Inqilab Logo

সোমবার, ০৮ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়সহ ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নজরদারীতে

প্রকাশের সময় : ১১ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৪৮ পিএম, ১০ জুলাই, ২০১৬

জঙ্গি দমনে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে -স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
কোন শিক্ষার্থী টানা ১০ দিন অনুপস্থিত থাকলে সরকারকে জানাতে হবে -শিক্ষামন্ত্রী
স্টাফ রিপোর্টার : মাদ্রাসা নয়, নামী-দামী ইংলিশ মিডিয়াম ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বের হচ্ছে জঙ্গি। এমনটি দাবী করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। বিশেষ করে ধনাঢ্য পরিবারের একশ্রেণীর শিক্ষার্থী বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গি সংগঠনের সাথে। গুলশান ও কিশোরগঞ্জের জঙ্গি হামলার সাথে জড়িতদের সম্পর্কে তদন্ত করতে গিয়ে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। আর এসব কারণেই সরকার বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গোয়েন্দা নজরদারি ও মনিটরিং শুরু করেছে। এ ব্যাপারে গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, কোনো শিক্ষার্থী টানা ১০ দিন অনুপস্থিত থাকলে সরকারকে জানাতে হবে। এ ব্যাপারে গতকালই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
গতকাল রোববার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে এক সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি অফিস আদেশও জারি করে। ওই আদেশে বলা হয়, কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টানা দশ দিনের বেশি শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকলে তার তালিকা করে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে হবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকে।
এদিকে গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ও ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্কলাস্টিকা ও অন্যান্য বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের জঙ্গি বা সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। আগেও এর তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি জঙ্গিদের বিভিন্ন বিষয় তদন্ত করতে গিয়ে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। সমাজের ধনী ও প্রতিষ্ঠিত এবং সরকারী দলের কতিপয় নেতার ছেলেও ভয়ঙ্কর জঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই বেশ কয়টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ধনী পরিবারের সন্তানেরা জঙ্গি কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে তা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করছে।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে জড়িতরা প্রায় সবাই প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র। এর আগে কিছু অপরাধীকে আমরা চিহ্নিত করেছি তারাও প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে। তিনি বলেন, এখন থেকে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ও তাদের শিক্ষার্থীদের নজরদারি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, জঙ্গি দমনে বেশ কিছু বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরদারি করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে অভিভাবকদেরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। তাঁদের সন্তান কোথায় যায়, কি করে এর খোঁজ-খবর তাদের রাখতে হবে।  
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, দারুল ইহসানসহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নজরদারি করা হচ্ছে। শুধু শিক্ষার্থীরা না মোটিভেটেড করার ক্ষেত্রে শিক্ষকরাও জড়িত থাকতে পারেন, তাই তারাও এর আওতার মধ্যে থাকবেন। পাশাপাশি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মালিক কে? অর্থের যোগানদাতা কারা? ট্রাস্টিবোর্ড বা মালিক পক্ষে কারা রয়েছেন? প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তারা কোন আদর্শের ? কোথায় লেখাপড়া করেছেন? এ বিষয়গুলোও খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে।
কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে হামলার ঘটনায় হামলাকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের গুলি বিনিময়ের সময় যিনি মারা গেছে তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসইউ) বিবিএ শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী আবির রহমান (২১)। ২০১০ সালে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল টিউটোরিয়াল থেকে এ লেভেল পাস করেন তিনি। কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার সিরাজুল ইসলামের ছেলে আবির আট মাস ধরে নিখোঁজ এবং নিখোঁজ হওয়ার আগে সে রাজধানী বসুন্ধরা এলাকায় বসবাস করতো বলে পরিবার দাবী করছে।
গুলশানে হামলাকারীদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর কমিটির যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক ইমতিয়াজ খান বাবুলের ছেলে রোহান ইমতিয়াজ অন্যতম। সেনাবাহিনী পরিচালিত অপারেশন ‘থান্ডারবোল্ট’ এ নিহত হওয়ার পর পুলিশ রোহানের ছবি প্রকাশ করে। পরে কথিত আইএস’র বরাত দিয়ে সাইট ইন্টেলিজেন্সও তার ছবি প্রকাশ করে। সে ঢাকার নামকরা স্কলাসটিকা স্কুলে ও-লেভেলে অত্যন্ত ভালো ফল করে। পরে বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। ছয় মাস আগে গত ডিসেম্বরের ৩০ তারিখ থেকে রোহান নিখোঁজ হয়।
মীর সামিহ মোবাশ্বির, তার বাবা একটি টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানির এক্সিকিউটিভ মীর হায়াত কবীর। মোবাশ্বির স্কলাসটিকা স্কুল থেকে সম্প্রতি ও-লেভেল সম্পন্ন করে। এ-লেভেলে ভর্তি হওয়ার জন্য সে গুলশানের এমিনেন্স কোচিং সেন্টারসহ দুটি কোচিং সেন্টারে পড়ছিল। পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক ক্লাসে অংশ নেওয়ার কথা বলে সে বেরিয়ে যায় গত ২৯ ফেব্রুয়ারি।
নির্বাস ইসলাম নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। নির্বাস অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক মোনাশ ইউনিভার্সিটির মালয়েশিয়া ক্যাম্পাসে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট সার্ভিসের কোষাধ্যক্ষ ছিল। পড়েছে ঢাকার ইন্টারন্যাশনাল টার্কিশ হোপ স্কুলে। ২০১৪ সালের শুরুর দিক থেকেই তার আচরণে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। পরিবার ও বাড়ির কারণ দেখিয়ে ২০১৫ সালের দিকে নির্বাস মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে যায়। এরপর থেকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে বিচরণ কমিয়ে দেন নির্বাস। সেনাবাহিনী পরিচালিত অপারেশন ‘থান্ডারবোল্ট’ এ নিহত হওয়ার পর হামলাকারী হিসেবে পুলিশ নির্বাসের ছবি প্রকাশ করে। পরে কথিত আইএস’র বরাত দিয়ে সাইট ইন্টেলিজেন্সও তার ছবি প্রকাশ করে।
এ ছাড়াও হামলার ঘটনার পর সন্ত্রাসীদের জিম্মা থেকে জীবিত ফিরে আসা হাসনাত রেজা করিম নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণে ২০১২ সালে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। হলি আর্টিসান রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি থাকাবস্থায় হাসনাতের চলাফেরা নিয়ে সন্দেহের জন্ম নেয় সবার। হামলাকারীদের সঙ্গে হাসনাতের চলাফেরার ভিডিও সেনাবাহিনীর কমান্ডোদের অভিযানের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, হাসনাত অন্য দু’জন হামলাকারীর সামনে ছাদের ওপর সিগারেট টানছিলেন। তার ছবি বিভিন্ন গণ্যমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেখান থেকে জানা যায়, কথিত জিম্মির নাম হাসনাত রেজা করিম। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির বিবিএ ফ্যাকাল্টির সাবেক শিক্ষক তিনি।
হাসনাত করিমসহ চার শিক্ষক নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে দীর্ঘদিন ধরে হিযবুত তাহরীরের কর্মকা- পরিচালনা করেন। এ ঘটনায় ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি করে। কমিটির রিপোর্টের প্রেক্ষিতে ওই চার শিক্ষককে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
ডিএমপি’র কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) বোম্ব ডিস্পোজাল টিম ও ডগ স্কোয়াডের প্রধান অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. ছানোয়ার হোসেন বলেন, স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আমরা আগে থেকেই তৎপর আছি। ২০০৯ সাল থেকে আমরা ওই ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করছি। তবে গুলশানের ঘটনার পর এ ব্যাপারটি আবার নতুন করে সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। আমরা এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে সজাগ আছি।
অন্যদিকে গুলশানে হামলার ঘটনার পর কথিত আইএসের বরাত দিয়ে বাংলাদেশী তিন তরুণের ভিডিও প্রকাশ করে সাইট ইন্টেলিজেন্স। ভিডিও’র প্রথম তরুণ সাবেক নির্বাচন কমিশনার সফিউর রহমানের ছেলে তাহমিদ রহমান শাফি। রাজধানীর উত্তরা এলাকায় তার বাড়ি। তাদের গ্রামের বাড়ি সিলেট। ২০১৪ সালের ১৮ আগস্ট ৭৫ বছর বয়সে তাহমিদের বাবা সফিউর রহমান মারা যান। তাহমিদ বাংলাদেশের বেসরকারী মোবাইল ফোন কোম্পানি গ্রামীণফোনে চাকরি করেছেন। বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত সঙ্গীত বিষয়ক রিয়েলিটি-শো ‘ক্লোজআপ ওয়ানের’ প্রথম সিজনের মাধ্যমে সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল তার। তাহমিদ নটরডেম কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেছেন। এর পর তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএতে পড়েছেন।
এরা ছাড়াও আরও অনেক তরুণ নিখোঁজ রয়েছেন। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের পরিবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে নিখোঁজদের খুঁজতে সহায়তা চেয়েছে। নিখোঁজরা হলেন, ঢাকার তেজগাঁওয়ের মোহাম্মদ বাসারুজ্জামান, বাড্ডার জুনায়েদ খান (পাসপোর্ট নম্বর- এএফ ৭৪৯৩৩৭৮), চাঁপাইনবাবগঞ্জের নজিবুল্লাহ আনসারী, ঢাকার আশরাফ মোহাম্মদ ইসলাম (পাসপোর্ট নম্বর-৫২৫৮৪১৬২৫), সিলেটের তামিম আহমেদ চৌধুরী (পাসপোর্ট নম্বর-এল ০৬৩৩৪৭৮), ঢাকার ইব্রাহীম হাসান খান (পাসপোর্ট নম্বর-এএফ ৭৪৯৩৩৭৮), লক্ষ্মীপুরের এটিএম তাজউদ্দিন (পাসপোর্ট নম্বর-এফ ০৫৮৫৫৬৮), ঢাকার ধানমন্ডির জুবায়েদুর রহিম (পাসপোর্ট নম্বর-ই ১০৪৭৭১৯), সিলেটের মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ ওজাকি (পাসপোর্ট নম্বর-টিকে ৮০৯৯৮৬০) ও জুন্নুন শিকদার (পাসপোর্ট নম্বর-বিই ০৯৪৯১৭২)। নিরাপত্তার স্বার্থে এদের পরিবারের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। এরা বেশিরভাগই বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, ইংলিশ মিডিয়াম ও অন্যান্য বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছিলেন বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়সহ ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নজরদারীতে
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ