Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বেপরোয়া অজ্ঞানপার্টি

রমজান মাসে ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে ৪২ জন : গতকাল ভর্তি হয়েছে ৫ জন

প্রকাশের সময় : ৩০ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৫৩ পিএম, ২৯ জুন, ২০১৬

নূরুল ইসলাম : রাজধানীর পল্টন মোড়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন আনুমানিক ৩৬ বছর বয়সের এক যুবক। মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে পল্টন থানার এএসআই বাশার তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। গতকাল বুধবার বিকাল পর্যন্ত যুবকের জ্ঞান না ফেরায় তার পরিচয়ও জানা সম্ভব হয়নি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, চেতনানাশক খাবার খাওয়ার কারণে যুবকের জ্ঞান ফিরতে দেরি হচ্ছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। অজ্ঞাত ওই যুবকের পাশেই চিকিৎসা নিচ্ছেন আইনুল হক (৩৫) নামে আরেক যুবক। উত্তরা বশির উদ্দিন রোডে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল ভর্তি করে। তার পাশেই কামাল (৩৩) নামে আরেকজন। তাকে উদ্ধার করা হয়েছে সেগুনবাগিচা থেকে। গতকাল বুধবার অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে মোট ৫ জন।
ঈদ সামনে রেখে তৎপর অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টিসহ বিভিন্ন প্রতারকচক্র। পথে বা যানবাহনে চলতে-ফিরতে ইসপগুলের ভুসিমিশ্রিত পানীয়, আখের রস, যৌন উত্তেজক, ডায়াবেটিস অথবা গ্যাস্ট্রিক ‘নিরাময়ক’ হালুয়া খাইয়ে প্রতারণার ফাঁদ পাতে তারা। এদের খপ্পরে পড়ে টাকা-পয়সা খুইয়ে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। প্রায়ই ঘটছে জীবনহানির ঘটনা। শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে কেউ কেউ কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলছেন। ঢাকা মেডিকেলের পুলিশ ক্যাম্প ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া জানান, রমজান শুরু হওয়ার পর থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়ে কমপক্ষে ৪২ জন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিয়েছে। এর আগের তিন মাসে অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়ে বেশ কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে গত মার্চ মাসে প্রাণ হারিয়েছেন আফতাব উদ্দিন নামে এক মুক্তিযোদ্ধা। অজ্ঞানপার্টির সাথে থুথু পার্টি, ধাক্কা পার্টি ও টানা পার্টি চক্রও আছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মতিঝিল, পল্টন, সায়েদাবাদ, মহাখালী, গাবতলী, গুলিস্তান, ফার্মগেট, মালিবাগ ও মগবাজারসহ রাজধানীর প্রায় ৩০টি স্পটে বেপরোয়া এরা। পুলিশের অভিযানে মাঝেমধ্যে ধরা পড়লেও জামিনে বেরিয়ে এরা আবার বেপরোয়া হয়ে ওঠে। রমজানের শুরুতে ডিএমপির বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা বিভাগ রাজধানীর পৃথক স্থানে একাধিক অভিযান চালিয়ে অজ্ঞানপার্টির ২১ সদস্যকে আটক করে। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, রাজধানীতে গত বছর ও তার আগের বছর অজ্ঞান ও মলমপার্টির দৌরাত্ম্য বেশি ছিল। এবারও তারা দৌরাত্ম্যের চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে এবার আমরা ঈদের আগেই অভিযান শুরু করেছি।
ভুক্তভোগীদের মতে, ঈদকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে অজ্ঞানপার্টিসহ প্রতারকচক্রের তৎপরতা আশংকাজনক হারে বেড়েছে। ব্যস্ততম এলাকাগুলোতে প্রতিদিনই ঘটনা ঘটছে। পুলিশের তালিকাভুক্তরাই মাঠে নেমে মানুষের টাকাপয়সা স্বর্ণালংকার লুট করে নিচ্ছে। অনুসন্ধানেও মিলেছে এর প্রমাণ। জানা গেছে, রাজধানীতে অজ্ঞানপার্টির কয়েকটি সিন্ডিকেট ঈদকে সামনে রেখে সক্রিয়। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ীর মাসুদ সিন্ডিকেটে রয়েছে আতা, সেলিম সর্দার ও সবুজ। উত্তরায় পুলিশের অস্ত্র ছিনতাই মামলার আসামী ক্রসফায়ারে নিহত সন্ত্রাসী দস্তগীরের ভাই মাসুদ গ্রুপ সায়েদাবাদ ও গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় সক্রিয়। এ ছাড়াও রয়েছে হালুয়া পার্টি বলে পরিচিত সোহরাব গ্রুপ। এই গ্রুপে রয়েছে রাকিব, সোহাগ, হুমায়ুন ও আতা। এরা কমলাপুর, গুলিস্তান, মহাখালী ও গাবতলী বাস টার্মিনালে যাত্রীদের খাবারের মধ্যে নেশাজাতীয় খাবার খাইয়ে অজ্ঞান করে সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যায়। সূত্র জানায়, কোনো কোনো গ্রুপ আবার প্রাইভেট কার বা সিএনজি অটোরিকশায় যাত্রী তুলে সেই যাত্রীকে অজ্ঞান করে ঢাকার বাইরে ফেলে রেখে আসে। এই গ্রুপের মধ্যে আবুল গ্রুপ এখন সক্রিয়। আবুল গ্রুপে আছে আতা, রশীদ ও রিপন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের অজ্ঞাপার্টির এক সদস্য জানান, সায়েদাবাদে অজ্ঞানপার্টির সদস্যদের অজ্ঞান করার মেডিসিন (ওষুধ) সরবরাহ করে মনিরের ছেলে। একসময় এই কাজ করতো মনির নিজেই। মনিরের ছেলের দলে আরও আছে জুয়েল, কাসেমসহ বেশ কয়েকজন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব চক্রের বাইরেও রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তৎপর হয়ে উঠেছে সিদ্ধিরগঞ্জের রহিম, নাসির, আব্বাস, আক্তার, জালকুঁড়ি এলাকার লতিফ, সানারপাড়ের কালা সিরাজ, মকবুল, মনির, জহির, বাদশা, সোহরাব, কেরানীগঞ্জের হোসেন, সেলিম, আনোয়ার, হাসনাবাদের কালা শাজাহানসহ অনেকেই। এরা ছাড়াও নগরীতে সক্রিয় রয়েছে যাত্রাবাড়ী রায়েরবাগের হাসমত, শামীম, সিদ্দিক, শনিরআখড়ার করিম, কবির, মাসুম, কাজলার বেলাল, নাসির, আমজাদ, কাশেম, ধলপুর সিটি পল্লীর কাসেম, জসীম ওরফে নুরা পাগলা, রামপুরার এমদাদ, শ্যামপুরের ইব্রাহীম, ইউসুফ, দনিয়ার স্বপন, আবুল, ছোট আক্তার, মাতুয়াইলের মান্নান খালাসী, মীরহাজিরবাগের স্বপন, সবুজ, সুমন, ইমরান, নাসির, শাহীন, রাসেল, যাত্রাবাড়ীর এনায়েত, মান্নান, সবুজ, খালেক, সুমন, আল আমীন, কট বাবু, ফর্সা মনির, ধোলাইপাড়ের দুলাল, রহিম, লিটন, টেম্পু শাহীন, সায়েদাবাদের কিরণ, জুরাইনের কালাম, আলম, আসাদ, সাগর, মাইনুসহ আরো অনেকে। এদের বিচরণ সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, গুলিস্তান, মতিঝিল, ফার্মগেট, মহাখালী এলাকাসহ পুরো নগরীতেই। নগরীর অভিজাত এলাকা উত্তরায় সক্রিয় রয়েছে কালিয়াকৈরের আক্কাছ মোল্লা গ্রুপ। এদের বেশিরভাগই পুলিশের তালিকাভুক্ত। কেউ কেউ একাধিকবার গ্রেফতারও হয়েছে।
রমজানের শুরুতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ অজ্ঞানপার্টির ২১ সদস্যকে আটক করে। এরা হলোÑআবুল হোসেন, মনসুর আলী, শহীদ, শাহজাহান, আবুল হোসেন-২, মনিরুল ইসলাম, রাজু, আবু সাঈদ, নুরুজ্জামান, জাকির হোসেন, আব্দুর রহমান, নূর ইসলাম, সন্তোষ কুমার দে, জুয়েল, আল মামুন, হোসাইন মো. সুমন ও জুম্মন। এ সময় তাদের কাছ থেকে ২৮ পুরিয়া হালুয়া, হলুদ রঙের বক্সে জিরো ক্যালরি লেখা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়।
ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতারকচক্র নিরীহ মানুষজনকে টার্গেট করে থাকে। বিশেষ করে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও উত্তরাঞ্চল থেকে আসা গরিব ও সহজ-সরল যাত্রীরাই প্রতারকচক্রের খপ্পরে পড়ে বেশি। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর অজ্ঞানপার্টি। দূরপাল্লার যাত্রীদের খাবারে কৌশলে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয় এ চক্র। কিছুক্ষণের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়া যাত্রীকে হাসাপাতালে নেওয়ার নাম করে সর্বস্ব হাতিয়ে নিয়ে সটকে পড়ে। গাবতলী-আরিচা রুট, মহাখালী-টাঙ্গাইল ও সায়দাবাদ-কুমিল্লা রুটে এই চক্রের তৎপরতা মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়েছে। প্রতিটি টার্মিনালে ১৫-১৬ জনের সংঘবদ্ধচক্র এ অপকর্ম করে চলেছে। অভিযোগ রয়েছে, একশ্রেণীর পরিবহণ শ্রমিকের সাথে প্রতারকচক্রের যোগসাজশ রয়েছে। কতিপয় দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যও টাকার বিনিময়ে তাদেরকে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে থাকে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা বাসের যাত্রী সেজে অথবা বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে মানুষকে আকৃষ্ট করে অজ্ঞান করার ওষুধমিশ্রিত খাবার খাওয়ায়। একইভাবে রাস্তায় খাবারের পসরা বসিয়ে (আখের রস, ডাব ও হালুয়া, ইসপগুল) এবং সিএনজি অটোরিকশাতে যাত্রীবেশে অন্য যাত্রীকে উঠিয়ে পান ও জুস খাওয়ায় অজ্ঞান ও মলমপার্টির সদস্যরা। তারা এমনভাবে মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে কথা বলেন যে অধিকাংশই চিনতে না পেরে তাদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে খাবার খান, কেউ জুস কিংবা ডাবের পানি খান। কেউবা ইসপগুল ও হালুয়া খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এই সুযোগে প্রতারকচক্র সবকিছু লুট করে নিয়ে যায়।
এসবের বাইরে রয়েছে সিএনজি অটোরিকশাকেন্দ্রিক অজ্ঞানপার্টি চক্র। এরা সিএনজি অটোরিকশা টার্গেট করে যাত্রীবেশে ওঠে। এরপর নির্জন স্থানে নিয়ে চালককে অজ্ঞান করে অটোরিকশা নিয়ে পালিয়ে যায়। এই চক্রে রয়েছে কানা শহীদ, ধোলাইপাড়ের আকতার শেখ, মাওলা, আক্কাস মোল্লা,সস্ত্রীক হাবিব, মজিবরের মেয়, মন্টু, কালাম, জাকির, কবির মেম্বার, বরিশাইল্যা কবির, কবির(২), কবিরের ভায়রা জামাল, কুদ্দুস, মনু, হারুন, বাবুল, বাবুল(২), হারুন(২), সানু মেম্বার, শাজাহান, ফারুক, ফারুক(২), শামীম, রহিম, মন্টু, রফিক মেম্বার ও রফিকুল। এরা সবাই অটোরিকশা চালকদের অজ্ঞান করে অটোরিকশা ছিনতাই করে। এরপর দালালের মাধ্যমে মালিককে ফোন করে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। এদের পক্ষে দালাল হিসাবে কাজ করে ধোলাইপাড়ের ফারুক ওরফে ফ্রেন্স ফারুক।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, অজ্ঞানপার্টি বা ছিনতাইকারী বা পেশাদার অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান নিয়মিতভাবেই চলে আসছে। ঈদকে সামনে রেখে দৌরাত্ম্য বাড়তে পারে এ আশঙ্কায় রমজানের আগে থেকেই অজ্ঞানপার্টি গ্রেফতারে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ২১ জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বেপরোয়া অজ্ঞানপার্টি
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ