Inqilab Logo

বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ১৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

প্যারিস শো’তে টুপলেভ টিইউ-১৪৪ বিমানের রহস্যজনক দুর্ঘটনা

প্রকাশের সময় : ১২ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : ১৯৭৩ সালের জুন মাস। প্যারিসের লে বুর্জে এয়ার শো। সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক বিমান প্রদর্শনী।
বিমান নির্মাণে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি করায়ত্ত্ব যেসব দেশের আমেরিকান, সোভিয়েত রুশ, পশ্চিম ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ, তারা সবাই এখানে হাজির তাদের নিজ নিজ বিমান নিয়ে। উদ্দেশ্য সামরিক এবং বেসামরিক ক্রেতাদের কাছে বিমান বিক্রি করা।
১৯৭৩ সালের প্যারিস এয়ার শোর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল দুটি যাত্রীবাহী জেট বিমান। দুটি বিমানই শব্দের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে উড়তে পারতো।
এর মধ্যে একটি হচ্ছে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের যৌথভাবে তৈরি কনকর্ড।
আর এর প্রতিদ্বন্দ্বী যে বিমানটি, পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম তাকে ডাকতো কনকর্ডস্কি নামে।
সোভিয়েত রাশিয়ার তৈরি এই বিমানটির আসল নাম ছিল টুপলেভ টিইউ-১৪৪।
প্যারিস এয়ার শো’তে সেদিন উপস্থিত ছিল তিন লক্ষ দর্শক। তাদেরই একজন ছিলেন ব্রিটিশ টেস্ট পাইলট জন ফার্লে।
তিনি সেদিন নিজের বিমান ওড়ানো শেষ করে আকাশে অন্য বিমানগুলির খেলা দেখছিলেন। আর ঠিক তখনই টিইউ-১৪৪ তে শুরু হলো দুর্যোগ।
জন ফার্লে বলছিলেন, বিমানটি খাড়া আকাশে উঠে যাচ্ছিল। এরপর হঠাৎ করেই বিমানের নাক নেমে গেল একেবারে নীচের দিকে। যারা বিমান চালাতে পারেন, তারা জানেন এমনটি হওয়ার কথা নয়।
“টিইউ-১৪৪ কে নীচের দিকে নামতে দেখে আমার মুখ দিয়ে উহ্ করে শব্দ বের হয়ে এল। বিমনাটি হঠাৎ নীচের দিকে পড়ে যেতে শুরু করলো। আপনি যদি এয়ার শো ডিসপ্লে পাইলট হন, তাহলে এই পর্যায়ে এসে আপনি বুঝতে পারতেন যে বিমানটিতে গুরুতর কোন সমস্যা দেখা দিয়েছে।”
কয়েক সেকেন্ড পর বিমান বন্দরের উল্টোদিকে টিইউ-১৪৪ বিধ্বস্ত হয়। আকাশে থাকতেই বিমানটি বিস্ফোরিত হয়ে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়তে থাকে। লে বুর্জে বিমান বন্দর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটি গ্রামের ওপর বিমানের ধ্বংসাবশেষ আছড়ে পড়ে। এই ঘটনায় বিমানের ছয়জন ক্রুর সবাই নিহত হয়।
যে গ্রামের ওপর বিমানটি বিধ্বস্ত হয় সেখানকার আটজন বাসিন্দা প্রাণ হারায়, যার মধ্যে ছিল তিনটি শিশু। এই বিয়োগান্ত ঘটনার মধ্য দিয়েই সেদিন কনকর্ড এবং টিইউ-১৪৪ এর মধ্যে প্রতিযোগিতার অবসান ঘটেছিল।
জন ফার্লে বলেন, যারা ১৯৭৩ সালের প্যারিস এয়ার শো’র দর্শক ছিল, তাদের সামনে ছিল দুটি সুপারসোনিক যাত্রীবাহী বিমানের মধ্যে লড়াই। দুটি কোম্পানিই বিমানগুলো বিক্রি করার জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছিল। তারা যেমন ভূমিতে প্রতিযোগিতায় নেমেছিল, তেমনি আকাশেও তারা একে অন্যকে টেক্কা মারতে চাইছিল। তারা দেখাতে চাইছিল ঐ প্রদর্শনীতে কে সবচেয়ে ভাল শো দেখাতে পারে।
শব্দের চেয়েও দ্রুতগতির যাত্রীবাহী বিমান নির্মাণের প্রতিযোগিতা চলছিল প্রায় দু’দশক ধরে। মনে করা হতো এই প্রতিযোগিতায় যে জিতবে, পুরো আকাশ থাকবে তার হাতের মুঠোয়।
“প্রত্যেক ভাল এয়ারক্রাফ্ট ইঞ্জিনিয়ারই চায়, সে এমন এক বিমান তৈরি করবে যা গতির দিক থেকে অন্য বিমানকে হার মানাতে পারবে। সুতরাং, শব্দের চেয়েও দ্রুতগতির বিমান তৈরি করতে পারলে তা হবে এক অন্যান্য ঘটনা, নয়কি? তাহলে ইউরোপ থেকে আমেরিকায় যাত্রার সময়ও অর্ধেক হয়ে যাবে।”
এই প্রতিযোগিতায় সোভিয়েত রাশিয়াই কিন্তু বিজয়ী হয়। তাদের বিমানের প্রটোটাইপ মডেল তারা অ্যাঙলো-ফরাসিদের চেয়েও আগে আকাশে ওড়াতে সক্ষম হয়।
ঐ সময়টাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে শীতল যুদ্ধ ছিল তুঙ্গে।
লৌহ যবনিকার বাইরে ব্রিটেনে জোর গুজব ছিল যে কনকর্ডের নকশা চুরি করার জন্য রুশ গুপ্তচর লেলিয়ে দিয়েছে। এবং চুরি করা তথ্য দিয়েই তারা টিইউ-১৪৪ বিমানটি তৈরি করেছে।
“বিমানটির কনকর্ডস্কি নাম দেয়া হয়েছিল, কারণ সাংবাদিকরা টিইউ-১৪৪-এর সাথে কনকর্ডের ভীষণ মিল খুঁজে পেয়েছিল। সেই একই রকম তীক্ষè নাক। তবে আমি বলবো কারিগরী দিক থেকে এই মিল কোন বড় ব্যাপার না। কিন্তু লোকে বলতে তাকে এই মিল হয়েছে কারণ তারা নকশা চুরি করেছে। আর নকশা চুরি মানে হলো আমাদের কোম্পানিতে নিশ্চই সোভিয়েত স্পাই রয়েছে। তবে আমার মনে হয় এই সন্দেহ সত্যি ছিল না।”
পশ্চিমা দুনিয়ায় টিইউ-১৪৪-কে খুব কাছে থেকে হাতে গোনা যে ক’জন লোক খুঁটিয়ে দেখতে পেরেছিল, জন ফার্লে ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। দুর্ঘটনার এক বছর আগেই ১৯৭২ সালে হ্যানোভার এয়ারশো’তে তিনি প্রথম বিমানটিকে সামনা সামনি দেখেন।
“আমি সেখানে গিয়ে দেখলাম বিমানটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি ঘুরে ফিরে বিমানটিকে দেখলাম। এমন সময় আমার দিকে এক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। তিনি নিখুঁত ইংরেজিতে কথা বলছিলেন।”
“আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি বিমানটিকে দেখতে চাই কি না। সে ছিল টুপোলেভের টেস্ট পাইলট। আমিও তাকে বললাম যে আমি একজন টেস্ট পাইলট। তিনি আমাকে পুরো বিমানটি ঘুরিয়ে দেখালেন। এরপর বেশ কয়েকদিন ধরে আমরা কথা বলি। সে তাদের বিমান দেখায়। আমি আমাদের বিমান দেখাই। আমাদের সময়টা ভাল কেটেছিল।”
টুপোলেভ বিমানের সেই টেস্ট পাইলটের নাম ছিল ভ্যালেরি মলচানভ। রুশ নিউজ রিলগুলোতে তাকে দেখা যেতো বিমানের ককপিটে।
“পরে জানা গেল প্যারিসে দুর্ঘটনায় পড়া রুশ বিমানের ককপিটেও ছিলেন ভ্যালেরি মল্চানভ। এর পর আমাদের মধ্যে আর কোন কথা হয়নি। হ্যানোভার এয়ার শো’ পর আমাদের মধ্যে আর দেখাও হয়নি। এটা আমারা আশাও করতাম না। কারণ শীতল যুদ্ধের মধ্যে একজন রুশ টেস্ট পাইলট ব্রিটিশ এয়ারক্র্যাফ্ট কোম্পানির একজন কর্মচারির সাথে চিঠি চালাচালি করবে এটা কেউ কল্পনাও করতে পারতো না।”
তাহলে টুপলেভ টিইউ-১৪৪ বিধ্বস্ত হওয়ার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? জন ফার্লে কী মনে করেন?
তিনি বলেন, ঐ দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে বাজারে অনেক গুজব ছিল। সরকারিভাবে রুশরা যে ব্যাখ্যা দিয়েছিল, ফরাসিরা তাকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু কেউ সেটা বিশ্বাস করেনি।
তাদের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছিল, এয়ার শো’তে ছবি তোলার জন্য টুপোলেভের ককপিটে একজন ফটোগ্রাফার ছিল। সে হঠাৎ করে পিছলে সামনের দিকে পড়ে যায়। তার ধাক্কাতেই বিমানটির নিয়ন্ত্রণ নষ্ট হয়ে যায়।
“রুশটা এই ব্যাখ্যা তৈরি করছিল, কারণ এতে প্রমাণ করা যেত যে বিমানের মেশিনে কোন সমস্যার জন্য এই দুর্ঘটনা ঘটেনি।”
তবে জন ফার্লে মনে করেন এই বিমান দুর্ঘটনায় ফরাসি গোয়েন্দাদের একটা ভূমিকা থাকতে পারে।
“এই এয়ার শো’র নিয়ন্ত্রণ ছিল ফরাসিদের হাতে। তারা টিইউ-১৪৪ সম্পর্কে যতটা সম্ভব তথ্য জানতে চাইছিল। আমরা পরে জানতে পারি যে টুপলেভ বিমানটি যখন আকাশে ওড়ে তখন ঠিক তার কয়েক হাজার ফুট ওপর দিয়ে ঘোরাফেরা করছিল একটি ফরাসি গোয়েন্দা মিরাজ বিমান। তার একটি বিশেষ লক্ষ্য ছিল টিইউ-১৪৪-এর ম্যানুভারিং কৌশলগুলো রেকর্ড করে রাখা।”
“টিইউ-১৪৪-এর পাইলটরা সম্ভবত বুঝতেই পারেননি যে তাদের মাথার ওপর আরেকটি বিমান উড়ছিল। আমার মনে হয় দুর্ঘটনার জন্য এটাই ছিল মূল কারণ।”
“সম্ভবত গোয়েন্দা বিমানটি টুপলেভের পাইলটেদের নজরে আসার পর, সেক্ষেত্রে পাইলটরা সাধারণত যা করেন, টুপোলেভের পাইলটরা ঠিক তাই করেছিলেন। বিমান প্রদর্শনীতে পাইলটরা যখন দেখেন যে আরেকটি বিমান কাছাকাছি চলে এসেছে, তখন তারা ওপরে ওঠা বন্ধ করে দেন এবং অন্য বিমানটির তলা দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। গোয়েন্দা বিমানটি আমি নিজের চোখে দেখিনি। কিন্তু সে সময় সেখানে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই সেটি দেখেছেন।”
এই বিমান দুঘটনার পর সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেতর থেকে টুপোলেভ টিইউ-১৪৪ সম্পর্কে আর কিছু শোনা যায়নি।
১৯৯০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক যৌথ গবেষণার অংশ হিসেবে এটি আরেকবার আকাশে উড়েছিল।
কিন্তু যাত্রীবাহী বিমান হিসেবে এর ব্যবহার ১৯৭৮ সালেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সূত্র : বিবিসি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্যারিস শো’তে টুপলেভ টিইউ-১৪৪ বিমানের রহস্যজনক দুর্ঘটনা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ