পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার : ‘কত হাজার মরলে পরে বলবে তুমি শেষে/ বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে’ (কবির সুমন)। গণসংগীত শিল্পীর এ গানের মতো বলতে হয় ‘আর কত রক্ত ঝরলে স্বীকার করবো আমার দেশ ভাল নেই; দেশের নাগরিকেরা ভালো নেই। আর কতজন মানুষ জঙ্গী নামের দানবের হাতে প্রাণ হারালে আমরা স্বীকার করবো, দেশের আইন শৃংখলা পরিস্থিতি খারাপ; নিরাপত্তা বলতে নাগরিকের তেমন কিছু নেই; নাগরিকেরা উদ্বেগ-উৎকন্ঠা আর অনিশ্চয়তায় দিনযাপন করছে? আর কত রক্তাক্ত ট্রাজেডিতে মানুষের প্রাণ গেলে মন্ত্রীদের মুখে শুনতে হবে না ‘দেশের আইনশৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক; এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা? গুলশানে ২০ বিদেশী ও দুই পুলিশ অফিসারসহ ২৮ জনের প্রাণহানির রক্তাক্ত ট্রাজেডির শোকে সবাই স্তব্ধ। গোটা বিশ্বের দৃষ্টি ঢাকার দিকে। দেশের সর্বত্রই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। দেশী-বিদেশী মিডিয়া, ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ ও পাঠক মতামতে চলছে তুমুল বিতর্ক। সর্বত্রই ঘৃণা; শোকাতুর মানুষের আর্তনাদ। তারপরও মন্ত্রী-এমপিরা প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করেই যাচ্ছেন। এতোগুলো বিদেশীর প্রাণ হারানোয় দেশের ভাবমর্যাদা যখন প্রশ্নবিদ্ধ; গোটা জাতি যখন শোকে স্তব্ধ, তখনো হত্যাকারী আইএস না জেএমবি এ নিয়ে বিতর্ক!
হায় আল্লাহ! এতো রক্ত!! এতো চোখের পানি!!! রক্ত খেকো এই দানবদের ঠেকাবে কে? ক্ষমতালোভী স্বার্থবাদী দুর্গন্ধের রাজনীতিতে জাতি আজ দ্বিধাবিভক্ত। ক্ষমতাসীনরা দোষারোপ চর্চায় রত। আগামীতে যাদের দেশ গড়ার কথা; বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া সেই মেধাবী তরুণদের মগজ ধোলাই হয়েছে। তারা দানবের খাতায় নাম লিখিয়েছে। গোটা জাতি এটা নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। সারা পৃথিবীর দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে। ঢাকা ভরে গেছে বিদেশী সাংবাদিকে। বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়াগুলোর যে ক্যামেরার নজর এতোদিন ছিল সোমালিয়া, নাইজেরিয়া, মিশর, লিবিয়া, আইভরিকোষ্ট, সিরিয়ার দিকে; সে ক্যামেরাগুলো এখন তাক করা হয়েছে বাংলাদেশের দিকে! সুজলা সুফলা এই দেশের রাজধানীর সবচেয়ে নিরাপত্তাবেষ্টিত কূটনীতিক পাড়ায় এতোগুলো বিদেশীকে গলাকেটে হত্যা করা হলো? উন্নয়নকর্মী ওই বিদেশীদের কার কী অপরাধ? বিদেশীরা হলেন, এই দেশে অতিথি। অতিথি পরায়ণতার জন্য বিশ্বজোড়া খ্যাতি বাংলাদেশ কি বিদেশীদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠলো? ইতালীয় নাগরিক তাবেলা সিজার ও জাপানের হোসি কোনিও খুনের রক্ত এখনো শুকায়নি। তারপরও হত্যার মিছিল যেন থামছেই না। একদিকে গুম, ক্রসফায়ার-বন্দুকযুদ্ধের হত্যাকা- ঘটছে; সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা এটাকে ‘রাষ্ট্র নিজের হাতে আইন তুলে নেয়ার নামান্তর’ বলছেন। অন্যদিকে প্রায় নিয়মিত ছুরি-চাপাতির কোপে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। গ্রাম-শহর কোথাও মানুষ নিরাপদ নয়।
যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া-ইরাকের মতোই যেন দেশের এসব মৃত্যু স্বাভাবিক ঘটনা। পীর-খাদেম, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, লেখক, প্রকাশক, অধ্যাপক, পুরোহিত, সেবায়েত, পূজারী, ধর্মযাজক, ভিন্নমতাবলম্বী, ভিন্ন সম্প্রদায় এবং বিদেশী কেউ বাদ যাচ্ছেন না ছুরি-চাপাতির হাত থেকে। মৃত্যুর মিছিলে নিত্যদিন যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম। দেশের সাধারণ মানুষতো বটেই; বিশিষ্টজন, সামরিক বিশেষজ্ঞ, অপরাধ বিশেষজ্ঞসহ সবাই উৎণ্ঠিত এসব লোমহর্ষক ঘটনায়। টিভিতে যারা গুলশান ট্রাজেডির দৃশ্য দেখেছেন তাদের মনে হয়েছে এ যেন ভারতের মুম্বাইয়ের মারদাঙ্গা সিনেমার দৃশ্য দেখছি। এতোগুলো প্রাণ গেল তারপরও বিড়ালের রঙ সাদা না কালো বিতর্কের মতোই এ ঘটনায় আইএস, জেএমবি, আনছারুল্লাহ বাংলা টিম, আল-কায়দা, আইএসআই না দেশী জঙ্গী সে বিতর্কেই মেতে উঠেছি। অথচ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দু’দিনের শোক পালিত হচ্ছে।
এতোগুলো প্রাণহানিতে মানুষ হায় হায় করছেন। কেউ কেউ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশে জঙ্গীরা কি এতোই শক্তিশালী? এক সঙ্গে এতো প্রাণহানি ঠেকানো গেল না? রমজানের শেষ শুক্রবার ছিল জুমআতুল বিদা। পরের দিন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ রজনী শবে কদর। ধর্মপ্রাণ মানুষ যখন সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতার করে তারাবীহর নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর নৈকট্যলাভে মশগুল; তখন গুলশানের রেষ্টুরেন্টে জঙ্গরীা হামলা করে, নিরীহ দেশী-বিদেশী মানুষদের জিম্মি করে রক্তক্ষয়ী অভিশপ্ত খবরের জন্ম দেয়। রাতভর হত্যাকা- চালিয়ে ২০ বিদেশীসহ ২৮ জন মানুষকে খুন করে। সে কি রক্তাক্ত বীভৎস্য দৃশ্য। জঙ্গীদের রক্তাক্ত ওই হত্যাকা-ে পুরো জাতি স্তব্ধ। দেশের মানুষ স্তম্ভিত, শোকস্তব্ধ। পৃথিবীর তাবৎ মিডিয়ার খবরের ‘কেন্দ্র’ হয়ে উঠে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এখন আমরাই বড় খবর! এ বড়ই লজ্জার; গ্লানি আর মর্যাদাহানির! এ খবর বেদনার। আইনশৃংখলা বাহিনীর হাজার হাজার সদস্য রাতভর ঘিরে রাখলো; আর দানবরা একে একে ২০ বিদেশীর গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা করলো? এভাবে আর কত রক্ত ঝরলে আমাদের রাজনীতি আদর্শচ্যুত ও বিভক্তির বেড়াজালে বন্দী হিল্লী-দিল্লী প্রেমী নেতাদের ঘুম ভাংবে? ক্ষমতার মায়াজালে বেহুঁশ জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতিকদের হুঁশ হবে? নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র তথা তরুণরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে অন্ধকার জগতে পা বাড়াচ্ছে। যারা আগামীতে দেশ গড়বে; নতুন প্রজন্মের মানব হয়ে সুনাম করবে। তারা উচ্চশিক্ষিত মানব হয়ে দানবের খাতায় নাম লেখাচ্ছে। বিজ্ঞানের এ যুগে আমাদের তারুণ্যেভরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এ কি হাল! তাদের সামনে স্বপ্ন নেই! আদর্শ নেই? তাদের বিপথে ঠেলে দিচ্ছে মূল্যবোধহীন নষ্ট লুটেরা ভোগ আর দানবীয় অন্ধকার গলির রাজনীতি?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐক্যবদ্ধ ভাবে সন্ত্রাস মোকাবিলার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ জাতীয় সংলাপের ডাক দিয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া সকল ভেদাভেদ ভুলে এক সঙ্গে দাবনদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দাবি জানিয়ে বলেছেন, কে ক্ষমতায়, কে ক্ষমতায় যাবে সেটা বড় কথা নয়। ঐক্যবদ্ধভাবে সমস্যার সমাধান করতে হবে। বিএনপি মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংলাপের মাধ্যমে সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করার আহবান জানান। ড. কামাল হোসেন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক আসিফ নজরুলসহ শত শত বুদ্ধিজীবী বিবেকবান মানুষ ঐক্যের মাধ্যমে সংকট সমাধানের দাবি জানান। অথচ মন্ত্রীরা বিভেদের রেকর্ড বাজাচ্ছেন। কেউ বলছেন, গুলশান হামলায় বিবৃতি দিয়ে খালেদা জিয়া খুনিদের পক্ষ নিয়েছেন। কেউ বলছেন, বেগম জিয়া জঙ্গীদের সঙ্গে বসে আছেন। কেউ বলছেন, জামায়াত-শিবির হত্যাকা- ঘটিয়েছে। কেউ বলছেন, জেএমবি হত্যাকা- করেছে। প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টার দাবি গুলশান ঘটনা পাকিস্তানের আইএসআই ঘটিয়েছে। কেন এই স্ববিরোধী বক্তব্য? ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগী সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ বলেছেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অথচ ২০ জন বিদেশী খুনের পরও ক্ষমতাসীনদের কেন এই কাদায় গোলা ছোঁড়াছুঁড়ি? খুনের বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার বদলে মুখ দিয়ে কেন বিষ্ঠা ছড়াচ্ছেন? সবাই মনে করছেন সংকট নিরসনে ঐক্যের বিকল্প নেই। তাহলে বিচ্ছিন্নভাবে এসব দাবি ও ডাক দেয়া হলেও ঐক্য হচ্ছে না কেন? কেন মন্ত্রী-এমপিদের স্ববিরোধী কথাবার্তা বন্ধ হচ্ছে না। আমাদের নেতাদের রাজনীতির লাটাই কি বিদেশীদের হাতে? বিদেশীদের ইচ্ছার পুতুল হিসেবে আমাদের নেতানেত্রীরা অভিয়ন করছেন? তাদের নিজস্ব বোধবুদ্ধিতে কিছুই করতে পারছেন না? তা না হলে এতো রক্ত, এতো মায়ের চোখের পানির পরও কেন তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তথাকথিত জঙ্গীবাদের বিরেুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে পারছেন না? কেন ধারাবাহিক রক্তপাত ঠেকাতে পারছেন না? কেন আমাদের তরুণদের বিপথগামীতা ঠেকাতে পারছেন না? সামরিক বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন লিখেছেন, ‘চট্টগ্রামে এসপি’র স্ত্রীর হত্যাকা-ের পর জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু হলো। ১৩ হাজার সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হলো, যদিও তার মধ্যে জঙ্গীর সংখ্যা খুবই কম। এই অভিযান শেষ হওয়ার পরপরই গুলশানের সুরক্ষিত জায়গায় একটি রেস্তোরাঁয় হামলা হলো, অথচ আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেটা আগে জানতে পারল না। তার মানে আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গলদ আছে। এই লোকগুলো পিস্তল, গ্রেনেড, ওয়াকিটকি, ফোল্ডেড বাঁট রাইফেল নিয়ে সেখানে কী করে ঢুকল? নাকি তারা আগেই সেখানে এসব রেখে এসেছিল? এই হামলার সঙ্গে ভারতের মুম্বাইয়ে হামলার মিল রয়েছে। এটাকে আমরা ওই হামলার ক্ষুদ্র সংস্করণও বলতে পারি। এই দুই হামলায় দেখা গেল, হামলাকারীরা অরক্ষিত স্থান দিয়ে ঢুকে পড়ল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এ রকম একটি হামলা হতে পারে, সেটা আমরা ধারণাই করতে পারিনি। পুলিশ বাহিনী যেভাবে অভিযান চালাল, তাতে বোঝা যায় এসব হামলা প্রতিহত করার সক্ষমতা তাদের নেই। পুলিশের সেই প্রশিক্ষণ নেই। ফলে তাদের দু’জন নিহত ও প্রায় ৪০ জন আহত হলো। নাট্য নির্মাতা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘দেশটা ভারত নিয়ে নিলো? ইসলাম ধর্মকে ধ্বংস করার চক্রান্ত নিয়ে মাঠে নেমেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ? যারা প্রাণ হারিয়েছে তাদের ছবিগুলোর দিকে তাকাতে পারি নাই। এইসব বিকৃত লাশের ছবি দেখার পরও কিভাবে আমরা গাইবো- এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি? বিদেশীরা যখন জানতে চায় বাংলাদেশ কি আফগানিস্তান হতে চলেছে, তখন আমাদের গলায় আর কতদিন জোর পাবো বলতে ‘না’?’ নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশে এ ধরনের হামলা আমি চিন্তাও করতে পারি না। আমরা চাই বাংলাদেশ একটি সহনশীল উদারনৈতিক দেশ হবে। আমাদের অবশ্যই আন্তরিকতার সঙ্গে দেশে সহিংসতার উৎসমুখ খুঁজতে হবে। প্রত্যেকের অংশগ্রহণে আমরা একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই, যেখানে সবাই ভয়ভীতি বা বাধা ছাড়াই সব সুযোগ পাবে, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার পাবে। সমতা ও মর্যাদার উদীয়মান নতুন পৃথিবীর অংশীদার হতে চাই। শক্তিধর দেশগুলোর প্রতি আবেদন, অনুগ্রহ করে ভেদাভেদ ভুলে যান, যাতে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আসে এবং আমরা বিশ্বব্যাপী শহর ও সম্প্রদায়ে শান্তির সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারি। মধ্যপ্রাচ্যে সহিংসতা বন্ধ করে অবিলম্বে শান্তি আনতে সংশ্লিষ্ট পক্ষ ও শক্তিধর দেশগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করতে আমি সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’ ড. আনিসুজ্জামান বলেছেন, এই ঘটনা প্রত্যাশিত নয়; আবার একেবারেই অপ্রত্যাশিত তাও বলব না। অনেকদিন ধরেই বেশকিছু জঙ্গিবাদী বিচ্ছিন্ন ঘটনা একের পর এক ঘটাচ্ছিল। এরপর এই ঘটনাকে আর বিচ্ছিন্ন বলা যায় না। আইএসের যে দাবি তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। তারা তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে চেয়েছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে, এটা আশা করেনি। এখন কেউই নিরাপদ নয়। সকলেরই নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে। এটি এখন আর কোনো ব্যক্তি বা দলের চিন্তা নয়। সামগ্রিক চিন্তা। দেশের চিন্তা। দেশ নিয়ে, দেশের মানুষ নিয়ে, আমাদের প্রত্যেককেই ভাবতে হবে। নিরাপত্তা এখন জাতীয় ইস্যু। জাতীয় ইস্যুতে সবার এক হওয়া উচিত। মতাদর্শ নিয়ে বিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু দেশের স্বার্থ নিয়ে কোনো বিরোধের সুযোগ নেই। এই সংকট, এখন জাতীয় সংকট। আমাদের জাতীয়ভাবে সবাইকে একসুরে এর প্রতিবাদ করতে হবে। একে অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। জঙ্গিবাদ নিরসনে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বসে আলাপ করা জরুরি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নূর খান লিটন বলেন, গুলশানে হামলার মধ্যদিয়ে আইএস বাংলাদেশে রয়েছে তা জানিয়ে দিল। সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য হায়দার আকবর খান রনো বলেছেন, যেভাবে মানুষ হত্যায় সন্ত্রাসীরা তৎপরতা দেখাচ্ছে তা আমাদের প্রচ- চিন্তিত করছে। জঙ্গিদের হাত থেকে কেউ রেহাই পাচ্ছে না। সরকার ও পুলিশের পক্ষ থেকে কত আশ্বাস পেলাম, কোথায় সেই আশ্বাসের বাস্তবায়ন? নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইসফাক ইলাহি চৌধুরী বলেছেন, জঙ্গী সন্ত্রাসী হামলা, জঙ্গী তৎপরতা এর আগে এদেশে ঘটলেও মানুষ জিম্মি করে সন্ত্রাসী তৎপরতার ঘটনা এই প্রথম। এ ঘটনা নতুন মোড় নিল। এখন আমাদের অনেক সতর্ক হতে হবে, সাবধান থাকতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে সংঘটিত সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী ঘটনা এটি। অবিলম্বে সরকারকে সমস্ত প্রধান প্রধান বিরোধী দলসমূহকে নিয়ে একটা জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে, জাতীয় স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণ করতে, কিভাবে আমরা এই সংকট মোকাবিলা করব। এই সংকটে পুলিশ, গোয়েন্দা, র্যাব, সেনাবাহিনী, বিজিবি দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মোকাবিলা করা হয়তো সম্ভব, কিন্তু সুদূর প্রসারী মোকাবিলা করতে হলে অবশ্যই আমাদেরকে বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতায় আসতে হবে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মে. জে. (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, গুলশানের কূটনৈতিক এলাকায় একটি রেস্টুরেন্ট যে ভয়াবহ জঙ্গী হামলা সংঘটিত হয়েছে তা আগে থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল, আশঙ্কা ছিল দেশী-বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে। সন্ত্রাসী হামলার বিষয়ে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পূর্ণাঙ্গভাবে না হলেও আংশিকভাবে প্রস্তুতি ছিল। তবে তারা পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতিতে যেতে পারত। দেশে জঙ্গি তৎপরতা কোনোভাবেই বাড়তে দেওয়া যাবে না। পরিস্থিতি দাবি মেটাতে, রাজনৈতিক ঐক্যের বিকল্প নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা বৃহৎ ঐক্য জরুরি।
প্রবাদে আছে যার যায় সে জানে। যাদের পিতা-মাতা-সন্তান-স্বামী-স্ত্রী গুলশানে জঙ্গীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে তারা বোঝেন এ হত্যার যন্ত্রণা কত। বিবিসি’র খবর শুনছিলাম। হঠাৎ গ্রামের বাড়ি থেকে ফোন। ফোনের অপর প্রান্তে কান্নার রোল। ‘মা আর নেই’। মোচড় দিয়ে উঠলো বুক। যার গর্ভে ছিলাম সে মা গত হয়েছেন এক যুগ আগে। অতঃপর এই মা ছিল গ্রামে যাওয়ার অবলম্বন। ক’দিন আগে সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্য গ্রামে গিয়ে মায়ের পাশে দীর্ঘক্ষণ বসেছিলাম। ৮৫ বছর বয়স্ক মা দীর্ঘদিন থেকে বিছানায়। শরীর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মায়ের হাত ধরে নাড়াচাড়া করি। মানুষের হাত নয়; যেন শিম্পাঞ্জির হাত। রঙে শুধু পার্থক্য। সেই মা ইন্তেকাল করেছেন। গোটা পরিবার শোকাহত। ৮৫ বছর বয়সের মা’র ইন্তেকালে আমাদের যা অবস্থা; তাহলে গুলশানে যে সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণী ও বিদেশীরা প্রাণ হারালেন তাদের পরিবারের এবং পিতামাতার অবস্থা কেমন হতে পারে? গুলশান ট্রাজেডিতে নিহত বাংলাদেশির মধ্যে এলিগেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যানের মেয়ে অবিন্তা কবীর, ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের নাতি ফারাজ হোসেন ও ডেএক্সওয়াই ইন্টারন্যাশনালের মানব সম্পদ বিভাগের পরিচালক ইশরাত আখন্দ। এ সব সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণীর পরিবারের অবস্থা কেমন? আর ইতালির নাগরিক বারিধারাভিত্তিক ইতালীয় বায়িং হাউজ স্টুডিও টেক্স লিমিটেডের এমডি নাদিয়া বেনেদিত্তো, গুলশান ২ নম্বরের আরেক ইতালীয় বায়িং হাউজ ডেকাওয়ার্ল্ডের এমডি ভিনসেনজো দ আলেস্ত্রো, ক্লদিও মারিয়া দান্তোনা, সিমোনা মন্টি, মারিয়া রিবোলি, আডেলে পুগলিসি, ক্লদিও চাপেলি, ক্রিস্টিয়ান রোসিস ও মারকো তোনডাট। নিহত ৬ জাপানি হলেন তানাকা হিরোশি, ওগাসাওয়ারা, শাকাই ইউকু, কুরুসাকি নুবুহিরি, ওকামুরা মাকাতো, শিমুধুইরা রুই ও হাশিমাতো হিদেইকো। নিহত ভারতীয় নাগরিক হলেন তারিশা জেইন। যোগাযোগ মন্ত্রী জানিয়েছেন প্রাণ হারানো জাপানি নাগরিকরা জাইকায় কর্মরত ছিলেন। এই যে বিদেশীরা অস্ত্রধারীদের হামলায় নিহত হলেন; তাদের সবার পরিবার রয়েছে। রয়েছে বাবা-মা আত্মীয়-স্বজন। বাংলাদেশে তারা এসেছিলেন কাজ করতে। অথচ বেঘোরে তাদের প্রাণ দিতে হলো। তাদের কি কোনো দোষ ছিল? রোগে আক্রান্ত কয়েক বছর বিছানায় শয্যাশায়ী ৮৫ বছর বয়সী মা’র মৃত্যুতে আমরা বাকরুদ্ধ। তাহলে ওই বিদেশীদের পরিবারের সদস্য এবং দেশের সম্ভাবনাময় তিন তরুণ-তরুণীর পরিবারের সদস্যদের মনের অবস্থা কেমন হতে পারে? তারপরও রাজনীতির কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি? রাজনীতি নয়, ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। সরকারকেও এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোতে হবে। সচেতন, সতর্ক হতে হবে। দোষারোপের বদলে নিতে হবে সময়োচিত সিদ্ধান্ত। জনগণকেও এ বিষয়ে সচেতনা বৃদ্ধি জরুরি। জনগণ সচেতন হলে কোনো অশুভ শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। দেশের এই পরিস্থিতিতে একটি জাতীয় ঐক্য জরুরি। ঐক্য ছাড়া এই সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ করা অসম্ভব। গুলশানের ঘটনার পর বিদেশী মিডিয়াগুলোর সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, মন্তব্য প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন রিপোর্টে এই বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে। বিদেশীরা আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন আমরা নিজেরা ভাবি কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।