Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চলে গেলেন এক মর্দে মোমিন

প্রকাশের সময় : ১০ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোঃ তোফাজ্জল বিন আমীন
মৃত্যু জীবনের এক অবশ্যম্ভাবী অমোঘ নিয়তি। অদৃশ্য এ বাঁধন থেকে আমরা কেউ মুক্ত নই। তবে মানুষের মৃত্যু আসে নানা পথে। কেউ মারা যায় যুদ্ধক্ষেত্রে, কেউবা হাসপাতালের বিছানায়, কেউ আকস্মিক দুর্ঘটনায়। প্রতিটি মৃত্যু কাউকে না কাউকে নাড়া দেয়। কিছু মানুষের মৃত্যু অকালে হয়ে যায়। আবার কিছু মানুষের মৃত্যু সর্বদাই অকাল রয়ে যায়। মুসলিম উম্মাহর অনুপ্রেরণার এক হীরক খ- মুহসিন বান্দা বিশ্ববিখ্যাত তাফসিরগ্রন্থ মাআরেফুল কোরআনের অনুবাদক, বহু গ্রন্থপ্রণেতা, বরেণ্য আলেমে দ্বীন, রাবেতা আল-আলম আল ইসলামীর সদস্য, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের সাবেক বোর্ড সদস্য, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ-এর সিনিয়র সহ-সভাপতি ও মাসিক মদীনার সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান আর আমাদের মধ্যে নেই। তিনি স্ত্রী, ৩ ছেলে ও ২ মেয়েসহ বহু আত্মীয়স্বজন রেখে ৮১ বছর বয়সের কর্মময় জীবনের ইতি টেনে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
দুনিয়া ও আরশের মহান অধিপতি কর্তৃক নির্ধারিত দিনক্ষণে প্রত্যেকটি মানুষের মৃত্যুর ফায়সালা হয়। সব মৃত্যুই প্রকৃত মৃত্যু নয়। আর প্রত্যেক মৃত্যুকেই মানুষ মনে রাখে না। কোনো কোনো মানুষের মৃত্যু অমরত্ব ও অবিস্মরণীয় হয়ে কিয়ামত পর্যন্ত প্রেরণা জোগায়। মাওলানা মুহিউদ্দিন খান মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেছেন। কিন্তু তিনি আজীবন বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়। এই প্রখ্যাত আলেমে দ্বীনের মৃত্যুর সংবাদ শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের কাঁদিয়েছে। তিনি ছিলেন ইসলামের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। আরবি ভাষা ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের একজন গবেষক হিসেবে তার পরিচিতি উপমহাদেশের ভৌগোলিক সীমানা ছাড়িয়েছে। ইসলাম এবং মুসলমানের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী ধ্বংসাত্মক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি যেভাবে যুগের পর যুগ নিরলসভাবে লেখনীর মাধ্যমে জিহাদ চালিয়ে গেছেন তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। সারা জীবন তিনি সংগ্রাম সাধনা করেছেন আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েম করার জন্য। ইসলামী আন্দোলনের এই প্রাণপুরুষ সম্পর্কে দুটো কথা লেখার ন্যূনতম যোগ্যতা আমার নেই। তারপরেও এই মহান নন্দিত জ্ঞানী মানুষের জীবনকথা নির্যাতিত ইসলামী আন্দোলনের ভাইবোনদের খেদমতে পেশ করছি।
জন্ম ও শিক্ষা জীবন : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ১৯৩৫ সালের ১৯ এপ্রিল কিশোরগঞ্জ জেলাধীন পাকুন্দিয়া উপজেলার সুখিয়া ইউনিয়নের ছয়চির গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার পাঁচবাগ ইউনিয়নের আনসারনগরে। তার পিতা বিশিষ্ট সাধক পুরুষ প্রবীণ শিক্ষাবিদ মৌলভী হাকিম আনছার উদ্দিন খান। তিনি উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দুবার কারাবরণ করেন। মাতা মোছাঃ রাবেয়া খাতুন। দাদা মুন্সী তৈয়ব উদ্দিন খান এবং দাদি কলমজান বিবি। এক বছর বয়সে তিনি দাদাকে হারান। মৌলভী আনছার উদ্দীন খান ৬ ভাইয়ের মধ্যে ছোট ছিলেন। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান বংশগত দিক থেকে ছিলেন এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের কৃতী সন্তান। মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ তার পূর্বপুরুষ ছিলেন। গফরগাঁও আলিয়া মাদ্রাসায় প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করে আলিম পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৫১ সালে আলিম ও ১৯৫৩ সালে স্কলারশিপসহ ফাজিল পাস করেন। ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ১৯৫৫ সালে হাদিস বিষয়ে কামিল ও ১৯৫৬ সালে ফিকহ বিষয়ে কামিল ডিগ্রি অর্জন করেন।
লেখক ও চিন্তাবিদ হিসেবে ভূমিকা : ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। মাদ্রাসা আলিয়া ঢাকায় থাকাবস্থায়ই তিনি সাপ্তাহিক কাফেলা, সাপ্তাহিক নেজামে ইসলাম, দৈনিক ইনসাফ, দৈনিক আজাদ ও দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেছেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত উর্দু দৈনিক পাসবান পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৬০ সালে মাসিক দিশারী, ১৯৬৩ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ‘সাপ্তাহিক নয়া জামানা’ সম্পাদনা করেন ও ১৯৬১ সাল থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মাসিক মদীনা সম্পাদনা করেছেন। বিগত ৫৫ বছর ধরে মাসিক মদীনা প্রত্রিকাটি নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়ে আসছে, যার অগণিত পাঠক দেশের সীমানার বাইরে ভারতের আসামে ও পশ্চিমবঙ্গের নানা স্থানে রয়েছে। বাংলা ভাষায় সিরাত সাহিত্যের বিকাশে তার অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি প্রায় ১০৫ খানা গ্রন্থ অনুবাদ ও রচনা করেন। তার সম্পাদিত মাসিক মদীনার প্রশ্নোত্তর সংকলন সমকালীন জিজ্ঞাসার জবাব ২০ মে প্রকাশিত হয়েছে। সীরাত জীবনী কোরআনের তাফসীর, বাণী সংকলন, ইসলামী আন্দোলন, ঐতিহাসিক ঘটনাবলী প্রভৃতি নানা বিষয়ের ওপর তার খুরধার লেখনী অনুবাদ ও রচনাবলী ইসলামী সাহিত্য জগতের অমূল্য সম্পদ। হযরত মাওলানা মুফতি শফী (র.) রচিত ৮ খ-ে মা’রেফুল কোরআনের বাংলা অনুবাদ তার বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর। এর সংক্ষিপ্ত সংস্করণ সউদি আরব সরকার প্রকাশ করেছে যা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। এ ছাড়া তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘জীবনের খেলাঘর’ সাড়া জাগিয়েছে। জীবনের খেলাঘর বইটি পাঠকদের পড়ার অনুরোধ রইল।
রাজনীতিক হিসেবে ভূমিকা : মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রাজনীতির ময়দানেও জাতির একজন অভিভাবক ছিলেন। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে ময়মনসিংহের গফরগাঁও নির্বাচনী এলাকায় জমিয়তের প্রার্থী হিসেবে খেজুর গাছ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সালের সম্মেলনে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে জমিয়তের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে নির্বাহী সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ইসলামী ঐক্যজোটের সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সাবেক সদস্য ও ডেপুটি স্পিকার এ টি এম আবদুল মতীনের সহযোগিতায় ‘দারুল উলুম ইসলামী একাডেমি নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। স্বাধীনতার পর এ প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন রাখা হয়। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ২০০৫ সালের ৯ ও ১০ মার্চ মাওলানা ভারতীয় নদী আগ্রাসন প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির ব্যানারে টিপাইমুখ অভিমুখে ঐতিহাসিক লংমার্চের ডাক দেন। এতে দেশের প্রায় ৩০টি সংগঠন যোগদান করে। এ ছাড়াও তিনি দেশীয় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। জাতীয় সিরাত কমিটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা, ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা প্রতিরোধ মোর্চার সাবেক সভাপতি, বেফাকুল মাদারিছ বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, সম্মিলিত উলামা মাশায়েখ পরিষদ, ইসলামী পত্রিকা পরিষদের সভাপতিসহ আরও অনেক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। ইসলামী আন্দোলনের এই বীর সিপাহসালার ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবের প্রথম সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। দেশ ও জনগণের জন্য তার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা জাতি চিরকাল মনে রাখবে।
বিশ্বরাজনীতিতে ভূমিকা : মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের বিচরণ শুধু বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বাংলাদেশের বাইরেও তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তিনি ১৯৮৮ সালে সৌদিভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘রাবেতায়ে আলমে ইসলামী’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন। বাদশাহ ফাহাদ কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প মদীনা মুনাওয়ারাহ সৌদি আরব কর্তৃক মুদ্রিত তাফসিরে মারেফুল কোরআনের বাংলা অনুবাদক ছিলেন। তিনি ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্কলার ও ভিজিটিং প্রফেসর। তার হাত ধরে দেশের অসংখ্য মেধাবী ছাত্র বিশ্বের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে অধ্যয়নের সুযোগ পেয়েছেন। ইসলাম স্বাধীনতা ও মানুষের অধিকার রক্ষায় তার ক্ষুরধার লেখনী ও আলোচনা ছিল মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহতায়ালার এক নেয়ামত। উপমহাদেশের আলেমদের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে যারা খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে মাওলানা ছিলেন অন্যতম। তিনি দেশের গ-ি পেরিয়ে বিশেষ করে আরব জাহানে, ইউরোপে এবং দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও একজন জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নাস্তিক মুরতাদ খোদাদ্রোহী, ইহুদি খ্রিস্টান, কাদিয়ানি অপশক্তির মোকাবেলায় আলেম সমাজ ও ইসলামী আন্দোলনের জনশক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।
মানুষের কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ : আল্লাহতায়ালার এই বান্দা সারা জীবন মানুষের কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। অসহায়, দরিদ্র ও ইয়াতিম ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যয়ভার বহন, সম্বলহীন লোকদের বসতবাড়ি নির্মাণসহ সার্বিক কল্যাণে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। বান্দরবান জেলার কয়েকশ উপজাতি পরিবার তার সহযোগিতায় ইসলাম গ্রহণ করে। সেখানে প্রায় তিন শতাধিক নারী-পুরুষকে তিনি তাওহীদ মিশন নামক সংস্থার মাধ্যমে পুনর্বাসন করেছেন।
ইসলামী ঐক্য প্রচেষ্টা : দীর্ঘদিন থেকে তৌহিদী জনতা এবং ওলামা-মাশায়েখের মধ্যে মতপার্থক্য দূর করার প্রয়াসে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এটি ছিল তার একটি বড় স্বপ্ন। তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। এখনো যারা তার মতো চিন্তা করেন, স্বপ্ন দেখেন, তাদের উচিত এ স্বপ্নের বাস্তবায়নে আরো জোর প্রয়াস চালানো।
পরিশেষে আমরা এই মহান মাওলানার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চলে গেলেন এক মর্দে মোমিন
আরও পড়ুন