Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গুলশানে ভয়াবহ হামলা

পুলিশের দুই কর্মকর্তা নিহত : গুলিবিদ্ধসহ আহত ২৫

প্রকাশের সময় : ২ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:১২ এএম, ২ জুলাই, ২০১৬

২০ বিদেশীসহ অর্ধশত মানুষ জিম্মি : উদ্ধারে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির অভিযান : দুর্বৃত্তদের সংখ্যা ৮-১০ জন

স্টাফ রিপোর্টার
রাজধানীর কূটনৈতিক পাড়া গুলশানের একটি রেস্টুরেন্টে গতরাতে দুর্বৃত্তদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় গোলাগুলি হয়েছে। সন্ত্রাসীদের গুলি ও গ্রেনেড হামলায় গোয়েন্দা পুলিশের এসি রবিউল ও বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সালাউদ্দিন নিহত হয়েছেন। পুলিশ কর্মকর্তাসহ অন্ততঃ ২৫ জন গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, ভয়াবহ এ হামলার ঘটনায় রেস্টুরেন্টের ভেতরেও বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন। এ হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে ইসলামিক স্টেট বা আইএস। গুলশান-২, ৭৯ নম্বর সড়কের লেক সংলগ্ন একটি স্প্যানিশ রেস্টুরেন্টে এ ঘটনা ঘটে। হামলাকারীরা সেখানে অবস্থানরত অন্ততঃ ২০ জন বিদেশীকেও জিম্মি করে রাখে। পুলিশ, র‌্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পুরো এলাকা কর্ডন করে রেখেছে। মোতায়েন করা হয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)ও। এ ঘটনার পর পুরো ঢাকায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। রাত ২টায় এ রিপোর্ট লেখার সময় সেখানে অভিযানের সব রকম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
দেশের সবচেয়ে ভয়াবহ এ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ঘটনাস্থল ও অভিযানের দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার শুরু করে। এ সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকা-ে বিঘœ সৃষ্টি হয়। ফলে এক সময় র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমদ গণমাধ্যম কর্মীদের জাতীয় স্বার্থে সরাসরি সম্প্রচার না করে সহযোগিতার আহ্বান জানান।
ঘটনাস্থল ৭৯ নম্বর রোডের লেক সংলগ্ন হলি আর্টিসান বেকারি ও রেস্টুরেন্ট। এটি দুইভাগে বিভক্ত। সেখানে বিদেশীসহ কমপক্ষে অর্ধশত কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন। মূলত বিদেশিরাই ওই রেস্টুরেন্টের গ্রাহক।
সন্ত্রাসীদের হামলার পর প্রাণে বেঁচে আসা বেকারিটির সুপারভাইজার সুমন রেজা বলেন, রাত পৌনে নয়টার দিকে আট থেকে ১০ জন যুবক অতর্কিতে আর্টিসানে ঢুকে পড়ে। তারা মোটরসাইকেলে আসে ও তাদের কাঁধে ব্যাগ ছিল। রেস্টুরেন্টে ঢোকার সময় তাদের একজনের হাতে ছিল তলোয়ার, বাকিদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র। ঢুকেই তারা কয়েকটি ফাঁকা গুলি করে এবং আল্লাহু আকবর বলে স্লোগান দেয়। এ সময় রেস্টুরেন্টের ভেতর ২০ জনের মতো বিদেশি নাগরিকসহ অর্ধশত মানুষ ছিলেন। সুমন নিজে ও আর্টিসানের আরেকজন কর্মী (ইতালির নাগরিক) দোতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে বাইরে আসতে সক্ষম হন। সুমন বলেন, তারা ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে। প্রাণ রক্ষার্থে আমরা একটি কক্ষে অবস্থান নেই। তারা গুলি করতে করতে সেদিকে আসতে থাকলে আমরা ছাদে যাই। তারা সেদিকে আসতে চাইলে আমরা ছাদের গেইট লক করি। যখন বুঝতে পারি তারা ছাদে ঢোকার চেষ্টা করে সন্ত্রাসীরা। তারা সেখানে যেতে না পেরে গ্রেনেড বিষ্ফোরণ ঘটায়। তখন পুরো ভবন কেঁপে উঠে। ওরা সামনের দিকে স্টেপ নিচ্ছিল মনে হচ্ছিল। তখন ছাদ থেকে লাফ দেই। সুমন রেজা বলেন, ভেতরে থাকা আমাদের কর্মীরা ফোন ধরতেছে না। আমাদের স্টাফদের মধ্যেও দুজন বিদেশি। আর্জেন্টাইন কর্মীর কোনো খোঁজ নেই।
হামলার খবর পেয়ে বনানী থানা পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থলে যায়। পুলিশের টিম রেস্টুরেন্টে প্রবেশের চেষ্টাকালে সন্ত্রাসীরা ভেতর থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ও গ্রেনেড হামলা চালায়। পুলিশও এ সময় পাল্টা গুলি ছুঁড়ে। কিন্তু সন্ত্রাসীদের গুলির মুখে পুলিশ ভেতরে প্রবেশ করতে না পেরে পিছু হটে। এ সময় গ্রেনেড ও গুলিতে আহত হন গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ও বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য এবং একজন পথচারি। সহকর্মীরা তাদের উদ্ধার করে পাশের ইউনাইটেড হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। হাসপাতালে মারা যান পুলিশের ঐ দুই কর্মকর্তা। ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি আহতরা হলেন, পুলিশের দুই কনস্টেবল আলমগীর (২০) (ক. নং-৩৪৩৮) ও প্রদীপ (২০) (ক. নং ৩২৯১৩) এবং পথচারী মাইক্রোবাস চালক আব্দুর রাজ্জাক ওরফে রানা (৩০)। তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। আহতদের দেখতে হাসপাতালে যান আইজিসহ পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
রাত ১০টার পর আশপাশের থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ঘটনাস্থলে যায়। রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে ভেতর থেকে অস্ত্রধারীরা দ্বিতীয় দফায় পরপর দুটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। একইসাথে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এ সময় চারদিকে ঘিরে থাকা র‌্যাব-পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দৌড়ে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয়। এরপর বাড়ানো হয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা। র‌্যাব ঘটনাস্থলে অভিযানের প্রস্তুতি নেয়। রাত ১১টার পরে যোগ দেয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। আরো পরে আসে নৌবাহিনীর কমান্ডো ইউনিট।
আইন-শৃঙ্খলা জোরদার
এদিকে টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারের কারণে সারাদেশের মানুষ ঘটনার খবর তাৎক্ষণিক জেনে যায়। কিন্তু লাইভ সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যাবার পর তাদের মধ্যে আতঙ্ক আরো বাড়ে। ফলে সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থান নেয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ১০ হাজার পুলিশ নিয়োগ করা হয়। ঘটনাস্থল রাজধানীর গুলশান এলাকার ৪ কিলোমিটারের এলাকা কর্ডন করে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। কোনো যানবাহন চলাচল করতে দেয়া হচ্ছে না। যেখানে যে গাড়ি রয়েছে তা সেখানেই থামিয়ে রাখা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য দূতাবাসের সতর্কতা
নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য দূতাবাস। ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস টুইটারে নিজেদের অফিসিয়াল অ্যাকাউন্ট থেকে দেয়া এক পোস্টে বলে, গুলশান-২ এ গোলাগুলি ও জিম্মি অবস্থা তৈরি হয়েছে। সবাই নিরাপদ আশ্রয় নিন এবং সংবাদ মনিটর করতে থাকুন।
হামলাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে : র‌্যাব ডিজি
অভিযানের পূর্বে ঘটনা সম্পর্কে র‌্যাব মহা-পরিচালক বেনজির আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ভেতরে হামলাকারী যারা আছে, তাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ স্থাপন করতে চাই। তাদের কী দাবি দাওয়া আছে আমরা শুনতে চাই। আমরা বিষয়টা শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে চাই। কারণ প্রতিটা জীবনই আমাদের নিকট মূল্যবান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা চাই ঘটনায় আপনারাও (সাংবাদিক) আমাদের সহায়তা করবেন। তিনি জাতীয় স্বার্থে লাইভ সম্প্রচার না করার অনুরোধ জানান। এসময় রেস্টুরেন্টটির আশপাশের নাগরিকদের নিরাপদ দুরত্বে সরে যেতে অনুরোধ করা হয়।
এদিকে ঘটনার পরপরই পুলিশ আশপাশের সাধারণ বাসিন্দাদের নিরাপত্তার স্বার্থে বের না হবার অনুরোধ জানিয়ে মাইকিং করে। গুলশান দুই নম্বর থেকে আগত সব যানবাহন থামিয়ে দিয়ে তল্লাশী চালানো হয়। এরফলে ওই এলাকায় ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। ঘর ফেরতা মানুষ আটকে পড়েন গাড়ির ভেতর। অনেকেই পায়ে হেঁটে উল্টো পথে যাত্রা করেন। পুলিশ এলাকাটি কর্ডন করে রাখায় কোন সাধারণ নাগরিক বা যানবাহনকে ওই এলাকায় প্রবেশ করতে নিষেধ করে দেয়। যাতে সাধারণ নাগরিকের বেশে হামলাকারীদের সহযোগীরা এলাকাটিতে প্রবেশ করতে না পারে।

আইএসের দায় স্বীকার
গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে দেশি বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করার দায় স্বীকার করেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন আইএস (ইসলামিক স্টেট)।
শুক্রবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে (বাংলাদেশ সময়) আইএসের কথিত সংবাদ সংস্থা আমাক নিউজের বরাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ এ খবর দিয়েছে।
এর আগে রাত একটার দিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, আপাতত মনে করা হচ্ছে বন্দুকধারীরা উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর সদস্য। তবে তারা নির্দিষ্ট করে কোন গোষ্ঠীর সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গুলশানে ভয়াবহ হামলা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ