‘হলি আর্টিজান বেকারি’ বিদেশী হত্যার ঘটনায় পর আমাদের অবশ্যই অর্ডার পেতে বেশ কষ্ট করতে হবে। ভারতের গুরগাওয়ে অবস্থিত অরিয়েন্ট ক্রাফট নামের পোশাক কারখানা মালিক সুধির ধিনঙ্গরা জানান, এমন হামলার পর বায়াররা অবশ্যই ভিন্ন কিছু ভাবছেন। আমি উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজন বায়ারের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে তারা যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন, এর ফলে অর্ডারও বাতিল হতে পারে। বাংলাদেশী পোশাক রফতানিকারক ওয়েগা ফ্যাশন সুয়েটারের মালিক মেসবাহ উদ্দিন জানান, দুঃখজনক হলেও গুলশান হামলার ঘটনায় নিহত ৯ জনের মধ্যে ৬ জনের সঙ্গেই আমি ব্যবসা করেছি। জাপানের নির্মাণ কোম্পানি ওবায়াসি ও সিমিজু দুটি প্রতিষ্ঠানের অন্তত এক ডজন কর্মকর্তা বাংলাদেশে সেতু নির্মাণের কাজ করছেন। কোম্পানি দুটি জানায়, তারা তাদের কর্মচারীদের ঘরে থেকে বের হতে নিষেধ করেছে। তবে সুইডেনের ‘এইচ অ্যান্ড এম’ ব্র্যান্ড আন্তর্জাতিক অন্যসব পোশাক আমদানিকারকদের মতোই বলেছে গুলশান হামলার কারণে তাদের কোনও অর্ডার বাতিলের আশঙ্কা নেই। তবে আমরা বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।
এদিকে দেশে ভ্রমণকারী বিদেশীরা তাদের বুকিংগুলো বাতিল করে দিচ্ছে। যা দেশের পর্যটন শিল্পের জন্য এক ধরনের অশনি সংকেত। সূত্র মতে, সেøাভাকিয়া থেকে প্রতি মাসে একটি ভ্রমণকারী দল বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে আসে। তাদের আনা-নেয়ার কাজ করছে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান ট্রাবলস অ্যান্ড ট্যুরস। কিন্তু গুলশান ও শোলাকিয়া জঙ্গি হামলার পর সেøাভাকিয়া থেকে বাংলাদেশ সফর অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে। এ তথ্য জানান, ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের সিইও মিন্টু রতœ। সেøাভাকিয়ার মতো যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি, ইউরোপ ও ইতালিসহ বিশ্বের অনেক দেশের ভ্রমণপিপাসুরা বাংলাদেশের সফর বাতিল করছে। তারা (বিদেশী নাগরিক) ভ্রমণের জন্য বেছে নিচ্ছে ভারত, ফিলিপাইন ও নেপালকে। পাশাপাশি কমেছে দেশী পর্যটকদের ভ্রমণও, যা বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের জন্য অশনি সংকেত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিদেশী পর্যটক সফর বাতিল ও আন্তর্জাতিক মানের সম্মেলন স্থগিতের কারণে হোটেল ব্যবসায়ও মন্দা শুরু হয়েছে। নতুন করে তারা কোনো বুকিং পাচ্ছে না। অথচ চলতি ২০১৬ সালকে বাংলাদেশের পর্যটন বর্ষ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। যা কেন্দ্র করে পর্যটন বর্ষ ও ২০১৭ সাল এই দু’বছরের মোট ১০ লাখ বিদেশী পর্যটক আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিদেশী পর্যটক আনার লক্ষ্য অর্জনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে বলে সংশয় রয়েছে। বিদেশী অতিথিদের ভ্রমণ কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান এ-ওয়ান ট্যুরিজমের সিইও সাইফুল ইসলাম বলেন, দেশের ভেতর পরপর দুটি হামলার ঘটনায় বিদেশীরা আসতে চাচ্ছে না বাংলাদেশে। পূর্বনির্ধারিত অনেক সফর ইতিমধ্যে বাতিল করে দিয়েছে। দ্য সাউদার্ন ট্যুরসের মিজানুর রহমান মিজান বলেন, গত বছর ঈদে প্রায় আড়াইশ’ জন বিদেশী পর্যটক সুন্দরবনে দেখতে আসে। এ বছর মাত্র এসেছে আটজন। গুলশানে বিদেশী ও শোলাকিয়ায় হামলার পর নিরাপত্তার ঝুঁকি মনে করে পর্যটকরা সুন্দরবন ভ্রমণে আসছে না।
সাধারণত সেপ্টেম্বরে পর্যটকদের আগমন বাড়ে। জানা গেছে, এ সময়কে ঘিরে অনেক দেশ থেকে পর্যটকরা আগাম বুকিং দিয়েছেন। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে আগের বুকিংগুলো বাতিল করা হচ্ছে। পাশাপাশি এখন বিদেশীরা একদম আসছে না। ফলে পর্যটন শিল্প ঘিরে গড়ে ওঠা হোটেল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মন্দা চলছে। সুন্দরবন লাইভ ট্যুরসের গোলাম রহমান বিটু বলেন, ঈদের ছুটিতে সাতজন জার্মানিসহ মোট ১৩ জন বিদেশীর সুন্দরবন ভ্রমণে আসার জন্য আগাম বুকিং ছিল। কিন্তু গুলশানে হামলার কারণে  সেসব বিদেশী তাদের বুকিং বাতিল করেছেন। ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের সিইও মিন্টু রতœ বলেন, প্রতি মাসে বিদেশীদের বাংলাদেশ ভ্রমণের মাধ্যমে নিম্নে ৫০ হাজার মার্কিন ডলার আয় হতো। এখন ৫ হাজার ডলার হচ্ছে না। তার দেয়া তথ্য মতে, আন্তর্জাতিক মানের ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি মাসে বিদেশীদের ভ্রমণের মাধ্যমে এক লাখ মার্কিন ডলারও আয় করছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ৯০ শতাংশ আয় কমেছে। জাপান ও ইউরোপের ভ্রমণকারীরা আসা বাদ দিয়েছে বাংলাদেশে। এসব দেশের মধ্যে জাপান ও ইউরোপের ভ্রমণকারীরা উত্তরবঙ্গ এবং রাঙ্গামাটিতে বেশি ভ্রমণে আগ্রহী থাকতেন। ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদেশী পর্যটকদের আসা কমেছে ঢাকা প্রথম ইতালি নাগরিক তাভেল্লা সিজার হত্যার পর থেকে। এরপর আরও কয়েক বিদেশীর ওপর হামলা চলে বাংলাদেশে। সর্বশেষ গুলশানে জঙ্গিদের হামলার ফলে বাংলাদেশে সফরে আসার ব্যাপারে অধিক সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিদেশী নাগরিকরা।
এদিকে নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকায় ২৩ থেকে ২৮ জুলাই অনুষ্ঠেয় আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং গ্রুপ (এপিজি) সম্মেলন বাতিল করা হয়েছে। সেখানে ৪১টি দেশ থেকে চারশ’ বিদেশী প্রতিনিধি অংশ নেয়ার কথা। ঢাকায় অনুষ্ঠেয় আরেকটি আন্তর্জাতিক মানের আইসিটি সম্মেলনও বাতিল করা হয়েছে।  সেখানে প্রায় সাড়ে তিনশ’ বিদেশী অংশ নেয়ার কথা ছিল।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি’র) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক তৌহিদুল ইসলাম খান বলেন, এই মুহূর্তে সারা বিশ্ব একটি চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আর এ সময়ে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলা অর্থনীতিকে নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেবে। গত কয়েক বছর আমাদের বিদেশী বিনিয়োগ খারাপ একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই ঘটনা বিনিয়োগকে আরও নিরুৎসাহীত করবে। এজন্য সরকারকে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে সরকারি ও বেসরকারিভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই’র) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এই ঘটনায় আমাদের অর্থনীতিতে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে বিরূপ প্রভাব পড়বে। অনেক বিদেশী এ দেশ থেকে চলে যেতে পারে। এতে করে তাদের সঙ্গে এদেশের বিনিয়োগও অন্য দেশে চলে যাবে। যা আমাদের পর্যটন খাত ও অর্থনীতির জন্য একটি সতর্ক বার্তা। এজন্য সরকারের দক্ষতা অনেক বাড়াতে হবে। সরকারকে অস্বীকার করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে নিরাপত্তা খাত আরও শক্তিশালী করাসহ কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবাইকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। ড. আহসান এইচ মুনসুর বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিকে সরকার যদি এখানেই সীমাবদ্ধ রাখতে পারে তাহলে হয়তো বর্তমান নেতিবাচক প্রভাব থেকে দ্রুত বেড় হয়ে আসতে পারবো। বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, এ ধরনের ঘটনা আমাদের জন্য অপ্রত্যাশিত ও দুঃখজনক। গত তিন বছর বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে পার করেছে। সবে মাত্র একটু ভালো দিকে যাচ্ছিল আর ঠিক এ মুহূর্তে এ ধরনের ঘটনা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবর্যাদাতে প্রভাব ফেলবে। ফলে বায়াররা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। যে সমস্ত বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ নিয়ে আসতে চেয়েছিল তারা এখন ১০ বার ভাববে। সবচেয়ে বড় কথা হলো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটা বড় ধরনের ধাক্কা আসবে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউজ এসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসেন বলেন, সাম্প্রতিককালের ঘটনা রফতানিতে কিছুটা প্রভাব পড়বে। হয়তোবা চলমান কার্যক্রমে ক্ষতির প্রভাব পড়বে না। তবে আগামীদিনে ব্যবসায় প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন তিনি। এফবিসিসিআই সহ-সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, যে কোনো দুর্ঘটনাই অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। এ ধরনের ঘটনা মোটেও সুখকর না। এতে অর্থনৈতিক কি পরিমাণ ক্ষতির সম্মুুখীন হবে এ মুহূর্তে হিসাব করা সম্ভব হবে না। আগামী চার থেকে পাঁচ মাস পড়ে এটা বুঝা যাবে। আগামীতে যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার জন্য সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে কেবল আশ্বাসই নয়, কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার সবাইকে আশ্বস্ত করবেন এমনই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শঙ্কায় অর্থনীতি

১৫ জুলাই, ২০১৬
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ