Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হঠাৎ বেড়েছে চালের দাম

বাজার নয় মনিটরিং দরকার খাদ্য বিভাগের

মাহফুজুল হক আনার ও এস এম আলী আহসান পান্না | প্রকাশের সময় : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

খাদ্যে উদ্বৃত্ত দিনাজপুর ও কুষ্টিয়া জেলার চালের বাজার বেসামাল হয়ে উঠছে। কৃষক বাঁচাতে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয়, ক্রয়মূল্য বৃদ্ধিসহ সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ কৃষক এবং নিম্ন আয়ের মানুষের কোন কল্যাণেই আসছে না। ধান কর্তন ও মাড়াইয়ের সময় ধান চালের দাম থাকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। কৃষকের ঘরের ধান শেষ হওয়ার পর চালের দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। গত এক সপ্তাহে চালের দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি দেড় থেকে দু’শো টাকা। চালের দাম বৃদ্ধিতে প্রান্তিক কৃষকের পাশাপাশি নিম্ন আয়ের ভোক্তারা পড়েছেন বিপাকে।
এদিকে বরাবরের মত চালের মূল্যবৃদ্ধির দায় খুচরা বিক্রেতারা মিল মালিকদের ওপর, আর মিল মালিকরা মাঠ পর্যায়ের বিক্রেতাদের ওপর চাপিয়ে আসছেন। তবে সাম্প্রতিককালে মিল মালিকরা বাজারে ধানের দাম বৃদ্ধিকেও চালের দাম বৃদ্ধির কারন উল্লেখ করেছেন। তবে মাঠ পর্যায়ের সার্বিক চিত্র পর্যালোচনা করে খাদ্য বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তার দুর্নীতি ও মজুতদারদের ধান মজুদ চালের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার মূল কারন বলেই বাজার সংশ্লিষ্টমহল মত প্রকাশ করেন। তাদের মতে সরকারি মজুত শক্তিশালী করার মাধ্যমে মুনাফালোভী মজুদদারদের গুদাম খালি করা গেলেই ধান-চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। নইলে বরাবরের মত মিলার ও মজুতদারদের হাতেই নিয়ন্ত্রণ থেকে যাবে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক কৃষিবিদ তৌহিদুল ইকবাল জানান, এবারও দিনাজপুরে আমন আবাদ ভাল হয়েছে। এবার জেলায় আমন ধান উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ১২ লাখ মেট্রিক টন। চালের আকারে যা প্রায় ৮ লাখ মেট্রিক টন।
খাদ্য বিভাগের নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, দিনাজপুরে খাদ্য চাহিদা প্রায় সাড়ে ৪ লাখ মেট্রিক টন। বিভিন্ন খাদ্যসহ এ চাহিদা প্রায় ৬ লাখ মেট্রিক টন। এক্ষেত্রে অন্যান্য ফসলসহ খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ২০ থেকে ২২ লাখ মেট্রিক টন। এ হিসাবে দিনাজপুর জেলায় ইরি-বোরো বাদে গড়ে ৮ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য চাহিদার তুলনায় বেশি উৎপাদিত হয়। সূত্রমতে ইরি-বোরোসহ সব ফসলের ক্ষেত্রে দিনাজপুর জেলায় উদ্বৃত্ত খাদ্যের পরিমাণ প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিক টন।
আমন ধান বাজারে ওঠার সময় দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। সে সময়ে মোটা গুটিস্বর্ণা ধান বিক্রি হয় ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা মন দরে। পাশাপাশি চিকন কালোজিরা জাতের ধান বিক্রি হয় ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা মন দরে। অধিক উৎপাদনশীল হওয়ায় কৃষক মোটা অর্থাৎ গুটিস্বর্ণা ধানই বেশি আবাদ করে । এক বিঘা জমিতে গুটিস্বর্ণা ২০ থেকে ২২ মন উৎপাদন হলেও চিকন জাতের কালোজিরা উৎপাদিত হয় ৮ থেকে ৯ মন।
এছাড়া চিকন ধান আবাদে খরচ পড়ে দ্বিগুন। তবে দাম বেশি পাওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে চিকন ধান আবাদে কৃষকের আগ্রহ বেড়েছে। স্কয়ার, প্রাণসহ দেশের স্বনামধন্য বড় বড় কোম্পানি অটো মিল ভাড়া নিয়ে অথবা চুক্তিতে দিনাজপুরের কালোজিরা চাল প্যাকেট করে বাজারজাত করছে। ফলে চিকন চালের চাহিদা ক্রমশ: বাড়ছে। এছাড়াও চিকন চাল বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। তবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে মোটা চাল আমদানি বন্ধ থাকলেও চিকন চাল আমদানি হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বড় বড় কোম্পানি ভারতীয় চাল এনে প্যাকেট করে বাজারজাত করছে। ফলে দেশীয় কাটারিভোগ বা চিনিগুড়া চালের ব্রান্ডিং ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ২০ অথবা ৪০ কেজি ধান এনে বিক্রির পর পাওয়া টাকায় বাজার করতো। কিন্তু ধানকাটা-মাড়াই শেষ হওয়ার দু’মাস পর এ চিত্র আর নেই। সারাদিন জমিতে বা বাসাবাড়িতে কামলা দিয়ে প্রাপ্ত দিনমজুরীর টাকা নিয়ে বাজারে আসছে। তা দিয়ে চালসহ অন্যান্য বাজার করছে। দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ধুকুরঝাড়ী হাটে এমনই এক কৃষক হেমন্তের সাথে আলাপ হলে সে জানায়, তার নিজস্ব কোন জমি নেই। তবে বর্গা নিয়েছে প্রায় ৪ বিঘা জমি। তা থেকে যে আমন ধান পেয়েছিল তা বিক্রি করে আগের কর্জ ও ছেলে-মেয়েদের জামা কাপড় ইত্যাদি ক্রয়ে শেষ হয়ে গেছে। এখন তাকে চাল কিনে খেতে হচ্ছে। সামনে ইরি-বোরো উঠলে আবার নিজের উৎপাদিত চাল দিয়ে সংসার চলবে। সে আক্ষেপের সাথেই জানালো, যে দামে ধান বিক্রি করেছে এখন তার দ্বিগুন দামে চাল কিনে খেতে হচ্ছে। এ অবস্থা প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকের। আর মধ্যম আয়ের কৃষক কিছু ধান ঘরে রাখলেও গত এক মাস আগেই সে ধান শেষ হয়ে গেছে। এখন তাদের হাতে ধান নেই।
গত এক সপ্তাহ আগে দিনাজপুরের পাইকারি বাজারে বিআর আটাশ জাতের চাল ৩৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯ টাকা কেজিতে। একইভাবে মিনিকেট চাল ৪৪ টাকার স্থলে ৪৮ টাকা, গুটিস্বর্ণা ২৯ টাকার স্থলে ৩২ টাকা, বিআর উনত্রিশ জাতের চাল ৩৫ টাকার স্থলে ৩৮ টাকা, নাজিরশাইল ৫০ টাকার স্থলে ৫৪ টাকা, কাটারিভোগ ৭৪ টাকার স্থলে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রায় সব চাল এক সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৫০ কেজির বস্তাপ্রতি ১৫০ থেকে ২ শ’ টাকা পর্যন্ত।
বরাবরের মত খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা দাম বৃদ্ধির জন্য মিলারদের দায়ি করছেন। মিল মালিকদের মতে ধানের দাম বাড়ায় চালের দাম বেড়েছে। তবে বাজার বিশেষজ্ঞ হিসাবে পরিচিত দিনাজপুরের এক ব্যবসায়ী ও সমাজসেবী জানালেন, খোলা বাজার অর্থনীতিতে অনেক কিছুতেই ব্যবসায়ীরা স্বাধীন। বাজারের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো স্টক বিজনেস। একটি গুদামঘর, চাতাল বা কিছু জায়গা আর ট্রেড লাইসেন্স হলেই ব্যাংক কোটি কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। কোন শিল্প বা উৎপাদনশীল খাত নয় এর অধিকাংশ টাকাই ব্যবহার হচ্ছে স্টক ব্যবসায়। তার মতে, অটো মিলারদের কাছে ধান-চাল স্টক আছে বা থাকে এটা নিশ্চিত। কারন, তাদের মিল চালু রাখার জন্য ধানের মজুদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অটোমিল মালিকরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলেই সরকারের গুদামের দরজা খুলতে হবে। সামঞ্জস্য রেখে বাজারে চাল ছাড়তে হবে।
তার মতে, ধান-চাল, গম, ভুট্টা বাজারকে অস্থিতিশীল করার পিছনে স্টক বিজনেস কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকলেও স্টক বিজনেসে সে নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। দিনাজপুরের বিরল, বোচাগঞ্জ, কাহারোল, ফুলবাড়ীসহ আরো কয়েকটি উপজেলা রয়েছে যেখানে খাদ্যশস্য স্টক করে কোটিপতি হওয়ার উদাহরণ রয়েছে। বর্তমানে দিনাজপুরের স্টক ব্যবসায়ীদের ঘরে অন্তত: ৮ থেকে ১০ হাজার মন আমন মোটা ধান স্টক রয়েছে। দাম বাড়বে নিশ্চিত। আরো বাড়বে। তারপরে তারা বাজারে ছাড়বে। লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, খাদ্যশস্য স্টকের টাকা সরবরাহকারি হিসাবে কাজ করছে বাণিজ্যিক ব্যাংক। একদিকে চাল ক্রয় অন্যদিকে খোলাবাজারে চাল (ভর্তুকি দিয়ে নয়) বিক্রি এবং তদন্ত করে স্টক ব্যবসায়ীদের গুদামের তালা খোলার ব্যবস্থা করলেই বাজার নিয়ন্ত্রিত হতে পারে বৈকি।

এদিকে, কুষ্টিয়ায় খুচরা বাজারে সব রকমের চালের ওপর বেড়েছে কেজিতে ৩-৪ টাকা। চালের দাম প্রতি ৫০ কেজির বস্তায় বেড়েছে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। দেশের বৃহত্তম চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগর। এদিকে সব রকম চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা। কুষ্টিয়ায় বিভিন্ন স্থানে ৩৩টি বৃহৎ এগ্রো অটোরাইস মিলসহ ছোট-বড় প্রায় ৬০০ রাইস মিল গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি ধান সিদ্ধ-শুকানোসহ নানা প্রক্রিয়ার জন্য চাতালও রয়েছে দুই সহস্রাধিক। এখানকার চালকল মালিকদের দাবি, ধানের দাম বেশি হওয়ায় চালের দাম বেড়েছে। তবে অটোরাইচ মিল মালিকরা ক্যামেরার সামনে এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে রাজি হয়নি। দেশের সবচেয়ে বড় মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে, প্রায় সব রকম চালের দাম প্রকার ভেদে কেজিতে বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা। এ নিয়ে চলতি বছরেই বাড়লো তিন দফা।
পৌর বাজার ঘুরে জানা গেছে, মিনিকেট চাল গত ১ সপ্তাহ আগে ছিলো ৪৮ টাকা কেজি। এখন কেজিতে ৩-৪ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ টাকা। কাজল লতা চাল গত ১ সপ্তাহ আগে ছিলো ৩৮ টাকা কেজি এখন কেজিতে ৩-৪ টাকা বেড়ে ৪১-৪২ টাকা। মোটা চাল গত ১ সপ্তাহ আগে ছিলো ২৫ টাকা কেজি এখন কেজিতে ৪ টাকা বেড়ে ২৯ টাকা।
খুচরা বিক্রেতারা জানান, মিলারদের কাছ থেকে বেশি দামে চাল ক্রয় করায় বেশি দামে বিক্রয় করতে হচ্ছে। সব রকম চালের দাম বস্তাা প্রতি মিলাররা বাড়িয়েছে ১০০-৩০০ টাকা করে।
এদিকে মিল মালিকদের দাবি, ধানের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ অটোরাইস মিল মালিক সমিতি সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, কখনই ধানের বাজার বাড়ে নাই চালের বাজার বেড়েছে এমনটি কিন্তু হয়নি। যেহেতু মিল মালিকরা ধান বেশি দামে কিনে সেহেতু চালের দাম একট ুবেশি হবেই। কৃষকদের অভিযোগ, মৌসুমের শুরুতে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন তারা। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ধান মজুদ রেখে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
অপরদিকে, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। চাউল ব্যবসায়ী ও মিল মালিক, চেম্বার অব কর্মাস এবং খুচরা ও পাইকারী ব্যবসায়ীদের সাথে কুষ্টিয়া জেলার সর্বোচ্চ বাজার মনিটরিং কমিটির এ জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক মো: আসলাম হোসেনের সভাপতিত্বে সভায় চাউল ব্যবসায়ী ও মিল মালিকগণ এবং চেম্বার অব কমার্সের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চাল

১১ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ