Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

চট্টগ্রাম বন্দরে ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম সংগ্রহের উদ্যোগ

প্রকাশের সময় : ১৩ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৫৫ পিএম, ১২ জুলাই, ২০১৬

শফিউল আলম : দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রামে শিগগিরই পর্যাপ্ত অত্যাধুনিক ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম (ইকুইপমেন্টস) সংগ্রহের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) বছর বছর মুনাফালব্ধ নিজস্ব তহবিল থেকে এর জন্য অর্থায়ন করা হবে। এতে মোট ১ হাজার ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬১ ধরনের অত্যাধুনিক ভারী যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে। এরমধ্যে ১০টি কী গ্যান্ট্রি ক্রেন ছাড়াও রয়েছে রাবার টায়ারড গ্যান্ট্রি (আরটিজি) ক্রেন, স্ট্র্যাডল ক্যারিয়ার, রিচ স্ট্র্যাকার, কন্টেইনার মোভার, রেল মাউন্টেড গ্যান্ট্রি ক্রেন, যার সবগুলোই কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের উপযোগী ভারী যন্ত্রপাতি। দীর্ঘ এক যুগ পর চট্টগ্রাম বন্দরে এসব সরঞ্জাম সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যান্ত্রিক সরঞ্জামাদি কেনা সম্পন্ন হলে বন্দরে যন্ত্রপাতির ঘাটতি পুঁজি করে দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের পদে পদে হয়রানি এবং নগদ ঘুষ বকশিশ স্পিডমানির কাজ-কারবার অনেকটা কমে আসবে, এমনটি আশাবাদ পোর্ট-শিপিং-কাস্টমস খাতের ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তা তথা বন্দর ব্যবহারকারীদের। সেইসাথে বাড়বে বন্দরের সক্ষমতা।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে ক্রমবর্ধমান কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের চাপ ও চাহিদা সামনে রেখে বর্ধিত পরিমাণে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম সংগ্রহের জন্য এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। প্রধান সমুদ্র বন্দরের গত ১৫ বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বার্ষিক ১২ থেকে ১৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং। দেশের মোট আমদানি-রফতানি প্রবাহের ৯০ শতাংশই সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। প্রধান এই বন্দরকে ঘিরে প্রত্যক্ষ রাজস্ব আহরণ করা হয় বছরে ২২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বন্দর কর্তৃপক্ষের বোর্ড সদস্য (প্রশাসন) মো. জাফর আলম জানান, আগামী ২০২০ সাল নাগাদ চট্টগ্রাম বন্দরে বার্ষিক অন্ততপক্ষে ২৯ লাখ টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করতে হবে। এই লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের উপযোগী ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হচ্ছে। আগামী ১ থেকে ২ মাসের মধ্যে যান্ত্রিক সরঞ্জামের ক্রয় প্রক্রিয়া শুরু করার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। অত্যাধুনিক ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম সংযোজিত হলে চট্টগ্রাম বন্দরের গতিশীলতা, সক্ষমতা ও সার্বিক উৎপাদনশীলতা আরও বৃদ্ধি পাবে।
বিগত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে ২১ লাখ ৮৯ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছে। এর পরিমাণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবহন ব্যয় ও খরচ সাশ্রয়ের জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কন্টেইনার শিপিংয়ের কদর বা চাহিদা বাড়ছে ক্রমাগত। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে গত ১২ বছরে উল্লেখযোগ্য ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম সংগ্রহ না হওয়ার কারণে বিশেষ করে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রমে নানামুখী সমস্যা বিরাজ করছে। এবারের ভারী যন্ত্রপাতি সংগ্রহের প্রকল্পে ১০টি কী গ্যানট্রি ক্রেন (এর মধ্যে ৬টি নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল- এনসিটি’র জন্য), রাবার টায়ারড গ্যানট্রি ক্রেন, স্ট্র্যাডল ক্যারিয়ারসহ ৬১ ধরনের সরঞ্জাম কেনা হচ্ছে। এতে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ১২০ কোটি টাকা। চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি ও এফবিসিসিআই’র সহ-সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের উপযোগী ভারী ইকুইপমেন্টের ঘাটতি দীর্ঘদিনের। পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হলে কন্টেইনার ওঠানামায় ধীরগতির সমস্যা নিরসন হবে। পণ্য খালাস ও ওঠানামা গতিশীল হবে। বন্দরের ব্যয় কমবে এবং বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। রফতানি কার্যক্রম দ্রুতায়িত হবে। অবিলম্বে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। কেননা বন্দরে ধীর গতি ও ব্যয় বৃদ্ধি পেলে এর খেসারত দিতে হয় ভোক্তাসাধারণকেই।
ঘুষ বকশিশ হয়রানি
চট্টগ্রাম বন্দরে দীর্ঘদিন ধরে কন্টেইনার ও খোলা কার্গো হ্যন্ডলিংয়ের জন্য ভারী ইকুইপমেন্টস তথা যান্ত্রিক সরঞ্জামের ঘাটতি বিরাজ করছে। এর ফলে কমে গেছে বন্দরের যান্ত্রিক ‘বল’ তথা দক্ষতা ও সক্ষমতা। পণ্য খালাস, শিপমেন্ট, স্টেক-মজুদ করাসহ কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের দৈনন্দিন কাজ ব্যাহত হচ্ছে। সময় ও অর্থের অপচয় বেড়েছে। বেড়ে চলেছে বন্দর-ব্যয়ও। এর সাথে বন্দরের দক্ষতার বিষয়টিও সম্পর্কিত। সেই সাথে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় যান্ত্রিক সরঞ্জামের ঘাটতি পুঁজি করে প্রতিনিয়তই দুর্নীতি, অনিয়ম ও হয়রানির অভিযোগ করে আসছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। যান্ত্রিক ঘাটতি বা পুরনো জরাজীর্ণ যান্ত্রিক সমস্যার অজুহাতে ব্যাপক হারে নগদ ঘুষ, কথিত বকশিশ ও ‘স্পিডমানি’র কাজ-কারবার চলে আসছিল। চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন শত শত কোটি টাকা মূল্যের আমদানিকৃত ও রফতানিমুখী মালামাল হ্যান্ডলিং করা হয়। বন্দরে বার্ষিক ২১ লাখ ৮৯ হাজার টিইইউএস (২০ ফুট সাইজের প্রতি ইউনিট) কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হচ্ছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের চাহিদা অনুপাতে ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম খুবই অপ্রতুল। বর্তমানে এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা মূল্যের ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জামের ঘাটতি রয়েছে। কারিগরি হিসাবে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জামের ঘাটতি বিরাজ করছে। গত বছরের অক্টোবরে এক কিলোমিটার দীর্ঘ ৫টি জেটি-বার্থ সমন্বিত বহুল আলোচিত ও সর্ববৃহৎ কন্টেইনার স্থাপনা নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পুরোদমে চালু হওয়ায় বন্দরে ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জামের আরও বেশি প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। তাছাড়া পুরনো জেটি-বার্থ, ইয়ার্ড, শেডগুলোতে কন্টেইনারজাত এবং খোলা সাধারণ (ব্রেক বাল্ক) কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের উপযোগী যান্ত্রিক সরঞ্জামের প্রাপ্যতা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম রয়েছে।
বন্দর ব্যবহারকারীরা জানান, চট্টগ্রাম বন্দরে বিভিন্ন ধরনের ইকুইপমেন্ট ব্যবহারের চাহিদা অনুপাতে স্থাপনাভেদে শতকরা ৩০ থেকে ৭০ ভাগ পর্যন্ত যোগান বা প্রাপ্যতায় ঘাটতি রয়েছে। বন্দরে ইকুইপমেন্ট ঘাটতি গড়ে অর্ধেকেরও বেশি। এই ঘাটতি বা সীমাবদ্ধতার দিকটি বন্দরের দক্ষতার উপর স্বভাবতই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রতিবেশী বন্দরসমূহের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরকে সত্যিকার অর্থে প্রতিযোগী করে তুলতে এমনকি সমান্তরালে দাঁড় করাতে হলে বন্দরের যান্ত্রিক সরঞ্জামের সংকট ও সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে তোলা ছাড়া বিকল্প নেই। আগামী ১০ বছরে দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী পণ্যসামগ্রী হ্যান্ডলিংয়ের প্রবৃদ্ধির যে ধারা বজায় রয়েছে তা অনায়াসে সামাল দেয়ার জন্য কাছাকাছি সক্ষমতা রয়েছে প্রধান এ সমুদ্রবন্দরের। তবে এক্ষেত্রে বড় সমস্যা ভারী যন্ত্রপাতির।
বন্দরে ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জামের ঘাটতির বিষয়টি ঘুষ-বকশিশ, স্পিডমানি, দুর্নীতি এবং হয়রানির বাহনে পরিণত হয়েছে। কখনও যান্ত্রিক উপকরণের ঘাটতি, কখনও সেগুলো পুরনো, জরাজীর্ণ অবস্থায় বিকল হয়ে পড়া, কখনওবা বৃষ্টিপাতের অজুহাতে সুযোগ বুঝে একশ্রেণীর অপারেটর, কর্মকর্তা-কর্মচারী ঘুষ-বকশিশ এবং দ্রুতগতিতে কাজ আদায়ের ‘শর্ত’ হিসেবে ‘স্পিডমানি’ উশুল করে নিচ্ছে বেপরোয়াভাবে। যান্ত্রিক বিভাগের পুরনো সেই দুর্নীতিবাজ চক্রের জন্য তা যেন ‘সুদিন’। হরেক কায়দা কৌশলে জিম্মি করা হচ্ছে আমদানি-রফতানিকারক, কনসাইনি, ব্যবসায়ীদের। কন্টেইনারসহ খোলা, কার্গো ওঠানামা, সরানো, স্টেকিং কিংবা মজুদ রাখার ক্ষেত্রে ‘বিশেষ সুবিধা’ প্রদানসহ হরেক কাজের বিনিময়ে সিডিউলে নির্ধারিত চার্জের বাইরে মোটা অঙ্কের ঘুষ-বকশিশ আর ‘স্পিডমানি’র অবৈধ লেনদেন চলছে। সুযোগ বুঝে কোথাও প্রকাশ্যে কোথাও আড়ালে আবডালে অর্থ হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি, সিসিটি, জেসিবি মিলিয়ে রয়েছে ১৯টি জেটি-বার্থ। এরমধ্যে ১১টিতে আছে শ্যোর হ্যান্ডলিং ক্রেন। কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য সর্বাধুনিক প্রযুক্তির (৫০ টনী) শিপ টু শ্যোর কী-গ্যানট্রি ক্রেন (এসএসজি) রয়েছে ৪টি। ৪০ টনী রাবার টায়ারড গ্যানট্রি ক্রেন (আরটিজি) রয়েছে ১১টি। রেললাইনের সংযোগ আছে ৫টি জেটির সঙ্গে। বন্দরে ১০টি ট্রানজিট শেড রয়েছে। ভারী, মাঝারি ও ছোট আকৃতি ও অনুরূপ শক্তিসম্পন্ন বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক উপকরণের ঘাটতির কারণে কন্টেইনারসহ দৈনন্দিন কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। সময়ক্ষেপণ, হয়রানি, আর্থিক অপচয় ও বন্দর-ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। জোড়াতালি দিয়ে ঘাটতি সামালের চেষ্টা চলে।
জাহাজ থেকে কন্টেইনার খালাস, ওঠানামা, স্থানান্তর, মজুদের উপযোগী যান্ত্রিক সরঞ্জামের উল্লেখযোগ্য ঘাটতিতে রয়েছেÑকী গ্যানট্রি ক্রেন, রাবার টায়ারড গ্যানট্রি ক্রেন, সার্র্বক্ষণিক কন্টেইনার হ্যান্ডলিং কাজে অপরিহার্য (ফোর হাইটের ৪০ টনী) স্ট্র্যাডল ক্যারিয়ার, ৭ টন থেকে ৪৫ টনী রীচ স্টেকার, ৪০-৪৫ টনী স্ট্র্যাডল ক্যারিয়ার, ১৬ থেকে ৪২ টনী ফর্ক লিফট, ফর্ক লিফট ¯েপ্রডার, কনটেইনার মুভার, এম্পটি হ্যান্ডলার ফর্কলিফট, টার্মিনাল ট্রাক্টর, ট্রেইলর। ২-৩ টনী শ্যোর ক্রেন, ৫০ টনী মোবাইল ক্রেন, ২০ টনী মোবাইল ক্রেন, ১০ টনী মোবাইল ক্রেন, ১০ টনী লগ হ্যান্ডলার, ৫ টনী ফর্ক লিফট, ৫ টনী লো মাস্ট ফর্ক লিফট, ৩ টনী ফর্ক লিফট, ২৫ টনী ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাক্টর, ২৫ টনী হেভি ট্রেইলর ও লাইট ট্রেইলর।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম বন্দরে ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম সংগ্রহের উদ্যোগ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ