Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সমস্যায় জর্জরিত বিচারপতি ভবন

উদ্বোধনের ৩ বছর : উচ্চ শব্দ বৃষ্টির পানি লিফট স্বল্পতা

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

টায়ার ফাটা ও গাড়ি চলাচলের বিকট শব্দ। বৃষ্টি হলেই পানিতে সয়লাব বারান্দা ও করিডোর। আকস্মিক বিদ্যুৎ চলে গেলে কাছের কোনো ফ্লোরে লিফট থামে না। সোজা নেমে পড়ছে গ্রাউন্ড ফ্লোরে। লিফট স্বল্পতায় কখনোবা কিউ দিতে হয় লিফটের গোড়ায়। পানিতে মাত্রারিক্ত আয়রণ। এ রকম নানা সমস্যায় জর্জরিত ‘বিচারপতি ভবন’। উদ্বোধনের তিন বছর না যেতেই দেখা দিয়েছে নানা সমস্যা। ফলে বিচারপতি পরিবারের সদস্যদের আহার-নিদ্রা, চলাফেরা-অনেক কিছুতেই তৈরি হয়েছে অসুবিধা। রাজধানীর কাকরাইল অবস্থিত ২০ তলা ‘বিচারপতি ভবন’।
সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সূত্র জানায়, ৩০ তলা ভিত্তির ওপর নির্মিত ২০ তলা ‘জাজেস কমপ্লেক্স’ বা ‘বিচারপতি ভবন’। সাড়ে ৩ হাজার বর্গ ফুটের ৭৬টি ফ্ল্যাট রয়েছে ভবনে। ২০১৭ সালের ১৫ এপ্রিল ভবনটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ভবন হওয়ার কথা ছিলো এটি। এতে রয়েছে সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট সুবিধা। ভবনে প্রবেশ এবং বের হওয়ার জন্য চারপাশে রয়েছে চারটি প্রবেশদ্বার। ফ্ল্যাটে ওঠা-নামার জন্য জন্য রয়েছে তিনটি লিফট। সিঁড়ি রয়েছে তিনটি। বিচারপতিদের গাড়ি রাখার জন্য নিচ তলায় রয়েছে পার্কিং। দৃষ্টিনন্দন এ ভবন একটি হলেও চারপাশ থেকে দেখলে মনে হয় পৃথক ৪টি ভবন। ভূমিকম্প সহনীয় যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। রয়েছে অভ্যন্তরীণ পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ব্যবস্থা। একেকটি ফ্ল্যাটে রয়েছে অন্তত : ১০টি কক্ষ। বিচারপতির ব্যক্তিগত সহকারির জন্য রয়েছে একটি অফিস রুম। রায় লেখাসহ অন্যান্য কাজের জন্য রয়েছে একটি চেম্বার। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিলো ১৪১ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার টাকা। পরে সেটা বেড়ে ১৭৩ কোটি ৮৩ লাখ ৪৮ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় সূত্র জানায়, বিচার বিভাগ দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর একটি দফতর। অথচ বিচারপতিরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভাড়া বাসায় কিংবা সরকারি বাসায় বসবাস করছিলেন। এতে সরকারের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। বিচারপতিদের নিরাপত্তা, কর্মক্ষেত্রে সময় মতো যাতায়াতও নিশ্চিত করা যাচ্ছিল না। বিষয়টি আমলে নিয়ে ২০১২ সালের ৬ মার্চ বিচারপতিদের আবাসিক ভবন নির্মাণ প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ নির্বাহী কমিটির (একনেক)। একই বছরের ১৪ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ভবনের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। ২০১৩ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সময় নির্মাণ কাজ শুরু হয়। পরবর্তী প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের সময় ভবনটির নির্মাণের কাজ থমকে ছিলো। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর বিচারিক সেবার মান উন্নয়নসহ নানা উদ্যোগ নেন। এরই অংশ হিসেবে ভবনটির পুরোদমে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। দেড় একর জমিতে ৩০ তলা ভিত্তির ওপর ২০ তলা এ ভবনের নির্মাণ কাজ চলে। ২০১২ সালে প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রকল্পটি ২০১৬ সালের জুন মাসে সুপ্রিম কোর্টের কাছে হস্তান্তর করার কথা ছিল। কিন্তু সরকারি- বেসরকারি ভবনে এসটিপি স্থাপনের কারণে প্রকল্পের মেয়াদ ডিসেম্বর এবং প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যায়।
উদ্বোধন করা হয় ২০১৭ সালের মধ্য এপ্রিল। সরকারি অর্থায়নে গণপূর্ত অধিদফতর ভবনটি নির্মাণ করে। প্রকল্প পরিচালক ছিলেন গণপূর্তের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী উৎপল কুমার দে। ভবনটি নির্মাণ করে ‘দ্য সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড’।
ভবন উদ্বোধনের পর তিন বছরে ৪৭ জন বিচারপতি ভবনে উঠেছেন। আরো ৩০টি ফ্ল্যাট এখনো খালি। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে বাকিদের ফ্ল্যাটে ওঠার অনুরোধ জানানো হলেও বিচারপতিরা এখানো ওঠেননি। এর মধ্যেই একের পর এক ভবনে ধরা পড়ছে ত্রুটি-বিচ্যুতি। এসব সারাতে এখন খরচ করতে হবে অতিরিক্ত অর্থ।
হাইকোর্ট বিভাগের সিনিয়র এক বিচারপতির ব্যক্তিগত সহকারি জানান, ‘বিচারপতি ভবন’-এর ফ্ল্যাটে বসবাসের ক্ষেত্রে বড় অসুবিধা উচ্চ শব্দ। ভিআইপি এলাকা হলেও ভবনের পাশে রয়েছে প্রশস্ত রাস্তা। এখানে ২৪ ঘণ্টা গাড়ি চলাচল করে। যানজট লেগে থাকে দিনের বেশির ভাগ সময়। রাতে চলে বাস-ট্রাক ও লরি। বিশেষ করে রাত ১০টার পর শুরু হয় ভারি যানবাহন চলাচল। উচ্চ শব্দে হর্ণ বাজিয়ে সাঁ করে ছুটে চলে ট্রাক। ফলে বিচারপতি পরিবারের শিশু সদস্যরা ভয়ে ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠে। গাড়ির টায়ার ফাটার শব্দে ভড়কে যান বড়রাও। বিচারপতিদের যাপন করতে হয় রুটিন মাফিক জীবন। উচ্চ শব্দের কারণে অনেক সময় তাঁদের রাতে ঘুম হয় না। ফলে তার দৈনন্দিন কার্যক্রমেও এটির প্রভাব পড়ে।
আরেক বিচারপতির ব্যক্তিগত সহকারি জানান, ফ্ল্যাটে সরবরাহকৃত পানিতে রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত আয়রন। সরবরাহ সার্বক্ষণিক হলেও পানি আসছে বাসাবাড়িতে সরবরাহকৃত সাধারণ পাইপলাইন থেকে। বিচারপতি ভবনে পানির নিজস্ব উৎস না থাকায় পরিবারের সদস্যদের এ পানিই ব্যবহার করতে হচ্ছে। তিনি আরো জানান, বৃষ্টি হলেই পানিতে ভেসে যায় বেলকনি ও করিডোর। জানালা গলে পানি আসে। টাইলস মোড়া মেঝে পানিতে পিচ্ছিল হয়ে থাকে। যেকোনো সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা।
অসুবিধা রয়েছে লিফটেও। লিফটের স্বল্পতা রয়েছে। এছাড়া কথা ছিলো স্থাপিত লিফটগুলো বিদ্যুৎ চলে গেলেও কোনো অসুবিধা হবে না। স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটি নিকটবর্তী ফ্লোরে গিয়ে থামবে। কার্যত: হঠাৎ বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিলে লিফট চলে যাচ্ছে গ্রাউন্ড ফ্লোরে। বিদ্যুৎ এলে নিচ থেকে আবার সংশ্লিষ্ট ফ্লোরে উঠতে হয়। এতে সময় অপচয় হয়। এছাড়া ভবনটিতে বেশকিছু নির্মাণ ত্রুটি রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন বিচারপতির এই ব্যক্তিগত সহকারি।
এ বিষয়ে জানতে প্রকল্প পরিচালক উৎপল কুমার দে’র সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি। তবে বিচারপতি ভবনে বসবাসে এসব অসুবিধার কথা স্বীকার করেন হাইকোর্ট বিভাগের স্পেশাল অফিসার ও মুখপাত্র ব্যারিস্টার সাইফুর রহমান। তিনি বলেন, বেশ কিছু অসুবিধা ধরা পড়েছে ভবনের ফ্ল্যাটে বসবাসের ক্ষেত্রে। উচ্চ শব্দ, পানিতে আয়রন, লিফট স্বল্পতা এসবের অন্যতম। বিষয়টি আমরা গণপূর্ত অধিদফতরকে জানিয়েছি। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলমসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। তারা বলেছেন, আয়রনমুক্ত পানির জন্য একটি নিজস্ব পিউরিফাইং সিস্টেম স্থাপন করবেন। শব্দ নিরোধক গ্লাস লাগাবেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে লিফট স্বল্পতাও দূর করে দেবেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিচারপতি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ