Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অর্থনৈতিকভাবে দেশ কি এগুচ্ছে?

প্রকাশের সময় : ১৪ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এবিসিদ্দিক

দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি বা অবনতির মাপকাঠি হল স্থির মূল্যে স্থুল দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির হার। প্রবৃদ্ধি যদি বাড়ে তা হলে বুঝতে হবে যে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে বা হচ্ছে আর কমলে অবনতি হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে (২০১৫-১৬) অর্থবছরে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির হার দেখানো হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, যা নিয়ে বির্তকও আছে বটে। ৯ বছর আগে অর্থাৎ ২০০৬-০৭ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। তা হলে দেখা যায়, ৯ বছর পর অর্থনৈতিক অবনতি হয়েছে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৬ হচ্ছে সরকারের অর্থনৈতিক দলিল। কি বলছে সেই দলিলে? কৃষি ও বনজ খাতে ২০০৬-০৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কমে এসে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৫৩ শতাংশে। একই সময়ের ব্যবধানে মৎস্য সম্পদ খাতে প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৪১ থেকে ৬ দশমিক ১৯ শতাংশে কমে আসে। শিল্পখাতে(ম্যানুঃ) খাতে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১০ দশমিক ৮১ শতাংশ যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কমে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৩০ শতাংশে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সম্পদ খাতে ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কমে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ১৫ শতাংশে। একই সময়ের ব্যবধানে বিদ্যুৎ খাতের প্রবৃদ্ধি ১৫ দশমিক ৮২ থেকে ১১ দশমিক ৪২ শতাংশে কমে আসে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে গ্যাস খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১০ দশমিক ৩৩ শতাংশ যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশে কমে আসে। পানি সম্পদ খাতে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৩ দশমিক ২৯ শতাংশ যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশে কমে আসে। পাইকারি ও খুচরা বাণিজ্য খাতে ২০০৬-০৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৬১ শতাংশে কমে আসে। পরিবহন, সংরক্ষণ ও যোগাযোগ খাতে ২০০৬-০৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫১ শতাংশে কমে আসে। আর্থিক প্রাতিষ্ঠানিক সেবা খাতে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২৭ দমমিক ৮০ শতাংশ যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৬৪ শতাংশে কমে আসে। ব্যাংক খাতে প্রবৃদ্ধি একই সময়ের ব্যবধানে ২৯ দশমিক ৩৭ থেকে ৭ দশমিক ২৪ শতাংশে, বীমা খাতে ২৫ দশমিক ২২ থেকে ২ দশমিক ৬৬ শতাংশে আর অন্যান্য আর্থিক খাতে প্রবৃদ্ধি একই সময়ের ব্যবধানে ৭ দশমিক ৬১ থেকে ৫ দশমিক ১২ শতাংশে কমে আসে।
অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি কৃষি, শিল্প ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রবৃদ্ধি আশঙ্কাজনকভাবে কমছে বা কমেছে। দেশে বিনিয়োগ নেই, শিল্পায়ন নেই যার ফলে নেই কর্মসংস্থান। বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী বিনিয়োগ বোর্ডে নিবন্ধিত প্রকল্পসমূহে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছিল ২০১০-১১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৩ হাজার ৬৬২ জনের আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত হয়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৫৩ জনের। আগের অর্থবছরে হয়েছিল ২ লাখ ২৬ হাজার ৪১১ জনের। কর্মসংস্থান কমছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাবনায় ছিল ৮৪১ দশমিক ৫৫২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে কমে আসে ২২৩ দশমিক ০৬৯ মিলিয়ন ডলারে। বেসরকারি বিনিয়োগ নিবন্ধন চিত্রটা হচ্ছে-২০০৫-০৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১২৪ শতাংশ যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কমে আসে ৪৫ দশমিক ৪৬ শতাংশে। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের তালিকায় আছে ৫৪টি দেশ, যার মধ্যে ৩০টির অধিক দেশ বাংলাদেশে কোন বিনিয়োগই করছে না। শিল্পের নামে প্রতিবছর লাখ কোটি টাকার উপরে ঋণ গেলেও শিল্পায়ন নেই। বিনিয়োগ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) শিল্পখাতে ব্যাংক ঋণ গেছে ১ লাখ ২৪ হাজার ২৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে একই খাতে ঋণ গেছে ২ লাখ ১৯ হাজার ৩৩০ কোটি ১২ লাখ টাকা, তার আগের অর্থবছরে ঋণ গেছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৪১৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা। অপরদিকে ২০১৫-১৫ অর্থবছরের ৮ মাসে স্থানীয় বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়েছে ৫৩ হাজার ৬৮০ কোটি ৮৭ লাখ টাকার, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে নিবন্ধন হয়েছে ৪৭ হাজার ২৪৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকার আর তার আগের অর্থবছরে হয়েছে ৪৯ হাজার ৭৫৯ কোটি ৩২ লাখ টাকার। দারিদ্র্যের অবস্থা কি? পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে মোট আয়ে দরিদ্রদের আয়ের অংশ ১৯৯১-৯২ সালে ছিল ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ; যা ২০১০ সালে কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ২২ শতাংশে। নিম্ন মধ্যবিত্তদের আয়ের অংশও এ সময়ে ১০ দশমিক ৮৯ থেকে ৯ দশমিক ১০ শতাংশে নামে। আর মধ্যবিত্তদের আয়ের অংশ ১৫ দশমিক ৫৩ থেকে কমে গিয়ে ১৩ দশমিক ৩২ শতাংশে নেমে যায়। অন্যদিকে সবচেয়ে উপরের ১০ শতাংশের আয়ের অংশ ২৯ দশমিক ২৩ থেকে বেড়ে ৩৫ দশমিক ৮৪ শতাংশে উঠে যায়। এসব পরিসংখ্যান (যেগুলো বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ থেকে প্রাপ্ত) থেকে এটা স্পষ্ট যে, আয়ের বণ্টনের দিক থেকে দেখলে গত দুই দশকে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের অবস্থার অবনতি ঘটেছে, আর উচ্চবিত্তরা উঠেছে উপরের দিকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ তাদের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এ ধরনের উপসংহারেই এসেছে। আয়ের বণ্টনে অসাম্য বৈষম্যের একটি মাত্র দিক। আসলে বৈষম্য বহুমাত্রিক বিষয়, আয় ছাড়াও রয়েছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো বিষয়ে শ্রেণিবৈষম্য, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য। শিক্ষার কথাই ধরা যাক। এ কথা বলতে হবে যে, দরিদ্র ও নিম্নবিত্তদের জন্য শিক্ষাখাতে অনেক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু এ শ্রেণির শিশু-কিশোর যে ধরনের স্কুলে যায় আর সেসব স্কুলে কী মানের শিক্ষা দেয়া হয়, সেটা উচ্চবিত্তদের শিক্ষার মানের সঙ্গে তুলনা করলেই এক্ষেত্রে বৈষম্যের চিত্রটি কিছুটা হলেও পাওয়া যায়। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য যে বিরাট, তা সহজেই বলা যায়। লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের ক্ষেত্রে চিত্রটা এত পরিষ্কার নয়। শিক্ষা- বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য হয়তো কমেছে, কিন্তু জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে, বিশেষ করে কর্মসংস্থান, বেতন ও মজুরির ক্ষেত্রে এ কথা কি জোর দিয়ে বলা যায়?
লেখক : সাংবাদিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অর্থনৈতিকভাবে দেশ কি এগুচ্ছে?
আরও পড়ুন