পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
মধ্যযুগে ধর্মীয় স্থাপত্য নিদর্শনগুলোর মধ্যে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ অন্যতম। নদীমাতৃক পলিমাটির নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে এই ঐতিহাসিক মসজিদটিকে। এটি বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন, আহমাদ আলী পাটওয়ারী ওয়াকফ এস্টেটের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। কালের বিবর্তনে মসজিদটি ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। অনন্য প্রতিষ্ঠানটি আল্লাহর অলীগণের রুহানী ফয়েজ ও বরকতে শিরক-বিদাত মুক্ত এবাদতের মারকাজ হিসেবে খ্যাত। হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদের কারামত ও ফয়েজ-বরকতে পূণ্যভ‚মি হাজীগঞ্জ আজ ধন্য এবং গৌরবান্বিত।
বাংলায় মুসলমানদের আগমন ও মুসলিম শাসন শুরু শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বহুমাত্রিক পরিবর্তন আনে। স্থানীয় মুসলমানদের সঙ্গে বহিরাগত মুসলমান তথা আরব, পারস্য ও আফগানদের জীবন উপাদানের সমন্বয়ের ফলে সব ক্ষেত্রে ভারতীয় মুসলিম নামে পরিবর্তনের সূচনা হয়। এ সময় অনেক উপাদানের সঙ্গে স্থাপত্যশিল্পের যে বিকাশ সাধিত হয়, তা মূলত মুসলমানরা নিয়ে এসেছিলেন ধর্মীয় প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতি রাখতে। বিশেষ করে, সে সময় মুসলমানরা ইমারত নির্মাণের ক্ষেত্রে কাঠামো পরিকল্পনার সঙ্গে যে নির্মাণশৈলী ফুটিয়ে তুলেছেন তাতে ভারতীয়দের কোনো পরিচয় ছিল না।
হাজীগঞ্জ বাজারের প্রবীন ব্যবসায়ী হাজী তফাজ্জল মীর দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ঐতিহাসিক এই মসজিদটি নির্মাণের একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এ মসজিদের সমৃদ্ধ ইতিহাসের অংশ হচ্ছে বাংলা ১১৭৫ থেকে ১২০০ সালের মধ্যে হযরত মকিম উদ্দিন (রহ.) নামে একজন বুজুর্গ ওলিয়ে কামেল ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে পবিত্র আরব ভ‚মি থেকে অত্র এলাকায় আগমন করেছিলেন।
মূলত এ এলাকায় হাজি মকিমউদ্দিন (রহ.) ইসলাম ধর্ম প্রচারের মাধ্যমে ইসলামের আবাদ করেন। তারই বংশের শেষ পুরুষ হযরত মনিরুদ্দিন হাজি ওরফে মনাই হাজি (রহ.)-এর দৌহিত্র আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রহ.) বাংলা ১৩২৫ থেকে ১৩৩০ সালের দিকে বড় মসজিদের মেহরাব বা ততসংলগ্ন স্থানজুড়ে প্রথমে একচালা খড়ের ইবাদতখানা, অতঃপর খড় ও গোলপাতা দিয়ে তৈরি দোচালা মসজিদ নির্মাণ করেন।
তফাজ্জল মীর বলেন, ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের ১৭ আশ্বিন আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রহ.)-এর পরম ইচ্ছায় হযরত মাওলানা আবুল ফারাহ জৈনপুরী (রহ.)-এর পবিত্র হাতে পাকা মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ এ অঞ্চলের অন্যতম মুসলিম নিদর্শন হিসেবে পরিচিত। মসজিদটি নির্মাণকালে স্থাপত্য শিল্পের যে নির্মাণশৈলী দেয়া হয়েছে, তা যেন স্থাপত্যশিল্পেরই বিশুদ্ধ ব্যাকরণ।
হযরত মাওলানা আবুল ফারাহ জৈনপুরী (রহ.) ভারী শরীর নিয়ে মাচার ওপর বসেন, তার হাতে চুন-সুরকির মসলা কেটে মেহরাবসংলগ্ন দেয়াল ঘুরিয়ে মসজিদের প্রথম অংশের ওপরের দিকে ‘সুরা ইয়াছিন’ ও ‘সুরা জুমআ’ লিপিবদ্ধ করেন। বর্তমান সময়ে সংস্কারকালে তা উঠিয়ে মসজিদের কবরস্থানে দাফন করা হয়।
মাঝের অংশটি ৭৭টি আকর্ষণীয় পিলার ও ঝিনুকের মোজাইক দিয়ে নির্মিত হয়েছিল। তৃতীয় অংশটিতে রয়েছে তিনটি বিশাল গম্বুজসহ আকর্ষণীয় বিশাল সুউচ্চ মিনার। ১৯৫৩ সালে ১২৮ ফুট উঁচু এই মিনারটি তৈরি হয়েছিল। সুউচ্চ এই মিনারটিরও আলাদা একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর তা হলো মসজিদের প্রধান প্রবেশদ্বারের ওপর এত উঁচু মিনারের উপস্থিতি সেকালের নির্মাণ বিষয়টিকে ভাবিয়ে তোলে। মিনারের উঁচু প্ল্যাটফর্মে বহু মুসলিম ও পর্যটক উঠে হাজীগঞ্জের চারপাশের দৃশ্য অবলোকন করেন। পাথরের সাজে সজ্জিত অসংখ্য তারকাখচিত তিনটি বড় বড় গম্বুজ পর্যটকদের আকর্ষণ করে। মসজিদটি পবিত্র রমজান মাসে জুমাতুল বিদার জামাতের জন্য প্রসিদ্ধ রয়েছে।
এই মসজিদে শুভাগমন করেছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নবাব মোশারফ হোসেন ও নওয়াবজাদা খাজা নসরুল্লাহ প্রমুখ। এছাড়াও পরবর্তী সময়ে হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদে শুভাগমন করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ অনেক ব্যক্তিবর্গ।
তাছাড়াও শায়খুল ইসলাম আল্লামা হোসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.), আল্লামা আবুল ফারাহ জৈনপুরী (রহ.), আল্লামা জাফর আহমদ উসমানী (রহ.), আল্লামা আতহার আলী (রহ.), আল্লামা এহতেশামুল হক থানভী (রহ.)সহ আরও বহু হক্কানী পীর মাশায়েখ এবং শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরাম ও বুজুর্গানে দ্বীন। কারুকার্যখচিত মসজিদের সর্বশেষ পূর্ব প্রাচীরে পবিত্র কালেমা শরীফ খচিত চিনা বাসনের টুকরো দিয়ে তৈরি মনোরম ফুলের ঝাড়ের ন্যায় আকর্ষণীয় করে সাজানো বিশাল ফটক। তারকাখচিত তিনটি বড় বড় গম্বুজ পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
মসজিদসংলগ্ন জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে মাদরাসা ও এতিমখানা। মাদরাসাগুলোতে আবাসিক ও অনাবাসিক উভয় প্রকার শিক্ষার্থীদের শিক্ষা অর্জনের সুযোগ রয়েছে। দরিদ্র, এতিম, দুস্থ ও অসহায় শিক্ষার্থীরা দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। বর্তমানে আহমাদ আলী (রহ.)’র সুযোগ্য নাতি প্রিন্সিপাল ড. মো. আলমগীর কবির পাটওয়ারী নিষ্ঠার সাথে অর্পিত পবিত্র দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।