Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যশোরে ভৈরব নদের কান্না

প্রকাশের সময় : ১১ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মিজানুর রহমান তোতা : যশোরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী ভৈরব নদ কাঁদছে আজো। কান্না থামানোর ন্যুনতম উদ্যোগ নেই। নদটি এখন পুরোপুরি মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছেছে। তবুও নদের বেদনাঘন আর্তি কারো কানে পৌছাচ্ছে না। উপরন্তু নদের বুকে ইট পাথর আর লোহার তীর বিঁধছে প্রতিনিয়ত। প্রতিযোগিতা চলছে নদ দখলের। নদটির সিংহভাগই শুকিয়ে গেছে। যতটা শুকিয়েছে ততটা হয়েছে দখল। তৈরি করা হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ঘর-বাড়ি। দখলকারীদের হাবভাবে মনে হয় তাদের পৈত্রিক সম্পত্তিতে যখন যা খুশি তাই করছে। ভৈরব নদের অদুরেই জেলা প্রশাসকের দপ্তর। কোন কর্মকর্তা একবারের জন্য উঁকি দিয়ে দেখেন না সরকারি সম্পত্তি কারা কিভাবে দখল করছে। বরং রাজস্ব বিভাগের একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে মোটা টাকা হাতিয়ে নিতে ভুল করছেন না। দখল প্রক্রিয়া চলছে বহুদিন ধরে। যখন যিনি দায়িত্বে থাকেন জবাব দেন আগের অফিসার কিভাবে কাগজপত্র করে দিয়েছেন তা তো জানা নেই। দেখতে হবে। পরে আসেন। এভাবে চলছে বছরের পর বছর ধরে। কোন স্পষ্ট জবাব কারো কাছ থেকে পাওয়া যায় না। সরকারি সম্পত্তি হিসাব সরকারি কর্মকর্তারা রাখেন না-এর বড় প্রমাণ যশোরের ভৈরব নদ। নদের দুই পাড় থেকে এমনভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে যাতে নদটির অস্তিত্ব মুছে যেতে বসেছে। ভৈরব নদ বাঁচাও আন্দোলনের নেতা যশোরের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ইকবাল কবীর জাহিদ দৈনিক ইনকিলাবকে জানালেন, যশোর জেলা প্রশাসন এ ব্যাপারে একেবারেই নির্বিকার। দেখেও না দেখার ভান করছে। যা প্রকারন্তরে দখলদারদের পক্ষে যাচ্ছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানাচ্ছি।
একসময় ভৈরব নদের ছিল ভৈরবী গর্জন। কলকল ছলছল নদী করে টলমল-অবস্থা যখন ছিল তখন নদপাড়ের বাসিন্দারা শিশু সন্তানদের সবসময় সাবধানবাণী উচ্চারণ করতেন ‘তোরা যাসনে নদের ধারে, ভৈরবের উত্তাল স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, খালি হবে বুক’। নদে তুফান এলে মানুষের বুক কাঁপতো। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে চমকে উঠতো অনেকে। আসলেই নদের হিংস্রতার কাছে হার মানতো সবাই। এখন ভৈরবের বিশাল দেহটা শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে। নদে পানি নেই। পানি আছে নদপাড়ের লোকজনের চোখে। নদের করুণদশা দেখে ভৈরবের মতো কাঁদছে মানুষও। নদীই জীবন। নদীর পানি দেশদেহের শিরা-উপশিরায় রক্তের মতো ধাবমান। কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য, মৎস্য ও ব্যবসা-বাণিজ্য, জীব-বৈচিত্র ও বনজসম্পদ এবং পরিবেশ রক্ষার নদ-নদীর কোন বিকল্প নেই। ভৈরব নদের ভৈরবী গর্জনের কথা নতুন প্রজন্মের কাছে এখন কল্পকাহিনী। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীর মধ্যে ভৈরব নদ ছিল সবচেযে গভীর। সেই ভৈরব নদ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। নদ বাঁচানোর আন্দোলনও হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে না। উপরন্তু প্রতিনিয়ত দখল হচ্ছে প্রকাশ্যেই।  যশোরের ডাকাতিয়া গ্রামের বৃদ্ধ ইজাহার আলী আক্ষেপ করে বললেন ‘ছেলেবেলায় ভৈরব নদের থৈ থৈ পানিতে সাঁতার কেটেছি, ডুব দিয়ে একুল থেকে ওকুলে গেছি। খুব আনন্দ হতো। আজ খুব কষ্ট লাগে নদের করুণ অবস্থা দেখে’। ঐহিত্যবাহী ভৈরব নদটি গঙ্গা থেকে বের হয়ে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার ভেতর দিয়ে মেহেরপুরে ঢুকেছে। মেহেরপুরের সুবলপুর পয়েন্টে মিশেছে মাথাভাঙ্গা নদীর সাথে। ভৈরব আর মাথাভাঙ্গা অভিন্ন ধারায় দর্শনা রেলস্টেশন এলাকা পর্যন্ত প্রবাহিত হয়। কিন্তু ১৮৬১ সালে শিয়ালদহ-কুষ্টিয়া রেলপথ স্থাপনের সময় ভৈরব নদ ভরাট করে মাথাভাঙ্গা নদীকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। ওই পয়েন্ট থেকে দর্শনা ও জীবননগর হয়ে ভৈরব নদ এসে মিশেছে চৌগাছার তাহেরপুরে কপোতাক্ষের সাথে। সেখান থেকে ভৈরব নদ যশোর ও শিল্পশহর নওয়াপাড়া হয়ে শিল্পনগরী খুলনা ছুঁয়ে সুন্দরবনের পশুরনদীতে গিয়ে মিশেছে। ভৈরব নদকে ঘিরেই মূলত যশোর, নওয়াপাড়া ও খুলনায় নগর, শহর ও শিল্প গড়ে ওঠে। ব্যবসা-বাণিজ্যও সম্প্রসারিত হয় ভৈরব নদকে ঘিরে। ভৈরব নদে একসময় বড় বড় জাহাজ ভিড়তো। এখন ভৈরবে নদীপথ নেই বললেই চলে। নদটির গুরুত্ব রয়েছে অনেক। অথচ শুধু যশোর এলাকা নয়, বলা যায় পুরো ভৈরব নদটি দখল করে নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ছোট ও বড় অর্ধশতাধিক নদ-নদীর মধ্যে সবচেয়ে বেশী শুকিয়ে গেছে ভৈরব নদ।  
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও হাইড্রোলজি বিভাগসহ সংশিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, ৪ শতাধিক কিলোমিটার নদপথের প্রায় ৩শ’ কিলোমিটারই শুকিয়ে গেছে। যার কোন কোন অংশে নদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। বিশেষ করে যশোর শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়ায় ভৈরব নদের প্রায় পুরোটাই অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে গেছে। কোথাও নদের পাড় পাওয়া যাবে না যেখানে দখল হয়নি। অনেকে কাগজপত্র তৈরি করে ব্যক্তি সম্পত্তি করে নিয়েছে নদের জমি। নদের প্রস্ততা কিভাবে কমে গেল কিংবা ব্যক্তি সম্পত্তি হলো কিভাবে-তার কোন তদন্ত কেউ করেনি। নদী কেন খাল হলো তার জবাবও সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পাওয়া যায় না। নদের সীমানা নির্ধারণের উদ্যোগও কখনো নেয়া হয়নি। যশোর শহর ও শহরতলীর প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকার ভৈরব নদ দখল হয়ে গেছে দিনে দিনে। অনেকস্থানে মরা নদের বুক পর্যন্ত দখল করে লোকজন পাকা বাড়ি বানাচ্ছে। চাষাবাদ করছে। দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘর নির্মাণ বন্ধে মাঝেমধ্যে অভিযান চলে ঠিকই কিন্তু তা অভিযান থেমে যাবার পরমুহূর্তে দখল হয়ে যায়। এমনকি যশোর শহরের ঘোপের বিরাট এলাকার পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ যা বড় ড্রেন হিসেবে ভৈরব নদে পড়েছে, সেই ড্রেনটিও দখল করে সেখানে বিশাল মার্কেট গড়ে তোলা হয়েছে। যশোরের এক প্রবীণ ব্যক্তি বললেন, ভৈরব নদ ছিল বিশাল চওড়া। তারা ছোটবেলায় বন্ধুদের নিয়ে নদে ঝাপিয়ে গোসল করতেন। কিভাবে যে নদ কয়েকহাত চওড়া হয়ে গেল তার জবাব জানা নেই। ভৈরব নদ দখলমুক্ত করে যশোর শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও পরিবেশ রক্ষায় ‘রিভার ভিউ’ গড়ে তোলার দাবি করা হয়েছে বহুবার। কিন্তু সরকার যায়, সরকার আসে, ভৈরব দখলমুক্ত হয় না।
একইভাবে দখল হচ্ছে ভৈরব নদের নওয়াপাড়া ও খুলনা এলাকায়। বর্তমান সরকার যশোরের কপোতাক্ষ নদ বাঁচাতে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। উদ্যোগ নেয়া হয়েছে পতমা ব্যারেজ ও গড়াইয়ে পানির রিজার্ভার গড়ে তোলার। এবার ভৈরব নদসহ মৃত নদ-নদী রক্ষায় পদক্ষেপ নিলে যশোর ও খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারবে সরকার। গত ঈদেও দিন ও পরদিন নদের পাড় ধরে খয়েরতলা, নূরপুর, ডাকাতিয়া, বোলতলা, পাগলাদাহ, নওদাগা, ঘোষপাড়া, ঘোপ, পুরাতন কসবা, দড়াটানা, বারান্দীপাড়া, নীলগঞ্জ ও বারীনগরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের সাথে কথা বলেছি। অনেকেই স্মৃতিচারণ করে বললেন ‘ভৈরব নদ এভাবে চোখের সামনে  মরে যাবে তা আগে কখনো কল্পনাও করিনি। কত যে স্মৃতি আছে ভৈরব নদকে ঘিরে তা বলে শেষ করা যাবে না।’ একজন আক্ষেপ করে বললেন, আমরা দেখি রাতারাতি দখল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশাসনের কর্মকর্তারা দেখেন না কেন। কোন সাধারণ মানুষ তো নদ দখল করেনি। যারা দখলদার তাদের  সিংহভাগই প্রভাবশালী। সেজন্য প্রশাসনের কর্মকর্তারা চোখ বন্ধ করে থাকেন। এই সুযোগে দুর্নীতিবাজরা ঢালাওভাবে সবার কাগজপত্র তৈরি করে দখলের সুবিধা করে দেয়।’ ভৈরব নদের মতো গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পদ্মার শাখা প্রশাখা নদ-নদীর অবস্থাও প্রায় একই। ভৈরব নদ বাঁচাও আন্দোলন সংশ্লিষ্ট নেতারা জানান, বহুবারই তো আন্দোলন-সংগ্রাম করলাম, স্মারকলিপি দেয়া, সভা-সমাবেশসহ অনেক কর্মসূচি পালন করেছি। সব সময় আশ্বাসই পেয়েছি। বাস্তবে কোন ফল পাইনি। সর্বশেষ প্রায় ৪শ’ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। তাও দীর্ঘদিন মন্ত্রণালয়ে আটকে আছে। ওই প্রকল্পে ভৈরব মাথাভাঙ্গার সঙ্গে যুক্ত করার কথা ছিল। এটি না হওয়ায় যশোর-খুলনার দুঃখ ভবদহ সমস্যা আরো ভয়াবহ হবে। তিনি বললেন, অবিলম্বে প্রকল্প বাস্তবায়ন, নদের দখলদার উচ্ছেদ এবং পানিকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। ভৈরব ও কপোতাক্ষসহ নদী সংস্কারের বাজেটে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। একইসাথে খাল, বিল, বাওড় ও পুকুর খনন করতে হবে। সর্বোপরি ঐতিহ্যবাহী ভৈরব নদকে মৃত্যুর হাত থেকে যে কোনভাবেই হোক বাঁচাতে হবে।



























      
















 














 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যশোরে ভৈরব নদের কান্না
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ